River

নদীর বালি-পাথর গেছে ব্যবসায়ীর বাড়ি নির্মাণে

রাজ্য

মালবাজার : ৮ অক্টোবর— দিন দশেক ধরেই চলেছিল নদীবক্ষে সেই ধ্বংসযজ্ঞ। প্রকাশ্যে, দিবালোকে। মাল নদীর ঘাট থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরের সেচ দপ্তরের কার্যালয়, মাল মহকুমা হাসপাতালের পিছনে। অথচ সেচ দপ্তর ছিল নীরব দর্শকের ভূমিকায়। ভূমি রাজস্ব দপ্তরও ছিল চোখ বন্ধ করেই। 
দশমীর রাতে মাল নদীতে হড়পা বানের তোড়ে অস্থায়ী বাঁধ ভেঙে জলস্রোতে আটজনের মৃত্যুর মর্মান্তিক ঘটনার প্রতিটি পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে প্রশাসন, পৌরসভা আর শাসক তৃণমূলের ঠিকাদার বাহিনীর প্রত্যক্ষ যোগ। শনিবার দুপুরে মাল নদীর ঘাটের সামনে দাঁড়িয়ে গত বুধবারের রাতের প্রত্যক্ষদর্শী যুবক বলছিলেন, ‘সবাই সব জানে, মুখ বন্ধ রাখে। সবাই জানে ট্রাকে করে বালি, পাথর তুলে নিয়ে যাচ্ছে। সবাই জানে চেয়ারম্যানের ঠিকাদার বাহিনী পায় সেই বরাত। খোঁজ নিয়ে দেখুন এখান থেকে নুড়ি, বালি তুলে শুধু পাচার নয় একজনের বাড়িতেও যাচ্ছে।’
আর সেই খোঁজ নিতেই সামনে এলো রীতিমত চাঞ্চল্যকর তথ্য। সেই তথ্য আবারো জানান দিচ্ছে তরাই থেকে ডুয়ার্স, দক্ষিণ থেকে উত্তরবঙ্গ- তৃণমূল আছে তৃণমূলেই, চুরি-পাচারেই সাবলীল।  
শুধু সম্পূর্ণ অবৈধভাবে নদীর গতিপথ আটকে দিতে অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণ নয়, উৎসবের দিনগুলিতেই সেই নদীবক্ষ থেকে আর্থমুভার দিয়ে ছোট পাথর, নুড়ি, বালি ট্রাকে করে তৃণমূল ঘনিষ্ঠ এক গাড়ি ব্যবসায়ীর বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছিল! সেই ব্যবসায়ী অধুনা মাল পৌরসভার চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠতম লোক।
মাল নদীতেই মর্মান্তিক এই বিপর্যয়ের পিছনে মূল কারণই দলীয় ঠিকাদার দিয়ে বেআইনিভাবে অস্থায়ী বাঁধ তৈরি করে গতিপথ বদলে দেওয়ার চেষ্টা। তার জন্যই নামানো হয়েছিল জেসিবি, আর্থমুভার নদীর চরে। সেই আর্থমুভার দিয়ে বালি, বজরী তুলে বেমালুম বিক্রি করে দেওয়া হয়। কোটি টাকার সরকারি রয়্যালটির ক্ষতি।
কিন্তু এখানেই শেষ নয়। শেষ ছয়দিন ধরে নদীর বুক থেকে বালি, বজরী ট্রাক ভর্তি করে নিয়ে যাওয়া হয় রতন যাদবের বাড়িতে। তাঁর পেল্লাই বাড়ি হচ্ছে। বাড়ির নির্মাণকার্যে মেঝে ঢালাইয়ের জন্য প্রয়োজন হয় বালি, বজরী। মাল নদী থেকে তা তুলে ট্রাকে ট্রাকে করে পৌঁছায় সেই তৃণমূল ঘনিষ্ঠ কারবারীর বাড়িতে!
রতন যাদব। একাধিক ট্রাক, গাড়ির মালিক। বিপুল সম্পত্তিরও মালিক। বর্তমানে মাল পৌরসভার তৃণমূলী চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠ। কিছুদিন আগে পর্যন্ত ছিলেন বিজেপি’র ঘনিষ্ঠ। ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের সময় এই রতন যাদবের হুডখোলা গাড়িতে করেই নির্বাচনী প্রচার সেরেছিলেন বিজেপি সাংসদ জন বার্লা। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনেও বিজেপি-র হয়ে প্রকাশ্যেই তাঁকে দেখা গিয়েছিল। বিপুল টাকা বিনিয়োগ করেছিল বিজেপি-তে। বিধানসভা ভোটের ফল প্রকাশের পর সেই করিৎকর্মা রতন যাদবই হয়ে ওঠে মমতা ব্যানার্জির দলের অন্যতম ফান্ড ম্যানেজার। তৃণমূলী চেয়ারম্যান স্বপন সাহার ঘনিষ্ঠ। পুজোর সময় যখন সরকার, পুলিশ-প্রশাসন, সেচ দপ্তরকে নীরব দর্শক বানিয়েই নদীর বুকে মেশিন নামিয়ে বেআইনিভাবে অস্থায়ী বালির বাঁধ তৈরির কাজ চলছিলও তখন তৃণমূলী চেয়ারম্যানের সঙ্গেই তাঁকে রোজই দেখা গেছে মাল নদীর ঘাটে। আর্থমুভার নামিয়ে বালি, বজরী তুলে ট্রাকে ভরে নিজের বাড়িতেই নিয়ে যাচ্ছিলেন এই রতন যাদব। তাঁর বাড়ির মেঝে ঢালাইয়ের জন্য। 
