আতঙ্কের এলাকায় ধর্মের উঠোনে জাঁকিয়ে বসছে অপরাধীরা
অপরাজিত বন্দ্যোপাধ্যায়: হাসনাবাদ
২৯ মার্চ— দোল পূর্ণিমা গেছে রবিবার। তার দু’দিন আগে শুরু হওয়া সংকীর্তন এখনও চলছে। বারাসত ছেড়ে টাকি রোড ধরে বসিরহাট হয়ে হাসনাবাদ রেখে এগিয়ে তবে হিঙ্গলগঞ্জ। জায়গায় জায়গায় চলছে বন্দনা। ভক্ত সমাবেশ কত? সামান্য কিংবা একদমই নেই। তবু কুছ পরোয়া নেই। শুধু মাইক যোগে চলছে প্রবল কীর্তন।
একইভাবে এবার বসিরহাটে রোজাদারের সংখ্যাও বেড়েছে। চলছে ‘মফেল’ থেকে রাত জেগে ‘ওয়াচ’ অর্থাৎ ধর্মীয় ভাষণ শোনার পালা। বেড়েছে মসজিদও। বসিরহাটের ঘোনাকোটরার মতো গ্রামে আগে যেখানে ছিল একটা মসজিদ, সেখানে এখন বেড়ে হয়েছে দশ। জুম্মার নমাজ পড়তে না গেলে এখন গঞ্জনা শুনতে হয়। রোজা না রাখলেও কথা চলে গ্রামে। নতুন প্রজন্মের মধ্যে ধর্মের প্রতি টান এখন চোখে পড়ার মতো।
বিচিত্র পরিবেশ তৈরি হয়েছে গ্রামাঞ্চলে। রোজা ভেঙে হাসনাবাদের তালপুকুর মোড়ে ইফতার করতে আসা আবু আলি মোল্লা ভরা বাজারে বলেই বসলেন, ‘ইলেকশন এয়েসে বলেই কী রোজাদার বাড়লো!’ বর্ষীয়ান মানুষটির কথার প্রতিবাদ তো দূর, উলটে হেসে সবাই সমর্থন জানালেন।
ধর্ম নিয়ে এমন মাতামাতি আগে দেখেনি বসিরহাটের মানুষ। কে দিচ্ছে টাকা? প্রশ্ন স্বাভাবিক। রাজনীতির সঙ্গে ধর্মকে মিলিয়ে দেওয়াটা সুকৌশলে করে চলেছে দুই শাসক দলই। ‘সন্দেশখালির বাঘ’শেখ শাহজাহান খাঁচায়। জেলা পরিষদের অনেক মাতব্বর এখন জেলে। তাই রয়ে যাওয়া শাসক দলের ডাকাবুকো নেতারা এখন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ভরসা রাখছেন। হিন্দু প্রধান পাড়ায় শাসক দল কীর্তনে উৎসাহ দিচ্ছে, তো মুসলিম পাড়ায় চালানো হচ্ছে ওয়াচ।
কেন্দ্র-রাজ্যের দুই শাসক দলের নেতারা এখন নিজেদের ভারকেন্দ্র ঠিক রাখতে ক্রমশ এর ওর দিকে চলে আসছে। থানা ম্যানেজ করে গ্রামীণ অর্থনীতিকে কবজা করা শাসক দলের নেতারা এখন ভূস্বামীতে পরিণত হয়েছে। তাঁদের অমতে জমি কেনা দূর, বিক্রি করাও যায় না। বারাসত থেকে টাকি রোড ধরে খোলাপোঁতা হয়ে বাদুড়িয়া গেলেও যা দৃশ্য, বসিরহাট ছাড়িয়ে ইছামতী আর গৌড়েশ্বরী পার করে পার হাসনাবাদে গেলেও একই দৃশ্য।
আতঙ্কের ঘেরাটোপে বেঁচে থাকা জনপদে শাসকদের দু’পক্ষ ধর্মীয় অনুষ্ঠানে জাঁকিয়ে বসেছে, অবশ্যই ভোটের জন্য— এখানে ধর্মীয় বিশ্বাস গৌণ।
শাসকদলের ব্লক সভাপতি অথবা ঐ এলাকার জেলা পরিষদের সদস্যের হাতেই দেওয়া হয়েছে ক্ষমতা রাশ। পুলিশ থেকে সরকারি পারিষদ, সকলেই কার্যত তাদের অনুগত কর্মচারী। ভোট লুটের ক্ষমতার ওপরেই সেসব নেতাদের দর বাড়ে-কমে। আর গরিব মানুষের টাকা শোষণ করা এখানে শাসকের জন্মগত অধিকারে পরিণত হয়েছে। প্রতিবাদ করতে গেলে প্রথমে হুমকি, তারপর প্রকাশ্যে মারধর, সেটাও সহ্য করে নিলে মিথ্যা মামলা দিয়ে জেল। প্রতিবাদীর পরিবারকে গ্রামে থাকতে হলে দিতে হয় মোটা অঙ্কের জরিমানা।
গ্রামে কোনও কাজ নেই। কর্মহীন সমর্থ যুবকরা পাড়ি দিচ্ছেন ভিন রাজ্যে। কিছু যুবককে লোভ দেখিয়ে নিজেদের পেয়াদা করে রেখে দিয়েছে এলাকার সেই সব ‘শিবু-শাহাজাহানরা’। ‘বাদুড়িয়ার বাদশা’বুরাহানূল মুকাদ্দিন ওরফে লিটন। একসময়ে রঘুনাথপুর হাইস্কুলের সহ প্রধান শিক্ষক, বর্তমানে মহেশপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের মুখের ভাষা শুনলে বোঝার উপায় নেই তিনি ইংরেজি ভাষার স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী। বাদুড়িয়ার এই বাহুবলী আবার উত্তর ২৪ পরগনার জেলা পরিষদের শিক্ষা-সংস্কৃতির কর্মাধ্যক্ষ।
