Post editorial

হিন্দু ঐক্য আর দুধ দেওয়া গোরুর লাথি হজমের রাজনীতি

উত্তর সম্পাদকীয়​

তন্ময় ভট্টাচার্য


এসআইআর অতিক্রম করেছে তিন ভাগের দু'ভাগ সময়। সত্তর শতাংশ ফর্ম বিলি হয়েছে। এতেও গলদঘর্ম বিএলও-রা ফর্ম জমা নিতে বাড়ি বাড়ি যাওয়া বন্ধ করে তৃণমূলের ঠিক করে দেওয়া জায়গায় বসে ফর্ম জমা নেওয়ার কাজ শুরু করেছেন অনেক জায়গায়। এসআইআর নিয়ে অত্যুৎসাহী বিজেপি সিনে নেই বললেই চলে। কেন? অমিত শাহ বা জ্ঞানেশ কুমার কি তাদের বলে দিয়েছেন, যে নামগুলো বাদ দিতে হবে তার তালিকা দিতে। খগেন মুর্মু, শঙ্কর ঘোষ, রাজু বিস্তার গাড়িতে আক্রমণের  চাপান-উতোর চলতে চলতেই কেমন যেন সংঘাতের উত্তেজনার পারদ না নামতে দেওয়ানোর জন্যই খোদ বিরোধী দলনেতা, ভবানীপুরে মমতা ব্যানার্জির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আহ্বান জানানো শুভেন্দু অধিকারীর কনভয় ঘিরে বিক্ষোভের নামে হামলার ঘটনা ঘটে গেল। এগুলো কি ভোটের আগে বিরোধী কণ্ঠরোধের প্রয়াস নাকি বাংলার রাজনীতিতে তথা ২০২৬-এ বিধানসভার আসন্ন নির্বাচনে তৃণমূল-বিজেপি ছাড়া আর কারও কোনও অস্তিত্ব নেই, এটা বোঝানোর যার পর নাই মরিয়া অপপ্রয়াস। প্রশ্নটা তুলতে হচ্ছে এই কারণে যে এরকম একটা মারাত্মক, শুভেন্দু অধিকারীর কথায় 'প্রাণঘাতী' হামলার পরেও 'বদলা'র দাবিতে যে প্রতিক্রিয়া দেখা গেল তা তৃণমূলের গুন্ডারাজের বিরুদ্ধে যতটা না সরব হলো তার চাইতে অনেক বেশি আকুতিময় হয়ে গেল, 'তৃণমূলের হিন্দু, সিপিআই(এম)’র হিন্দু'দের এক হওয়ার আবেদনে। বিধানসভার বিরোধী দলনেতা মানে 'শ্যাডো চিফ মিনিস্টার' বা ছায়া মুখ্যমন্ত্রী। তার উপরে প্রাণঘাতী হামলায় দেশ শাসক দলের এত মৃদু প্রতিক্রিয়া বাতাসে কিছুটা সন্দেহের গন্ধ ছড়াচ্ছে বলেই তো আমাদের ঘরপোড়া গোরুর দলকে বাইনারি নির্মাণ প্রয়াসে শেষ বিধানসভা নির্বাচনের মতো  সিঁদুরে মেঘের ওড়া উড়ি দেখতে হচ্ছে। অন্তত বিজেপি’র রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্যের এই ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে বলা 'আমরা প্রতিটি নাগরিক ও হিন্দুর নিরাপত্তার জন্য লড়ব' ঘোষণায় আলাদা করে 'হিন্দু' শব্দের ব্যবহার তো প্রয়োজন ছিল না। প্রতিটি 'নাগরিক' শব্দবন্ধেই তো তার যথেষ্ট প্রকাশ ঘটে যায়।
