কোথায় হচ্ছে? স্কুলের পাঠ্য বইতে।
কোন রাজ্যে? বিজেপি শাসিত সব রাজ্যেই। পড়ার বইয়ে হিন্দু ছাড়া অন্য কোনও ধর্মাবলম্বীর নামই নেই।
২০২৫ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ বা আরএসএস’র একশো বছর পূর্তি। সংবিধান নির্দেশিত ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়, সংখ্যাগুরুবাদী সাম্প্রদায়িক ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ আরএসএস’র লক্ষ্য। আরএসএস’র রাজনৈতিক শাখা বিজেপি। কেন্দ্রে এবং বিভিন্ন রাজ্যের দলের সরকারগুলিকে কাজে লাগিয়ে চলছে সেই প্রস্তুতি। গোড়াতেই শিশুমনে চারিয়ে দেওয়া হচ্ছে সেই ধারণা।
দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক পাঠক্রমে উদ্বেগ জানাচ্ছে একাধিক শিক্ষক সংগঠন। শিক্ষক সংগঠন এবিটিএ’র সভাপতি কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্য বলছেন, ‘‘বহু ধর্ম, বহু ভাষার বৈচিত্র্য নিয়ে ভারত। সেই ধারণাকে গোড়াতেই নষ্ট করে ফেলার ব্যবস্থা হচ্ছে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়।’’
২০২০’তে সংসদে কোনওর আলোচনা ছাড়া নয়া শিক্ষা নীতি পাশ করিয়েছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। সংবিধান অনুযায়ী কেন্দ্র যৌথ তালিকার বিষয়। কিন্তু রাজ্যগুলির বিস্তারিত মতামত নেওয়ার দিকে যায়নি বিজেপি। শিক্ষা আন্দোলনের বিভিন্ন অংশই মনে করিয়ে দিচ্ছেন কেবল গৈরিকীকরণই যে স্পষ্ট তা নয়। স্পষ্ট বেসরকারিকরণের নীতিও। শিক্ষাকে পণ্য করে বেসরকারি মুনাফার জন্য তুলে দেওয়া হয়েছে।
নয়া শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদও চলছে। বামপন্থী সংগঠনগুলি রয়েছে প্রতিবাদের সামনের সারিতে। ভট্টাচার্য বলছেন, ‘‘প্রতিবাদের মুখে পড়ে শিক্ষানীতির সবটা প্রয়োগ করতে পারছে না। কিন্তু প্রক্রিয়া পুরোদমে চালু আছে।’’
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০’তে বলা হয়েছে, আঞ্চলিক ইতিহাস পড়ানোর ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিতে হবে। কিন্তু বিজেপি সরকারের শিক্ষানীতিতে এই আঞ্চলিক ইতিহাসকে কেন্দ্র করে শিশুদের বোঝানো হচ্ছে যে পুরান আর ইতিহাসের মধ্যে কোনও ফারাক নেই। শিক্ষক আন্দোলনের বক্তব্য, ইতিহাস অনুসন্ধানে বিজ্ঞানমনস্কতাকে ধ্বংস করছে আরএসএস। গুজরাট, উত্তরপ্রদেশের মতো বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে এই প্রক্রিয়া চালু রয়েছে। ‘ভারত গণতন্ত্রের জন্মদাত্রী’, এই বিষয়ে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে আলোচনাসভা করার জন্য রাজ্যপালদের চিঠি পাঠিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বা ইউজিসি। তাঁরা বলছেন, বিপজ্জনক দিক হলো জাত ভিত্তিক ‘বর্ণাশ্রম’ প্রথা বা জাত-গোষ্ঠী নির্ভর খাপ পঞ্চায়েতকে আধুনিক ভারতে গণতন্ত্রের জন্য শিক্ষণীয় বলে প্রচার হচ্ছে।
কয়েকদিন আগে দেশের বামপন্থী শিক্ষক সংগঠনগুলির সর্বভারতীয় মঞ্চের বৈঠক হয়েছে কলকাতায়। অংশ নিয়েছে এবিটিএ-ও। বিভিন্ন রাজ্যে শিক্ষার নাম করে উগ্র হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক উপাদান প্রচারের বিষয়টি নিয়ে বিশেষ আলোচনা হয়েছে। ভট্টাচার্য বলছেন, ‘‘বিভিন্ন রাজ্যে, বিশেষ করে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে শিক্ষাক্ষেত্রে আক্রমণ ব্যাপক। বিজ্ঞানমনস্ক, আধুনিক, যুক্তিবাদী শিক্ষার বদলের ছাত্রদের মধ্যে কুসংস্কার ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।’’ তিনি আরও জানান যে, নয়া শিক্ষা নীতির বিরুদ্ধে গোটা দেশ জুড়ে সংগঠনের পক্ষ থেকে সই সংগ্রহ করে রাষ্ট্রপতির কাছে দাবি পত্র জমা দেওয়া হবে।
