EDITORIAL

ঋণ কেন আকণ্ঠ

সম্পাদকীয় বিভাগ

বিপুল দেনায় জর্জরিত কর্পোরেট সংস্থাগুলি যখন ব্যাঙ্ক থেকে নেওয়া ঋণ শোধ না করে হাত গুটিয়ে বসে থাকে অথবা কেউ কেউ ঋণের টাকা নিয়ে বিদেশে পালিয়ে যায় তখন কর্পোরেট বান্ধব মোদী সরকার সেইসব বকেয়া ঋণ মকুব করে দিয়ে কর্পোরেট মালিকদের দায় মুক্ত করে। কিন্তু কর্পোরেট সেবার অঙ্গ হিসাবে কর্পোরেট ঋণ মকুবের বোঝা যখন খোদ সরকারের ঋণের বোঝা বাড়িয়ে দেয় তখন কিন্তু কোনও কর্পোরেট সরকারের ঋণের বোঝা লাঘবের জন্য পাশে এসে পড়ে না। বরং সুযোগ বুঝে সরকারের কাছ থেকে আরও বেশি সুবিধা আদায়ের সু‍‌যোগ খোঁজে।
কেন্দ্রীয় শাসক দল দেশের অর্থনীতি নিয়ে প্রচারের ধারাকে উচ্চ কোটিতে পৌঁছে দিয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি হারে বাড়ছে ভারতের অর্থনীতি। পাঁচ বছরের মধ্যে নাকি পাঁচ ট্রিলিয়ন অর্থনীতি অর্থাৎ বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হবে। ২৩ বছরের মধ্যে হবে আমেরিকার মতো উন্নত অর্থনীতি। অর্থনীতির মোট পরিমাণ নিয়ে প্রচারের ঢাক পেটানো হলেও মাথাপিছু আয় নিয়ে কোনও কথা নেই। বেকারি নিয়ে কথা নেই। সাধারণ মানুষের আয় বা মজুরি নিয়েও কথা নেই। অর্থাৎ অর্থনীতির ক্ষতগুলিকে পুরোপুরি আড়াল করে জিডিপি’র সংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে মশগুল হয়ে আছে শাসকরা। এই তথাকথিত দারুণ অর্থনীতির অন্যতম একটি মৌলিক ক্ষত সরকারের ঋণ। জি‍‌ডিপি বৃদ্ধির তুলনায় সরকারি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে অনেক বেশি হারে। ২০২২-’২৩ সালে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলি মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৬.৫ শতাংশ। গত চার দশকের মধ্যে এটা সর্বোচ্চ। প্রসঙ্গত, রাজ্যগুলির ঋণের সীমা কেন্দ্রের অনুমতি সাপেক্ষ। কেন্দ্র যতটা অনুমতি দেয় রাজ্য ততটাই ঋণ নিতে পারে।
কেন্দ্র বা রাজ্য যে কোনও সরকারের আয় অপেক্ষা যদি ব্যয় বেশি হয় তখন বাড়ে কোষাগারীয় ঘাটতি। সেই ঘাটতি সরকার পূরণ করে বাজার থেকে ঋণ নিয়ে। মোদী জমানায় কর্পোরেট সেবা অগ্রাধিকার পাওয়ায় কর্পোরেট কর হার অনেক কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। তেমনি নানা দিক থেকে কর্পোরেটকে সুবিধাদান, কর ছাড়, ঋণমকুব, বিনামূল্যে বিদ্যুৎ, জলের দরে জমি ইত্যাদি দেবার ফলে সরকারের আয় প্রত্যা‍‌শিত হারে বাড়েনি। বর্তমানে কেন্দ্রের কোষাগারীয় ঘাটতি জিডিপি’র ৯.৪%। অথচ আইন অনুযায়ী এটা ৩.৫ শতাংশ হবার কথা। সরকারের ঘাটতি বৃদ্ধির অন্যতম একটি কারণ সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি। অর্থনীতির বৃদ্ধির হার ধরে রাখতে সরকার বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়িয়েছে। আসলে এটাও কর্পোরেট অক্ষমতা বা ব্যর্থতার দায়ভার। মোদীদের দাবি অনুযায়ী অর্থনীতি যদি সত্যি সত্যি দারুণ ভালো অবস্থায়, তবে তো বিনিয়োগও হবার কথা উচ্চমাত্রায়। অর্থনীতির ইতিবাচক ও সম্ভাবনাময় পরিস্থিতিতে দেশি-বিদেশি সংস্থা বিনিয়োগে ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা। বাস্তবে তা হচ্ছে না। বরং অর্থনীতির খারাপ সময়ে যে হারে বিনিয়োগ হতো তার ধারে কাছেও যাচ্ছে না। ২০১১-’১২ সালে বিনিয়োগের হার ছিল জিডিপি ৩৮-৩৯ শতাংশ। ২০২২-’২৩ সালে সেটা কমে ৩২ শতাংশ। মোদীর কর্পোরেট বন্ধুদের বিনিয়োগে প্রবল অনীহা। বেসরকারি বিনিয়োগ একেবারে তলানিতে এসে পৌঁছেছে। অথচ কর্পোরেট মুনাফা কিন্তু অনেক বেড়েছে। কর্পোরেট বিনিয়োগহীন পরিস্থিতিতে সরকারি বিনিয়োগ খানিকটা বেড়েছে। সেটা করতে গিয়ে কোষাগারীয় ঘাটতি আরও বেড়েছে। সেই ঘাটতি পূরণে সরকারকে বাজার থেকে দেদার ঋণ তুলতে হচ্ছে। সরকারের এই ঋণবৃদ্ধি প্রকারান্তরে কর্পোরেট সেবার কারণেই। আদৌ জনস্বার্থে বা সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করতে গিয়ে ঘাটতি বৃদ্ধি বা ঋণবৃদ্ধি নয়।
 

Comments :0

Login to leave a comment