পাঠক, খেয়ালে রাখবেন, এসআইআর’র মতো একটি স্বাভাবিক নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে রাজ্য এবং দেশের শাসক দল কেমন একটা যুদ্ধের বিষয়ে পরিণত করে ফেলেছে। আর তার সাথে এ রাজ্যের বিজেপি’র বাড়তি ঘোষণা, রাজ্য জুড়ে সাতশো সিএএ সহায়তা ক্যাম্প তৈরির। আমার ঠাকুমা বলতেন, কাকের ডাকে নাকি অমঙ্গল আছে। সিএএ’র কথা যখন প্রথম এসেছিল তখন মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে তার দল 'ক্যা ক্যা ছি: ছি:' স্লোগান দিয়ে মিছিলও করেছিলেন। পরে আবার ঘুরপথে এনপিআর’র রাস্তা পরিষ্কারও করে দিয়েছেন। নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে যে রাজ্যগুলোতে এসআইআর হচ্ছে তার মধ্যে সবচাইতে ভালো প্রস্তুতি পশ্চিমবঙ্গের। এখন সাতশোটি জায়গা থেকে ‘ক্যা ক্যা’ আওয়াজ আসবে জেনেও সুপ্রিমো ‘রা’ কাড়েননি। 
মঙ্গোলিয়ান প্রাধান্য সম্পন্ন, ককেশিয়ান এবং দ্রাবিড়িয়ান এথনিক গ্রুপ ভুক্ত বাংলার সাড়ে দশ কোটি মানুষ সাতটি প্রধান ধর্মের অনুসারী। গোটা দেশেই তাই। এই মানুষগুলো একটাই ভারতীয় পরিচয় নিয়ে একশো বাইশটা ভাষায় নিজেদের মধ্যে কথা বলে, মত প্রকাশ করে, বিরোধ করে; যে অধিকার তাদের দিয়েছে এই ভারতের সংবিধান, এই ভারতের জাতীয় পতাকা। এই পরিচয় ছাড়া বাকি অন্য কোনও পরিচয়ই এই মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য না। ছিলও না, হবেও না।
সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন চাপিয়ে দিয়ে ধর্মের ভিত্তিতে মানুষকে ভাগ করে এককে অপরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়া আসলে শাহেনশাহের শ্মশ্রু গুম্ফ শোভিত মুচকি হাসির বক্রতায় মোদীর সুতোর লাটাই বাতাসের টানে খুলে দেওয়া, যা ভোট মেরুকরণের সুখস্বপ্নে বিভোর। লাভের গুড়ে পিঁপড়ের ভাগ বসানোর জন্যই ইডি, সিবিআই বোঝাপড়ার দরজা তো খোলা আছেই। সেফেস্ট শহর কলকাতায় গুলশান কলোনি খবর হয়, পুলিশের কাছে তার আগাম খবর থাকে না অথবা আগামী গুড়ের লোভে প্রচ্ছন্ন দূরত্বের নির্দেশ কার্যকর হয়। দুর্গাপুর কিংবা তমলুক, উলুবেড়িয়ায় নারীত্ব অসম্মানিত হলে মুখ্যমন্ত্রীর সোশাল মিডিয়া ভরে ওঠে সেই মাতৃশক্তির আরাধনায় যার সাধনাকে রামপ্রসাদ সেন বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতীক হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন। 
দেশের ধর্মনিরপেক্ষ জাগ্রত বিবেককে রাস্তায় নামতে হবে হিন্দুত্ববাদীদের মনুবাদী ভারত গড়ার শয়তানির জাল ছিঁড়ে সব মানুষের ঐক্যবদ্ধতার পুনর্নির্মাণ। এখনো কিছু মানুষ এক বোকা বোকা আপাত সরল প্রশ্নে মানুষকে ভোলাতে চান যে, পাকিস্তান মুসলিম রাষ্ট্র হলে ভারত কেন হিন্দু রাষ্ট্র হবে না। তারা তুরস্ক দেখেন না, নেপালের এত বড় জেন-জেড আন্দোলনও দেখেন না, আমেরিকার নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচনের ফল জানেন না, কুড়ি বছর বয়সি কমিউনিস্ট ছাত্রীর বিজয় দেখেন না, যা দুর্নীতি এবং অপশাসনের বিরুদ্ধে সরব