প্রতীম দে
‘‘আমরা চাই শাহজাহান, শিবু হাজরা, উত্তম সরদারদের শাস্তি।’’ এটাই দাবি সন্দেশখালির সাধারণ গ্রামবাসীদের। কিন্তু গ্রামবাসীদের দুঃখ, কষ্ট বুঝতে আসা বিভিন্ন জাতীয় কমিশনের প্রতিনিধিরা কি রিপোর্ট দিচ্ছে ? রাষ্ট্রপতি শাসনের। কিন্তু শাহজাহানকে গ্রেপ্তার করার বিষয় প্রশাসনের ওপর কোন চাপ দেওয়া হচ্ছে না। গোটা বিষয়টিকে অন্যদিকে পরিচালিত করার চেষ্টা চলছে প্রতিনিয়ত।
এই রাষ্ট্রপতি শাসনের কথা বার বার সন্দেশখালি ঘটনা ঘটার অনেক আগে থেকে শোনা গিয়েছে বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারির মুখে। রাজভবনে রাজ্যপাল সিভি আনন্দবোসের পাশে বসে জাতীয় মহিলা কমিশনের চেয়ারম্যান রেখা শর্মা বলেন, রাজ্যের রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হওয়া দরকার।
১৫ ফেব্রুয়ারি সন্দেশখালি আসে জাতীয় এসসি এসটি কমিশন। গ্রামবাসীদের সাথে কথা বলার পর রাষ্ট্রপতির কাছে যেই রিপোর্ট কমিশনের পক্ষ থেকে জমা করা হয় ১৬ ফেব্রুয়ারি তাতে বলা হয় যে, রাজ্য সরকার সন্দেশখালি তফশিলি জাতি এবং উপজাতির মানুষদের নিরাপত্তা দিতে ব্যার্থ। তাই রাজ্য রাষ্ট্রপতি শাসনে প্রয়োজন।
কোন আইনের ভিত্তিতে এই কথা বললেন কমিশনের চেয়ারম্যান অরুন হালদার?
তার কথায়, সংবিধানের ৩৩৮ ধারায় বলা আছে কোন রাজ্য সরকার যদি তার রাজ্যের অফশিলি জাতি এবং উপজাতির মানুষদের নিরাপত্তা দিতে না পারে তাহলে রাষ্ট্রপতি চাইলে সেখানে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করতে পারে। কমিশনের দাবি সন্দেশখালিতে যেহেতু বেশিরভাগ মানুষ অফশিলি জাতির তাই সেখানে লঙ্ঘিত হয়েছে ৩৩৮ ধারা।
সন্দেশখালির মহিলাদের নির্যাতনের ঘটনা যখন প্রথম সামনে আসে তখন বিজেপি বলে, হিন্দু মহিলাদের সম্মানহানি করছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পুরুষেরা। মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী বলেন, এই ঝামেলা আদিবাসীর এবং সংখ্যালঘুদের মধ্যে। তৃণমূল মানুষের জমি লুঠ করেছে আত্যচার করেছে তার বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ। সেই বিষয়টিকে আড়াল করতে সাম্প্রদায়িক বিভাজন শুরু করে বিজেপি এবং তৃণমূল। আর দুই রাজনৈতিক দলের ভাগাভাগির পেসক্রিপশন মেনে রাষ্ট্রপতির কাছে রিপোর্ট জমা করলো তফশিলি জাতি এবং উপজাতি কমিশন।
এরপর এলো জাতীয় মহিলা কমিশন। ১৯ ফেব্রুয়ারি। সন্দেশখালি ঘুরে রাজভবনে গিয়ে রাজ্যপালকে পাশে বসিয়ে জাতীয় মহিলা কমিশনের চেয়ারম্যান রেখা শর্মা বলেন, ‘‘১৮টি অভিযোগ পেয়েছি। গ্রামের মানুষ পুলিশের ওপর কোন আস্থা, ভরসা রাখতে পারছে না। মহিলাদের ওপর দিনের পর দিন অত্যাচার হয়েছে। রাষ্ট্রপতি শাসন ছাড়া আর কোন উপায় নেই।’’ রেখা অবশ্য সংবিধানের কোন ধারা দেখায়নি তার এই কথার ভিত্তিতে।
৫০ দিন পার এখনও অধরা শেখ শাহজাহান। গ্রামবাসীদের আন্দোলনের চাপে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তার দুই সঙ্গী শিবু হাজরা এবং উত্তম সরদার। গনধর্ষন সহ একাধিক ধারায় তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
