Women's Reservation Bill

পুরানো মহিলা বিলই পেশ হলো সংসদে

জাতীয়

Womens Reservation Bill

বহুদিন ধরে ঢাকঢাক গুড়গুড়ের পর মঙ্গলবার নতুন সংসদ ভবনে লোকসভার বিশেষ অধিবেশনে পেশ করা হলো মহিলা সংরক্ষণ বিল। ২০১০ সালে মনমোহন সিং সরকারের সময়ে আনা বিলটি যা রাজ্যসভায় পাশ হয়েছিল, সেটায় সামান্য সংশোধন করে দাবি করা হলো, এটি নতুন বিল এবং ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। আইন ও ন্যায়বিচার মন্ত্রী অর্জুন সিং মেঘওয়াল বিলটি পেশ করার আগেই প্রধানমন্ত্রী এই নিয়ে ভাষণ দেন এবং নিজেকে কার্যত ঈশ্বরের দূত বা অবতার হিসাবে তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ঈশ্বর এইরকম অনেক পবিত্র কাজের জন্য আমাকে বেছেছেন! মহিলা সংরক্ষণ বিল পেশ করতে গিয়ে এদিনের সভায় মন্ত্রী মেঘওয়ালও বলেছেন, মহিলাদের স্বশক্তিকরণ এবং উত্থানও মোদীজীই করবেন। বিল পেশেই স্পষ্ট হয়েছে, মহিলারা নয়, লোকসভা ভোটের আগে মোদীকে প্রতিষ্ঠিত করতেই এই বিল এবং সংসদের বিশেষ অধিবেশন।
আইনমন্ত্রী অর্জুন মেঘওয়াল ‘নারীশক্তি বন্ধন অধিনিয়ম’ বিল পেশ করে বলেছেন, লোকসভা এবং রাজ্য বিধানসভাগুলিতে ৩৩শতাংশ আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত হবে। অন্য সব সংরক্ষণের মতই ১৫ বছরের জন্য কার্যকরী হবে আইন হওয়ার পরে। তারপর আবার মেয়াদ বৃদ্ধি করা যেতে পারে। প্রতিবার ডিলিমিটেশনের পরে মহিলা সংরক্ষিত আসনগুলি অদল বদল হবে। কিন্তু আসল কথাটিই মন্ত্রী বিলটি পেশ করার সময়ে বলেননি, যা বিলের মধ্যে আছে। তা হলো, আগামী ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে এটি কার্যকরী হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। ২০২১ সালের জনগণনা করেনি মোদী সরকার। ফলে তার ভিত্তিতে যে ডিলিমিটেশন বা আসন পুনর্বিন্যাস হওয়ার কথা ছিল, সেটাও হয়নি। ২০০২ সালে ৮২ তম সংবিধান সংশোধনের সময়ে বলা হয়েছিল, ২০২৬ সালের পর প্রথম জনগণনার ভিত্তিতে ডিলিমিটেশন প্রক্রিয়া করা যাবে। সেই অর্থে ২০২৬ সালের পরে প্রথম জনগণনা হওয়ার কথা ২০৩১ সালে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে জনগণনা করা হবে ২০২৭ সালে। তা-ও যদি হয়, তাহলেও ২০২৯ সালের লোকসভা ভোটের আগে কোনোভাবেই আসন সংরক্ষণ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আর যদি ২০৩১ সালে জনগণনা হয়, তাহলে আরও পিছিয়ে যাবে। এর পাশাপাশি ৫০ শতাংশ রাজ্য বিধানসভাতেও এই বিলটি পাশ করাতে হবে, তবে আইন হবে। রাজ্য বিধানসভাগুলিতে আসন সংরক্ষণ করতে গেলে বিধানসভাতেও পাশ করাতে হবে এই বিল। 
এই জায়গাতেই প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডেকে এখন বিল পেশ এবং পাসের কী অর্থ আছে? ভোটের আগে চমকের জন্যেই মহিলা সংরক্ষণকে ব্যবহার করার চেষ্টা? ফলে বিভিন্ন দলের মহিলা নেত্রীরা একে জুমলা, গিমিক এবং ঠকানো হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। সোশাল মিডিয়ায় প্রশ্ন উঠেছে, এবারের লোকসভা ভোটে কি বিজেপি’র প্রচার হবে, ২০২৯ সালে মহিলাদের আসন সংরক্ষণ করার জন্য ২০২৪ সালে মোদীকে ভোট দিন?  বিশ্লেষকদের মত, সেই প্রচারে ভোটের অঙ্কে বিশেষ কাজ দেবে না। কারণ এটা সাধারণ মহিলাদের ক্ষেত্রে সরাসরি প্রভাব ফেলবে না। 
