Post editorial

অভয়ার 'ভয় ভাঙানিয়া' মহৌষধ

উত্তর সম্পাদকীয়​

গৌতম রায়

আন্দোলনরত জুনিয়ার ডাক্তারবাবুদের সঙ্গে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়সহ রাজ্যের শীর্ষস্তরের আমলাদের আলোচনার সরাসরি সম্প্রচার প্রায় সবাইই দেখেছেন। সেটা দেখবার পর, প্রায় সকলেরই একটাই কথা; ওদের সাহস আছে বটে। আজ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রীর সামনে বসে, তাঁর মুখের উপরে তাঁর সরকারের নেতিবাচক দিকগুলি এবং দুর্নীতির বিষয়গুলি এভাবে সরাসরি বলবার সাহস কারো হয়নি।
প্রত্যক্ষ রাজনীতির অঙ্গনের বাইরে এই যে নাগরিক সমাজের মধ্যে সাহসের সঞ্চার এটাই বোধহয় বিচারের দাবিতে আন্দোলনের সবথেকে বড় রাজনৈতিক সাফল্য। আর এই সাফল্যটাই শাসকের  ভিত্তিটাকে পর্যন্ত টলিয়ে দিয়েছে। সাধারণ মানুষের একটা অংশ, ভয়ে হোক বা অন্য যে কোনও কারণ থেকেই হোক, শাসকের প্রতি দুর্বলতা অনুভব করতো, সেই সমস্ত মানুষেরা গোটা এই আন্দোলন পর্বে, অনশন এবং মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের সরাসরি সম্প্রচার দেখে, তাঁরাও ভয়কে জয় করবার পথে হাঁটতে শুরু করেছেন। আর ঠিক সেই কারণেই, ডাক্তারবাবুদের উপরে জঘন্য ব্যক্তি আক্রমণ নামিয়ে আনতে শুরু করেছে শাসক। হেনস্তা করার পরিকল্পনা করছে আন্দোলনকারীদের উপর। এটাই একমাত্র জানা আছে শাসকের।
শাসকের ভণ্ডামো অভয়ার ধর্ষণ এবং খুনের প্রেক্ষিতে যে ভাবে ধরা পড়ে গেছে, মনে হয়, সেটা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি শাসক। আগের বহু ক্ষেত্রের মতোই অভয়ার ঘটনাটিকে ' ম্যানেজ' করে নিতে পারবে- এটাই ছিল শাসকের বদ্ধমূল ধারণা। কারণ, গত তেরো বছর ধরে ,' ম্যানেজ' করে নিতে নিতে , ' ম্যানেজ ' করে নেওয়া ঘিরে শাসকের আত্মবিশ্বাসটা এতোই টইটম্বুর হয়ে উঠেছিল যে, কোনও অপরাধকে চাপা দেওয়াটা ' অসাধ্য' বলে ভাবতে তারা  অভ্যস্ত ছিল না।
সেই ' ম্যানেজে' র জায়গাটা এত অসাধ্য হয়ে পড়েছে দেখেই কিন্তু ডাক্তারবাবুদের সঙ্গে বৈঠকের সময়ে , তাঁদের দাবি পূরণে এক পা অগ্রসর না হয়েও কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী অনেক কথা বেমালুম হজম করে নিতে বাধ্য হয়েছেন। বহু কঠিন কথা, যেগুলি তিনি সরাসরি আগে কখনো শোনেননি, সেইসব কথা নবীন ডাক্তারবাবুদের কাছ থেকে শুনেও তাঁর স্বভাবসুলভ ধমকানোর  পথে এগোননি। বরং বলা যেতে পারে, নবান্নের ওই বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীর যে কণ্ঠস্বর আমরা শুনেছি, যে ভঙ্গিমা আমরা দেখেছি, তা তাঁর প্রশাসনিক বৈঠকের সুর,স্বর,বডি ল্যাঙ্গুয়েজের থেকে আলাদা। এভাবে মুখ্যমন্ত্রীকে কার্যত কথা বলতে বাধ্য করেছেন নবীন ডাক্তারবাবুরা। আর এই কার্যক্রমের মধ্যে দিয়ে ওই নবীন ডাক্তারবাবুরা ' ভয় ভাঙানিয়া' এক মহৌষধ গোটা রাজ্যবাসীকে দিয়েছেন ।