হলেও ধর্মের কথা মুখেও আনেনি । তারা জানেন না বা জেনেও গোপন রাখেন যে পৃথিবীতে বাইশটা ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠতা সম্পন্ন দেশ আছে যাদের ঘোষিত নীতি ধর্মনিরপেক্ষতা আর এদেশে দ্বিজাতিতত্ত্ব প্রথম প্রচারিত হয়েছিল ১৯২৩-এ দামোদর বিনায়ক সাভারকার নামক ব্রিটিশরাজের কাছে মুচলেকা দিয়ে ছ'টা চিঠি লেখা নায়কের লেখনীতে, যার কাউন্টার পার্ট ১৯৩৫-এর মহম্মদ আলি জিন্না। ১৯২৫-এ আরএসএস’র জন্মের আগে এ দেশে কোনও ধর্মীয় দাঙ্গার ইতিহাস নেই। আজ এই সাভারকারকে নিয়ে বিজেপি’র উচ্ছ্বাসের মাঝে একথা যেন কেউ ভুলে না যাই যে ভারত ধর্মনিরপেক্ষ হয়েছে দেশে অনেক ধর্মের মানুষ বা হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য না, দেশে একজন মুসলমানও না থাকলেও এ দেশ ধর্মনিরপেক্ষই হতো, কারণ ধর্মনিরপেক্ষতা মানে আধুনিকতা, অগ্রসরমানতা, কাজ ও চিন্তার প্রগতিশীলতা। ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভারতবাসী বনাম হিন্দুত্ববাদের নামে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী শক্তি অথবা একই ব্রাকেটে আলোচ্য যোগ্য উগ্র ঐস্লামিক সন্ত্রাসবাদীদের, উর্দুকে মেজরিটির ভাষা হিসাবে দেখার স্বপ্ন দ্রষ্টাদের লড়াই তাই এ দেশে থামার নয়। আপাতত যতদিন না পর্যন্ত দেশের সরকারে থাকা উগ্র জাতীয়তাবাদী, একবগ্গা রাষ্ট্রবাদী, একনায়কধর্মী স্বৈরাচারী শক্তিকে কোণঠাসা করার সাথে সাথে রাজ্যে গণতন্ত্রকে জলাঞ্জলি দেওয়া, দুর্নীতির নিত্যনতুন ফর্ম আবিষ্কারে রেকর্ড সৃষ্টি করা দল ও সরকারের সংখ্যালঘুদের দুধ দেওয়া ও সহনীয় লাথির ভোটব্যাঙ্ক হিসাবে ব্যবহারের কৌশল নির্মাণে সদা ব্যস্তদের এটা বুঝিয়ে দেওয়া পর্যন্ত যে, রাজনীতি মানে নীতির রাজা যা অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসা-কর্মসংস্থানের সমস্যা নিরসনের নীতি খুঁজবে। ধর্মের নামে ফ্যানাটিজম তৈরি করবে না। ধর্মীয় কুসংস্কার আর যুক্তিহীন কু-আচার সর্বস্বতার মধ্যে মানুষকে ডুবিয়ে রেখে বাহাদুরি প্রমাণের শক্তি আসলে মানুষকে ধর্মানুশাসনের জালে বন্দি করে ধর্ম বিশ্বাস এবং ধর্ম ভীতিকে ব্যবহার করে ধর্মকে রাজনীতির শিকারে পরিণত করে ক্ষমতা ভোগ করতে চায়। ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের বাস্তবতাকে ধামাচাপা দেয় ধর্মের দোহাই দিয়ে ধর্মের নামে সংঘাতে মানুষকে ব্যস্ত রেখে। 