   আর সেই ধ্বংসযজ্ঞের পরিণামে আট সাধারণ মানুষের সলিল সমাধি নদীবক্ষেই। ভায়া বিজেপি তৃণমূলে ভিড়ে যাওয়া বিপুল সম্পত্তির মালিক গাড়ি ব্যবসায়ীর বাড়ির কাজের জন্য মেশিন নামিয়ে নদী থেকে তোলা হচ্ছে বালি, বজরী! চুপ প্রশাসন, পুলিশ। তাই এত বড় ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পরেও পুলিশের তরফে কোনও স্বতঃপ্রণোদিত এফআইআর টুকুও পর্যন্ত করা হয়নি। শাসক তৃণমূলের চাপেই। 
  মাল শহরের একাধিক পরিবেশ সংগঠনের দাবি, বালি, বোল্ডার পাচারের কারবারে প্রতিটি নদী বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। শনিবারও মাল নদীতে ফের হড়পা বান। তীব্র জলোচ্ছ্বাস আছড়ে পড়ে খরস্রোতা মাল নদীতে। দুপুরের পর থেকেই মাল শহর সহ পার্শ্ববর্তী পাহাড়ি এলাকাতে ভারী বৃষ্টি শুরু হয়। 
  সময় যত এগচ্ছে ততই স্পষ্ট হচ্ছে বালি, বোল্ডার পাচারের কাঁচা টাকার তৃণমূলী খিদেই মাল নদীর বুকে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার রাস্তাকে আরও প্রশস্ত করেছে।
  নিজের একমাত্র সন্তান, স্ত্রীর কাজ ছিল এদিন। বাড়িতেই সেই কাজ। এক লহমায় সর্বস্ত হারানো সেই দিলীপ পণ্ডিত এদিন বলছিলেন, ‘নিজের স্ত্রী,সন্তানের কাজ করতে হচ্ছে! ওদের কী অপরাধ ছিল? কে দায়ি তাহলে? প্রশাসন,সরকারই তো দায়ি। আমি এদের সবার শাস্তি চাই। নদী থেকে বালি, পাথর তুলে কোটি কোটি টাকার কারবার চলছে আর তার জন্য আমাদের গরিব সাধারণ মানুষকে প্রাণ দিতে হচ্ছে’।
 একই সঙ্গে গুরুতর অভিযোগ উঠতে শুরু করে দিয়েছে সেচ দপ্তরের বিরুদ্ধে। উৎসবের সময় সেচ দপ্তরের প্রতিটি কন্ট্রোল রুম খুলে রাখার সরকারি নির্দেশ ছিল। বিশেষ করে বিভিন্ন জেলায় যেখানে নদীঘাটে বিসর্জনের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু জানা গেছে গত বুধবার দশমীর রাতে মালবাজারের সেচ দপ্তরের কন্ট্রোল রুম বন্ধ ছিল। অফিসই বন্ধ ছিল। শহরের বুকে নদী ঘাটে হাজার হাজার মানুষের সমাগম, দশ দিনে নদীর বুকে জেসিবি মেশিন দিয়ে কাজ চললো, একই সঙ্গে আবহাওয়া দপ্তরের পূর্বাভাস ছিল তা সত্ত্বেও মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরে বিসর্জনের রাতে সেচ দপ্তরের কন্ট্রোল রুম কেন বন্ধ ছিল? সেচ মন্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিনকে এই ব্যপারে প্রতিক্রিয়া নেওয়ার জন্য যোগাযোগের চেষ্টা হলেও ফোনে মেলেনি। মালবাজারে এই সেচ দপ্তরের কন্ট্রোল রুমে একজন সহকারী ইঞ্জিনিয়ার, একজন জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার এবং একজন করণিক থাকার কথা। নদীর পরিস্থিতি, জলস্রোত বাড়ছে কিনা সেই সব তথ্য প্রশাসনকে জানানোর কথা। অথচ বন্ধ ছিল কন্ট্রোল রুমই। মেলেনি তাই কোনও সতর্কতার বার্তাও। আবার সেচ দপ্তরের একটি সূত্রে জানা গেছে এমনকি গত দশ বছরের বেশি সময় ধরে বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণের কর্মীপদও শূন্য রয়েছে, কোনও কর্মীই নেই!
 এদিকে, মালবাজার পৌরসভার এক সাব অ্যাসিসট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ারের বিরুদ্ধে দুর্ঘটনার রাতে চরম অমানবিকতার অভিযোগ উঠেছে। জনৈক সুভাষ বিশ্বাস সামাজিক মাধ্যমেই অভিযোগ করেছেন হড়পা বানের স্রোত আসায় বাঁচার জন্য তাঁর মেয়েকে যাতে জেসিবিতে বসিয়ে কোনোমতে নদীর ঘাট পর্যন্ত নিয়ে পার করে দেওয়া যায় তার অনুরোধ করেছিলেন ঐ সাব অ্যাসিসট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার দেবু নন্দীকে। যদিও তিনি তাতে কর্ণপাত করেনি। শুধু নিজেকে বাঁচাতে জেসিবি-তে বসে পড়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

Comments :0

Login to leave a comment