রবীন্দ্রনাথ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকালে ' গান্ধী মহারাজ' নামক কবিতায় লিখেছিলেন;" ষন্ডা যখন আসে তেড়ে, উঁচিয়ে ঘুষি ডান্ডা নেড়ে। আমরা হেসে বলি জোয়ানটাকে, ওই যে তোমার চোখ রাঙানো। খোকাবাবুর ঘুম ভাঙানো, ভয় না পেলে, ভয় দেখাবে কাকে?" 
মুখ্যমন্ত্রী এবং প্রথম সারির আমলাদের সামনে জুনিয়র ডাক্তারদের যে শান্ত অথচ দৃঢ় বক্তব্য গোটা রাজ্যের মানুষ শুনলেন, মুখ্যমন্ত্রীর ' হ্যাঁ' তে ' হ্যাঁ' না মেলানো, মুখ্যমন্ত্রীর ' না ' তে ' না' বলে শীবাকীর্তনে দোহার না দেওয়া— এমনটা গত তের বছরে এই রাজ্যের মানুষ বিশেষ দেখেনি। কামদুনিতে মৌসুমী কয়ালদের সঙ্গে তেড়ে  ঝগড়া হয়েছিল মুখ্যমন্ত্রীর। প্রতিবাদী মুখ হয়ে উঠেছিলেন টুম্পা এবং মৌসুমী। কিন্তু সেই প্রতিবাদের ধারাবাহিকতা সাধারণ মানুষদের মধ্যে তখনই এতটা শাসক বিতৃষ্ণা জাগাতে পারেনি।  
যেভাবে মুখ্যমন্ত্রীর সামনে তাঁর প্রশাসনের বেআব্রু অবস্থাটা প্রকাশ্যে এসেছে, তাতে আমাদের প্রগলভ মুখ্যমন্ত্রীরও বাচালতার সুযোগ মেলেনি। ডাক্তারি পরীক্ষার খাতা দেখা ঘিরে কারচুপি, স্বর্ণ পদক পাওয়াদের মুখোশটা, যারা দশ নম্বরও পাওয়ার যোগ্য নয়, এই নবীন ডাক্তারবাবুরা এভাবে খোদ মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্য মন্ত্রীর সামনে খুলে না দিলে, সাধারণ মানুষ ভাবতেন , এসব রাজনৈতিক দলের শাসক বিরোধী প্রচার। কেউ বিশ্বাস করতেন। কেউ বা বিরোধীদের কুৎসা বলে এড়িয়ে গিয়ে মুখ লুকোতে চেষ্টা করতেন। যাদের পরীক্ষায় দশ নম্বর পাওয়ার যোগ্যতা নেই, তারা পেয়ে বসে আছে স্বর্ণপদক— মুখ্যমন্ত্রী, মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্র সচিবের সামনে, লাইভ স্ক্রিনিং চলাকালীন দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এই কথা যখন  আমরা শুনতে পাই, তখন যতই বাঁধা দেবার চেষ্টা মুখ্যমন্ত্রী করে থাকুন না কেন, তাঁর অসহায় বডি ল্যাঙ্গুয়েজ কিন্তু রাজ্যবাসীর চোখ এড়ায়নি। মুখ্যমন্ত্রী মমতার এসব যে অজানা, তেমনটা ভাবা উচিত নয়। তিনি হিটলার-মুসোলিনীর যোগ্য শিষ্যা। কিন্তু কেউ এভাবে তাঁর সামনে হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেবে এতটা সম্ভবত তিনিও ভাবেননি।