গ্রামবাসীদের অভিযোগ তাদের জমি দখল করেছে শাহজাহান এবং তার ভাই সিরাজের বাহিনী। জমি দখল করে ভেড়ি তৈরি করা হয়েছে। লিজের টাকা চাইতে গেলে তাদের কোদালের বাঁট দিয়ে মারধর করা হয়েছে। রাতের অন্ধকারে তৃণমূল পার্টির অফিসে বাড়ি থেকে মহিলাদের তুলে নিয়ে গিয়েছে উত্তম, শিবুরা।
ন্যাজাট থানার সামনে বিক্ষোভ চলাকালিন একজন মহিলা সংবাদমাধ্যমের সামনে বলে, ‘‘আমাদের একটাই দাবি শাহজাহানকে কোমড়ে দড়ি পড়িয়ে থানায় নিয়ে যেতে হবে। ওটায় আমাদের শান্তি।’’
সন্দেশখালির মানুষের দাবি তো সঠিক। যে তাদের ওপর দিনের পর দিন অত্যাচার করেছে তার বিচার তারা চেয়েছে। তারা তো কখনও রাষ্ট্রপতি শাসন চায়নি। কিন্তু জাতীয় কমিশন গুলোর রিপোর্টে কোথাও তো বলা হচ্ছে তাদের বিচারের কথা। কোথাও তো শাহজাহানের গ্রেপ্তারির প্রসঙ্গে ইডি এবং রাজ্য পুলিশের ভূমিকার কোন নিন্দা করা হচ্ছে না।
৫ জানুয়ারি ইডি শাহজাহানের বাড়ি আসে রেশন দুর্নীতি মামলার তদন্তে। সেখান থেকে যাবতীয় ঘটনার সূত্রপাত। সেদিন হামলা করা হয় কেন্দ্রীয় তদন্তকারি সংস্থার আদিকারিকদের ওপর এবং সংবাদমাধ্যমের ওপর। তারপর থেকে ফেরার শাহজাহান। ইডি সেই ঘটনার ১৯ দিন পর গেলেন শেখ শাহজাহানের বাড়ি। নোটিশ দিয়ে এলেন হাজিরা দেওয়ার। কে কার কথা শোনে, শাহজাহান হাজিরা দেয়নি। ২৯ ফেব্রুয়ারি তৃতীয় বার তাকে হাজিরা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে ইডি। দেবেন কি না কেউ জানে না।
প্রশ্ন উঠেছে যেই শাহজাহান আইনজীবী মারফত আদালতে জামিনের আবেদন করছে তাকে ধরতে পারছে না রাজ্য পুলিশ এবং ইডি। শাহজাহান পুলিশের আশ্রয় আছেন এই কথা বার বার বলেছেন সন্দেশখালির প্রাক্তন বিধায়ক নিরাপদ সরদার। তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যেতে পারে তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বের কথা মতো তাকে পুলিশ ধরবে না।
কিন্তু ইডি কি করছে?
এই ইডি রাতের অন্ধকারে ঝাড়খন্ডের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোড়েনকে গ্রেপ্তার করেছে সম্প্রতি। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী চিদমবরমের বাড়ির পাঁচিল টোপকে ইডি ঢুকে তাকে গ্রেপ্তার করে। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়াল হাজিরা এড়ানোর জন্য তার বিরুদ্ধে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে ইডি। কিন্তু যেই শাহজাহান আদালতনামায় সি করছে তাকে তারা ধরতে পারছে না!
সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের কথায়, ‘‘যেই ইডি পাঁচিল টোপকে চিমববরমের বাড়ি যেতে পারে। হেমন্ত সোড়েনকে গ্রেপ্তার করতে পারে তারা কে কোথাকার শাহজাহানকে ধরতে পারছে না? এটা বিশ্বাস করতে হবে। আসলে পুরটাই দিদি মোদীর সেটিং।’’
সত্যি তো প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, একটা কেন্দ্রীয় তদন্তকারি সংস্থা শেখ শাহজাহানকে খুঁজে বার করতে পারছে না ৫০ দিন ধরে!
Comments :0