মাস্টারমশাই নিজে মাঠে নামেন না। তার জন্য তৈরি রয়েছে বাহিনী। বাহিনী পরিচালনায় তাঁর দারুণ ‘সুখ্যাতি’। কেউ তাঁর আজ্ঞা পালন না করলেই তিনি লেলিয়ে দেন পুলিশকে। বাদুড়িয়ার ওসি সিদ্ধার্থ মণ্ডল একশো শতাংশ লিটন অনুগত। একসময়ে বাদুড়িয়ার পোলতা গ্রামে থাকতেন মাস্টার। এখন থাকেন বসিরহাট শহরে। টাকি রোড ধরেই রয়েছে তাঁর নজরদারি। টাকা-পয়সা আদান-প্রদানের শব্দ শোনা গেলেই সেখানে পৌঁছে যায় মাস্টারের লোক। রফা না হলেই বন্ধ কাজ।
বসিহাটের এক সময়ের ‘বেতাজ বাদশা’বারিক বিশ্বাস একটু অন্তরালে রয়েছেন। তার সেই অন্তরালের সুযোগে এখন আগের থেকে নিজের জোর আরও বাড়িয়ে নিয়েছেন শাহানুর মণ্ডল। এক সময়ের এলাকায় সাইকেল ভ্যান টেনে, বিড়ি বেঁধে সংসার চালাতেন তিনি। কিন্তু ২০১৪ সালে বসিরহাটের নিমদারি কোদালিয়া পঞ্চায়েতের উপপ্রধান হওয়ার পর থেকেই তাঁর উত্থান শুরু। এরপরে স্থানীয় প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে গোরু পাচার তাঁর জীবন পালটে দিয়েছে।
কেবলমাত্র টাকার জোরে তিনি এবারে জেলা পরিষদের খাদ্য বিভাগের কর্মাধ্যক্ষ। তার বাড়ির প্রত্যেকেই চাকরি পেয়েছেন গত ১২ বছরে। শাহানুরের ভাই শাহরব মণ্ডল শাকচুরা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান। দু’ভাইয়ের কৃতিত্বের পরিচয় মেলে শাকচুরা বাজারে দু’ভাইয়ের দুটি প্রাসাদোপম বাড়ি। তৃণমূলের নেত্রীর ‘খেলা হবে’ স্লোগানে অনুপ্রাণিত হয়েই হয়ত তেতলা বাড়ির মাথায় তৈরি হয়েছে সিমেন্টের বল। বাড়ির পাশে বিশাল শাকচুরা বাজার চলে শাহানুরের কথায়।
পান থেকে চুন খসলে উপায় নেই। ছাড়তে হবে এলাকা। এটাই শাহানুরের বিধান। শাহানুরকে ছাড়িয়ে হাসনাবাদ ছাড়িয়ে পার হাসনাবাদে পড়লেই শাসক দলের আর এক বাহুবলী’র বাড়িতে রয়েছে সেই সিমেন্টের বল। তাঁর নাম আমিরুল ইসলাম গাজি। তিনি হাসনাবাদে তৃণমূলের ব্লক সভাপতি। এর পাশাপাশি তিনি আবার পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি। পার হাসনাবাদ এলাকায় বিশাল সম্পত্তি বানিয়েছেন তিনি। কাটাখালিতে রয়েছে আমিরুল ইসলামের ১৪০ বিঘা জমি। এর বেশিরভাগটাই জোর করে দখল করা। আর সেই জমির একপাশে রয়েছে বিশাল ১০০ বিঘার জলকর।
জলকরের পাশে এখন আমিরুল তৈরি করেছেন ইটভাটা। কাটাখালি ব্রিজ পার হয়ে একটু দূরে গেলেই ডান দিকে রাস্তা নেমে গেছে। সেখানে গেলে দেখা যাবে আমিরুলের বিপুল সম্পত্তি। মূলত থানা ম্যানেজ করেই এলাকা সামলান তিনি। রাজ্য পুলিশের বাহিনী হিসাবে নয়, হাসনাবাদ থানার পুলিশ তাঁর বাহিনী হয়ে কাজ করতেই অভ্যস্ত। আমিরুলের এলাকা ছাড়ালেই আসে হিঙ্গলগঞ্জ। সেখানে হিঙ্গলগঞ্জ ব্লক সভাপতি সইদুল গাজি ওরফে কেনা সর্বেসর্বা। প্রশাসনিক পদের পাশাপাশি তিনি আবার ওই ব্লকের তৃণমূল ব্লক সভাপতি। ভোট লুটে এই সইদুল গাজির ‘খ্যাতি’ আজ সর্বজন বিদিত।
কাকে বাদ দিয়ে কাকে ধরা যাবে! বসিরহাট থেকে ভেবিয়া হয়ে মিনাখাঁয় গেলেও পড়তে হবে সেখানকার তৃণমূলের ব্লক সভাপতি আয়ুব আলি হাজির দখলে থাকা এলাকায়। তিনি সেখানে শাসক দলের প্রধান। একইভাবে টাকির উপ পৌরপ্রধান ফারুক আহামেদের নিয়ন্ত্রণেই চলে সব।
প্রশাসনকে নিজের কাজে লাগিয়ে লুটকে ভিত্তি করেই সারাবছর নিজের ভোগবিলাসের জীবনযাপনে অভ্যস্ত এরা সবাই। পাঁচ বছর অন্তর একবার করে লুটেরার ভূমিকায় কাজ করেই টিকে আছেন ওই সব এলাকার শাসক দলের সব লুটেরারা।
Comments :0