বেদের যুগকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে প্রচারেও প্রশ্ন তুলছেন শিক্ষকরা। তাঁরা বলছেন, ইতিহাসের পাতায় দেখা যাবে যে বৈদিক সমাজে পুরুষ এবং মহিলাদের আলাদা চোখে দেখা হচ্ছে। কোনও স্তরে মহিলাদের সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র মনে করা হচ্ছে। মহিলাদের কাজ বাড়িতে থাকা, শিশুদের পালন করা এবং পুরুষদের সেবা করা। তাঁরা বলছেন, বৈদিক সমাজেও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ছিল। সেই অনুসন্ধান থেকে সরে গিয়ে বিভেদের বৈদিক সমাজকে আদর্শ বলে দেখানো হচ্ছে।
শিক্ষকরা মনে করিয়েছেন, বৈদিক সমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল বর্ণাশ্রম। বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে ভাগ। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্রের মধ্যে সব থেকে বেশি অত্যাচার লাঞ্ছনার মুখোমুখি হতে হয়েছে শূদ্রদের। তাঁরা বলছেন, দলিত এবং আদিবাসী নিপীড়ন বাড়ছে। এই সময়ে প্রজন্মান্তরে সামাজিক শোষণকে ভুলিয়ে দেওয়ার কৌশল সমাজের পক্ষে কাঙ্ক্ষিত নয়।
শুধু এখানেই শেষ নয় স্বাধীনতা আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকাকে খাটো করে দেখানোর প্রবণতা প্রথম থেকেই রয়েছে এই সরকারের। আর তাই বিভিন্ন রাজ্যের পাঠ্য বইতে জায়গা পায় না ব্রিটিশ বিরোধী ‘মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা’।
এবিটিএ’র বক্তব্য, শিক্ষা কাঠামোয় গণতন্ত্র এবং বিজ্ঞানমনস্কতা বাতিল করছে এ রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেস সরকারও। আরএসএস’র মুখপত্র ‘পাঞ্চজন্য’-তে মমতা ব্যানার্জিকে ‘দুর্গা’ বলা হয়েছিল। তারপর তাঁকে কেন্দ্রের বিজেপি’র মন্ত্রীসভার সদস্যও হতে দেখেছে দেশের মানুষ। এখন নিজেকে ‘বিজেপি বিরোধী মুখ’ হিসাবে তুলে ধরতে চাইলেও স্ববিরোধ স্পষ্ট। নবান্নে বসে কয়েকদিন আগে তিনি বলেছেন, ‘‘আমি ব্যাক্তিগত ভাবে মনে করি যে আরএসএস অতটা খারাপ নয়।’’
বামপন্থীরা বারেবারেই বলেছেন যে ২০১১ সালে বামফ্রন্ট সরকারকে হারানোর জন্য তৃণমূলকে পিছন থেকে সমর্থনও করেছে আরএসএস-ও। রাজ্যের সরকারে তৃণমূলের মেয়াদে শাখাও বাড়িয়ে নিয়েছে আরএসএস। ২০১১’তে রাজ্যে আরএসএস পোষিত স্কুলের সংখ্যা ছিল মাত্র ৪১২। এখন সেই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৪১৮৬‘তে, মাত্র ১১ বছরে।
এবিটিএ বলছে, শিক্ষার বেসরকারিকরণ রাজ্যেও চলছে জোরকদমে। ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিক্যাল কলেজ বা বিএড কলেজ তৈরিতে ‘অনুপ্রেরণা’ অতুলনীয়। অথচ সরকারি প্রাইমারি স্কুল, হাই স্কুল শিক্ষকের অভাবে ধুঁকছে। বাড়ছে ড্রপ আউট।
ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘অকারণে স্কুল বন্ধ রেখে, শিক্ষক পদে নিয়োগ না করে রাজ্যের সরকারি স্কুলগুলিকে সরকার শেষ করে দিতে চাইছে। অভিভাবকদের ধারণা হচ্ছে যে সরকারি স্কুলের থেকে বেসরকারি স্কুলগুলিতে পড়াশোনা ভালো হয়। ছেলেমেয়েদের সরকারি স্কুল ছাড়িয়ে বেসরকারি স্কুলে ভর্তি করছেন তাঁরা।’’
ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, নয়া শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে এবং শিক্ষায় বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে তাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া হবে।
Comments :0