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা গত তের বছরের থেকে কিছু বেশি সময় ক্ষমতায় আছেন। এই গোটা সময়কালে বিধানসভার ভেতরে বা বাইরে, সাংবাদিক সন্মেলনে, কোনোরকম রাজনৈতিক সভায় বা তাঁর বহু বিজ্ঞাপিত প্রশাসনিক সভা, কোথাও সত্যিকারের প্রশ্ন বরদাস্ত করতে পারেন না। প্রশ্নের আকারে স্তুতি মুখ্যমন্ত্রীর খুবই পছন্দের বিষয়। তেমন স্তুতিবাচক প্রশ্ন এলে তিনি প্রগলভ হয়ে ওঠেন।তাঁর কণ্ঠস্বর, বডি ল্যাঙ্গোয়েজেও তখন একেবারে বিগলিত করুণা। 
কিন্তু তাঁর অপছন্দের প্রশ্ন, কিংবা সেরকম প্রসঙ্গ এসব তাঁর সামনে উচ্চারিত হলে কি হয়, তা আমরা সারের দাম ঘিরে জিজ্ঞাসু এক নাগরিকের প্রশ্ন থেকে, বিমানবন্দরে সাংবাদিকের প্রতি আচরণ অথবা এক ছাত্রীর সাধারণ প্রশ্নের পর মুখ্যমন্ত্রীর উদ্ধত কক্ষত্যাগ, এসব আমরা বহু বহুবার দেখেছি। কিন্তু নবীন ডাক্তারবাবুদের সঙ্গে নবান্নের বৈঠকে দেখলাম কিছুটা ভীত এবং সংযত থাকবার অভিনয় করে যাওয়া মুখ্যমন্ত্রীকে।ওই বৈঠকের লাইভ স্ক্রিনিং না হলে মুখ্যমন্ত্রীর আচরণ কি হতো তা নিয়ে গবেষণা না করে এটাই বলা যায় যে, সরাসরি সম্প্রচারের বালাই, অনেক বড় বালাই। তাইই মুখ্যমন্ত্রীর কিছুটা স্থিতধী অভিনয়। যদিও তার মধ্যেও মুখ্যমন্ত্রীর প্রগলভতা, আর তার জেরে বৈঠকে হাজির থাকা নবীন এক ডাক্তারের উক্তি, তাঁদের বলতে না দেওয়া ঘিরে বিরক্তি— এসব আমরা শুনেছি সেই লাইভ স্ক্রিনিংয়ের জেরেই।
ভয়ের সংক্রমণের মতই সাহসের যে সংক্রমণও এরাজ্য দেখলো, দেখলো উত্তাল জনঅন্দোলনের ক্রমসম্প্রসারিত রূপ। পরিচিত রাজনীতির গন্ডির বাইরে এক জনজাগরণের ছবি হয়ে দাঁড়ালো পশ্চিমবঙ্গ। এই বিষয়টিই কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মমতার কাছে এখন সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যতদিন যাবে , এই চ্যালেঞ্জ মুখ্যমন্ত্রী মমতা এবং যাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে আরও শক্ত হয়ে চেপে বসবে।
মুখ্যমন্ত্রী হয়েই মমতা, সিপিআই (এম) সহ সমস্ত বিরোধীদের মুখে সেলোটেপ আটকে রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন। বিরোধী কণ্ঠরুদ্ধ করবার এই ফ্যাসিবাদী প্রবণতা আজ কি প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে সাধারণ মানুষদের মধ্যে গোটা অভয়া পর্ব, অবস্থান, অনশন, জয়নগর, কৃষ্ণনগর এগুলির ভিতর দিয়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি।                    
যে মানুষ আজ পথে, তাদের অনেককে এতোদিন শাসক শিবির উপঢৌকনের লোভ দেখিয়ে, মিথ্যে কথা বলে, নিজেদের তাঁবেদার করে রেখেছিল। ভেবেছিল এমনটাই থেকে যাবে চিরকাল। নানা সরকারি প্রকল্প, যেগুলোকে কার্যত ব্যক্তি মমতার প্রকল্প বলে সাধারণ মানুষকে ভুল বুঝিয়ে আসছে গোটা শাসক শিবির এবং প্রশাসন, প্রতিবাদী হলে সেসব বন্ধ হয়ে যাবে, এই শাসকের হুমকি এখন আর গ্রাহ্য করছে না শহরও নয়, গ্রামও নয়।