কেন্দ্র এবং রাজ্যের শাসকের প্রতিশ্রুতি ছিল দেশ থেকে দুর্নীতি কেলেঙ্কারি দূর করার। একজন দু'কোটি আর অন্যজন এক কোটি বেকার ছেলেমেয়ের কাজের ব্যবস্থা করবে বলেছিল। কালো টাকা দেশে ফিরিয়ে মানুষের মধ্যে ভাগ করে দেবে। কৃষকের আয় তিন গুণ করবে। আর্থিক বৃদ্ধি দশ শতাংশ ছোঁবে, মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রিত হবে, উন্নয়নের জোয়ারে দেশ, রাজ্য ভেসে যাবে। ‘মেক ইন্ডিয়া’র মন্ত্রে দেশ উৎপাদন শিল্পের বিশ্ব কেন্দ্রে আর রাজ্য তেনার শিল্পায়িত ব্রেনের বাহাদুরিতে বিশ্ব বাংলায় পরিণত হবে। কালো টাকা, সন্ত্রাসবাদ নির্মূল হবে। এগুলো সব পারমানেন্ট ফিউচার টেন্স বা চিরকালীন ভবিষ্যৎ কাল হয়ে দেশ এবং রাজ্যবাসীর দিকে হায়নার ব্যঙ্গ হাসি ছড়িয়ে দিচ্ছে। আর দেশজুড়ে বিস্ফোরণ ঘটছে বেকারির। কমছে উৎপাদন, ভোগ, রপ্তানি, রোজগার। বাড়ছে শত কোটিপতির সংখ্যা অথচ বাজারে চাহিদা নেই, শিল্পে বিনিয়োগ নেই। আছে শুধু বিপর্যয়ের বিপন্নতা। 
দু'টো সরকারই প্রমাণ করে দিয়েছে অর্থনীতি পরিচালনা তাদের যোগ্যতার মধ্যে নেই। উন্নয়ন, বিকাশের রাস্তা তাদের অচেনা। বৈষয়িক ও চিন্তা চেতনার উন্নতি তাদের কাজ না। এমনকি কোনও দেশ থেকে কি আমদানি করা হবে তা-ও আজ আমেরিকা ঠিক করে দেয়। এই অবস্থায় ক্ষমতার শীর্ষে থাকতে হলে মিথ্যা আর বিভ্রান্তি একমাত্র আশ্রয়। তাই সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ গবেষণা করবে রামায়ণের পুস্পক রথ নির্মাণ কৌশলের। ইতিহাস, বিজ্ঞান এর শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোর দখল তুলে দেওয়া হবে বিজ্ঞান বিরোধী অন্ধবিশ্বাসীদের হাতে। দেশের রাজনীতির বিবেচ্য বিষয় হবে আওরঙ্গজেবের সমাধি, কাশী বিশ্বনাথের মন্দির কিংবা রাজারহাটের দুর্গাঙ্গন অথবা শিলিগুড়ির মহাকাল। বাস্তবতা আড়াল করাই যেখানে রাজনীতির প্রধান অঙ্গ সেখানে ধর্ম, সম্প্রদায় আর ঘৃণাই তো উপজীব্য হবে। তাতে পুলওয়ামার তদন্ত রিপোর্ট মুখ দেখানোর আগেই পহেলগাঁও ঘটবে, অপারেশন সিঁদুরকে ব্যঙ্গ করে নাকি বিহার ভোটের আগে প্ল্যান করে লালকেল্লা জ্বলবে, ছাব্বিশ হাজারের লজ্জাকে মোছার আগেই পরীক্ষার ফল আর একবার হতাশার জন্ম দেবে, টেটের বত্রিশ  হাজার যতই উদ্বেগ বুকে নিয়ে ঘুরুক না, এনআরসি, এসআইআর, জেল আর জামিনের সার্কাস দেখতে ব্যস্ত মানুষ ভাতের, শিক্ষার, কাজের, চিকিৎসার, গণতন্ত্রের দাবি করার সময় পাবে না। এসআইআর করবই, একটাও ঘুষপেটিয়ার নাম ভোটার তালিকায় থাকবে না আর কোনও ভোটারের নামই বাদ দিতে দেব না, বাদ দিলে বাংলায় আগুন জ্বালিয়ে দেব বলনে ওয়ালারা তিন মাসে জিনিসপত্রের দাম কমবে বা তিনটে কারখানা হবে বলতে পারেন না, সে মুরোদ বা যোগ্যতা তাদের নেই। ধর্ম বেচে রাজনীতি করা পেশাজীবিদের কাছে এটাই স্বাভাবিক। অতএব, ভোট যত এগবে ততই হামলা আর বদলার কথা জনগণকে শুনতে হবেই।

Comments :0

Login to leave a comment