সিপিআই (এম) পলিট ব্যুরো সদস্য বৃন্দা কারাতও এই বিষয়টির দিকেই নজর করিয়ে বলেছেন, ২০১৪ সালের ভোটের আগে বিজেপি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, লোকসভা, বিধানসভায় মহিলাদের জন্য  সংরক্ষণের। দুই দফায় ৯ বছর সরকার চালানোর পরে এখন সেটা পেশ করছেন, যার ফলে পরের জনগণনা এবং ডিলিমিটেশন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কার্যকরী করা যাবে না। বিজেপি নেতারা এবং গোদী মিডিয়ার পক্ষ থেকে এই বিল পেশকে ঐতিহাসিক এবং যুগান্তকারী বলে বর্ণনা করা হয়েছে। মোদী নিজে এদিনের বক্তৃতায় একাধিকবার ‘মা-বোন-বেটি’ বলেছেন। অতীতের সরকারগুলির এই নিয়ে প্রচেষ্টাকে যথাসম্ভব লঘু করে বলেছেন, ‘‘সংসদে আগেও কিছু চেষ্টা হয়েছে। ১৯৯৬ সালে প্রথম বিল পেশ হয়। অটলজীর সরকারের সময়েও বারেবারে চেষ্টা হয়। কিন্তু পাস করানোর সংখ্যা ছিল না।’’ এটিই সার কথা, অতীতের সরকারগুলি সংখ্যা না থাকাতেই পাস করাতে পারেননি। এবং সেখানেই প্রশ্ন উঠেছে শুরু থেকেই মোদী সরকারের হাতে সেই সংখ্যা থাকার পরেও তা কার্যকরী করলেন না কেন? তাহলে তো এতদিনে তা কার্যকরী হয়ে যেত সমস্ত সাংবিধানিক প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করে। যদিও সেই আলোচনার মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই মোদী বা বিজেপি নেতারা যেতে চাইছেন না। 
মোদী এদিন কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের সময়ে, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং যে বিল রাজ্যসভায় এনেছিলেন এবং পাশ হয়েছিল সেকথা সম্পূর্ণ চেপে গেছেন। অথচ হুবহু সেই বিলটিতে যা ছিল তাই পেশ করা হয়েছে, শুধু বাদ দেওয়া হয়েছে অ্যাঙলো-ইন্ডিয়ান মহিলাদের জন্য সংরক্ষণের বিষয়টি। মোদী নিজেকে এরপরে টেনে এনে বলেছেন, ‘‘মহিলাদের স্বপ্ন অসম্পূর্ণ থেকে গেছে। মহিলাদের অধিকার দেবার, শক্তির ব্যবহার করার মতো ঈশ্বর এইরকম অনেক পবিত্র কাজের জন্য আমাকে বেছেছেন।’’ মোদীর এই বক্তব্যে টেবিল বাজিয়ে সহাস্যে বিপুল সমর্থন জানিয়েছেন বিজেপি সাংসদরা। আজকের দিনটি ইতিহাসে অমরত্ব পাবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। 
এরপরে আইনমন্ত্রী মেঘওয়াল যতটা বিল সম্পর্কে বলেন, তার থেকে বেশি মোদীর সম্পর্কে বলেন। মেঘওয়াল বলেন, আমাদের যশস্বী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নারীকে সবসময় শক্তিস্বরূপা মেনে এসেছেন। মোদীর নেতৃত্বে দেশে মহিলারা মহাকাশ থেকে শিল্প-সাহিত্য সর্বত্র অগ্রগতি ঘটাচ্ছে। দেশ মহিলাদের উন্নয়ন থেকে মহিলাদের নেতৃত্বে উন্নয়নের পথে এগচ্ছে। আবাস যোজনা থেকে নলবাহিত জলের উদাহরণ দিয়ে মন্ত্রী বলেছেন, দেশে অসাম্য দূর করেছেন মোদী। মহিলাদের স্বশক্তিকরণ এবং উত্থানও মোদীই করবেন। সোশাল মিডিয়াতেও এইভাবে মহিলাদের ‘উত্থান’ এর জন্য মোদীকে ‘অবতার’ বানানো চলছে বিজেপি’র পক্ষ থেকে। বুধবার থেকে সংসদের দুই কক্ষে আলোচনাও এই ধারাতেই হবে বলে মনে করা হচ্ছে। 
বিশ্লেষকদের মতে, মহিলাদের উপর ক্রমবর্ধমান অত্যাচার এবং কাজের সুযোগ কমে যাওয়া, মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি সব মিলিয়ে দেশের মহিলাদের বিরাট অংশ মোদী সরকারের উপরে খুবই ক্ষুব্ধ। তার উপর মহিলা কুস্তিগিরদের সঙ্গে যৌন হেনস্তাকারীদের পাশে দাঁড়ানো, দেশের নাম উজ্জ্বল করা মহিলা ক্রীড়াবিদদের রাস্তায় ফেলে পেটানোর ঘটনায় সেই ক্ষোভ আরও বেড়েছিল। এরমধ্যেই মণিপুরের ঘটনা সামনে আসার পরে দেশ-বিদেশে মুখ দেখাতে পারছেন না মোদী। বিশেষ করে মণিপুর নিয়ে তাঁর নীরবতাও অসন্তোষ তৈরি করেছে। সেই কারণে নানাভাবে মহিলাদের ক্ষতে প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা চলছে। ৮০০ টাকা বাড়ানো গ্যাসের দাম ২০০ টাকা কমিয়ে রাখিবন্ধনের উপহার বলেছেন। এবার লোকসভা, বিধানসভায় আসন সংরক্ষণের কথা বলেছেন।

Comments :0

Login to leave a comment