নির্বাচন এলেই, ভোটে প্রচারে তৃণমূল বলে বেড়িয়েছে, বামপন্থীরা জিতলে যাবতীয় সরকারি প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাবে। বামপন্থীরা দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছে, একটিও সরকারি প্রকল্প বাতিল হবে না। বরং সেই প্রকল্পগুলিকে বামেরা আরও স্বচ্ছ করবে, জনমুখী করবে এবং সেগুলি বণ্টনের ক্ষেত্রে কখনো  দলীয় পক্ষপাতিত্ব থাকবে না।
তৃণমূলের অপপ্রচারের জবাবে বামেদের বক্তব্য  বরাবরই গোদি মিডিয়া কার্যত ব্ল্যাক আউট করেছে। আজ কিন্তু অভয়ার বিচারের দাবিতে জনতার আন্দোলন এবং জুনিয়র ডাক্তারবাবুদের অদম্য জেদ আর রাজ্য সরকারের সঙ্গে বৈঠকের লাইভ স্ক্রিনিং দেখা— এরপর সদর তো বটেই, মফস্বলেও প্রান্তিক মানুষ, অর্থনৈতিকভাবে কমজোরি মানুষ, বিশেষ করে নারী সমাজকে এখন নতুন করে ভাবতে শেখাচ্ছে। এই ভাবনা সাধারণ মানুষদের ভিতরে ক্রমেই সংক্রামক হয়ে পড়তেও শুরু করেছে। আর সেই কারণেই এখন শাসকেরও ঘুম ছুটেছে। মুখ্যমন্ত্রী যেভাবে ' অভিযুক্ত' শব্দ ঘিরে যা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, যে ভূমিকায় তাঁকে দেখা গেছে, তাতেই সাধারণ মানুষ বুঝে গিয়েছেন, তিনি কার পক্ষে? অভিযুক্তের? না, নির্যাতিতদের। এই বুঝে যাওয়া বিষয়টাতেই এখন সবথেকে বেশি ভয়, আতঙ্ক শাসকের। তাই তাঁরা এখন সব অভিযুক্তদেরই জড়ো করে পালটা সংগঠন গড়েছেন নিজেদের আড়ালে রেখে।
কারা আছেন এই সংগঠনে? আছেন তারাই যাদের নাম ' হুমকি সংস্কৃতি' র সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। এই লোকেদেরই অনেকের কথা নবান্নের বৈঠকে উঠেছিল।এদের কাউকে ' অভিযুক্ত' পর্যন্ত বলতে নারাজ ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তাদের নিয়েই যে পালটা সংগঠন তৈরি হয়েছে, তাতে মুখ্যমন্ত্রীর পৃষ্ঠপোষকতা নেই এমনটা মনে করবার কোনও কারণ নেই।
বিরোধী কণ্ঠস্বরকে হিটলারি কায়দায় রুদ্ধ করে দেওয়ার এখন সহজ হবে না। শাসক এটা অনুমান করতে পারছে। আর সেটা পারছে বলেই সঙ্ঘ- বিজেপি’র থেকে শেখা কায়দায় শারদোৎসবের শেষ লগ্নে হাওড়ার শ্যামপুর থেকে কলকাতা লাগোয়া দক্ষিণ প্রান্তে সাম্প্রদায়িকতার বিষ তাস খেলবার আপ্রাণ চেষ্টা তারা করেছিল। কিন্তু সাধারণ মানুষ এখন শাসকের এই চিরকেলে খেলা ধরে ফেলছে। শাসকের সঙ্কট এখানেও।

 

 

 

Comments :0

Login to leave a comment