শান্তনু চক্রবর্তী
বৃষ্টি-ভেজা এক সন্ধ্যেবেলায় মোহনবাগান ক্লাব তাঁবুর সামনে জড় হওয়া মাঝারি জমায়েতটার হাতে-হাতে তখন জ্বলে উঠেছে মোমবাতি। আর মুখে-মুখে তৈরি হচ্ছে স্লোগান— ‘‘ডার্বি বাতিল করলে কর/ বিচার চাইছে আর জি কর’’! কখনও রায়-বাড়ি অনুপ্রাণিত সদ্যোজাত ছড়া: ‘‘রানি ভারী ভয় পেল/ ডার্বি বাতিল করে দিল’’! ওই সমাবেশটাই একটু পরেই মিছিলের চেহারায় এগিয়ে গেল ক্লাব হাউসের দিকে। পুরুষ-কণ্ঠে স্লোগান উঠলেও মিছিলের মুখ মূলত: মোহবাগানের মেয়েরাই। মিছিল এগোতে এগোতেই স্লোগানের অভিমুখ বদলাতে থাকে। সেটা আরও রাজনৈতিক তীক্ষ্ণতা পায়। গত বছর অবধি টানা ৮টি ডার্বি জেতার সুবাদে উলটো শিবিরের প্রতি যে মোহনবাগান-জনতার অহঙ্কারি হুঙ্কার ছিল, ‘যতবার ডার্বি, ততবার হারবি’। বদলে যাওয়া ন্যারেটিভে তাঁরাই স্লোগানটাও পালটে নেন : ‘‘যতবার ডার্বি/ স্বৈরাচারী হারবি’’! সময়ের দাবি সময় চাইছে বলেই যে ইস্টবেঙ্গল শিবির কদিন আগেও, ‘শত্রু-ঘাঁটি’ থেকে ভারতীয় দলের তারকা ডিফেন্ডার ‘আনোয়ার আলিকে’ ছিনিয়ে আনার উল্লাসে উৎসব করছিল, তারাই আহ্বান জানায়: ‘বাঙাল-ঘটি এক স্বর/ জাস্টিস ফর আর জি কর।’ মোহনবাগান ফ্যানসে ক্লাবগুলোর তরফেও শোনা গিয়েছিল একই স্বর, একই সুর, চির প্রতিদ্বন্দ্বী দু’টি ক্লাবের প্রতি মুহূর্তে যুযুধান দুই সমর্থক দল যৌথ সিদ্ধান্ত নেন। ১৮ আগস্ট ডুরান্ড ডার্বির দিন স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে প্রিয় দলকে সমর্থনের পাশাপাশি আর জি করের ওই নির্যাতিতা নিহত কন্যাটির পক্ষেও গলা চড়াবন বিচার চাইবেন, তেমনটা হলোনা। ডার্বি বাতিল করলো সরকার ভয়ে। কিন্তু সে দিনই রাস্তায় নেমে এলো ইস্টবেঙ্গলের জ্বলন্ত ‘মশাল’ বা মোহনবাগানের ‘পালতোলা নৌকো’, সঙ্গে মহামেডানের সমর্থকরা। ফুটবল নেমে এলো রাস্তায়, পুলিশ লাঠি উঁচিয়ে ধেয়ে এলো, কিন্তু দমানো গেলোনা। দাবি একটাই ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ বা ‘জাস্টিস ফর আর জি কর’।
মাঠের ৬০-৬৫ হাজার দর্শক যদি ইস্ট-মোহনে ভাগাভাগি হয়ে না থেকে, একসঙ্গে একই কণ্ঠে একটা জঘন্য নারকীয় প্রাতিষ্ঠানিক অপরাধের বিচার চায় আর জনপ্রিয় স্পোর্টস চ্যানেল-ও ম্যাচের সরাসরি সম্প্রচারের সুবাদে সেই প্রতিবাদের ঝলক সারা দেশে বা দেশে-দেশে পৌঁছে যায়, তাহলে তো সরকার ও শাসক দলের মুখ পুড়বেই। ঘটনার অভিঘাতে আগে থেকেই চাপে থাকা সন্ত্রস্ত সরকার তাই পুরোদস্তুর স্বৈরাচারের রাস্তায় চলে গেল। সরকারি ‘খেলা হবে’ দিবসের পরের দিনেই খেলা না হওয়ার ফরমান জারি করে দিল। নানারকম অজুহাত শোনা গেল। প্রথমে বলা হলো, কিছু সমর্থক প্রতিবাদের নামে শান্ত-সুবোধ যুবভারতীকে অশান্ত করতে পারে। ফুটবল ক্রীড়াঙ্গনের সুশীল সংস্কৃতিকে সরকার-বিরোধী ‘রাজনৈতিক’ স্লোগানে ‘কলুষিত’ করতে পারে। কিন্তু এই যুক্তিটা যে যথেষ্ট ধোপে টিকছে না, বরং প্রশাসন-পুলিশের দুর্বলতাই বড্ড চোখে পড়ছে, সেটা বুঝতে পেরেই পুলিশ রক্ষণাত্মক মোড-এ চলে গেল! আধুনিক ডিফেন্সিভ স্টিস্টেম ফর্মেশন ছেড়ে চিরকেলে পাতি ‘বাংলা’ স্টাইলে বল ওড়ানোর খেলায় মাতল! তাদের নতুন মানে আসলে পুরানো অজুহাত হলো, যথেষ্ট সংখ্যক পুলিশ দেওয়া যাবে না। ডুরান্ড কর্তৃপক্ষকে দিয়েও সে কথাই বলিয়ে নেওয়া হলো। কিন্তু তারপরেও যখন দেখা গেল দুই দলের সমর্থকদের জোট কিছুতেই ভাঙা যাচ্ছে না—ম্যাচ না হলেও তাঁরা স্টেডিয়ামের সামনে জড়ো হবেনই— তখনই পুলিশের তরফে বাজারে আনা হলো অদ্ভুত দু’টো সাংঘাতিক বিস্ফোরক অডিও! সেটা কাদের ‘কীর্তি’ যাচাই করা সম্ভব না হলেও, অভিনয়টা যে বেশ কাঁচা আর চিত্রনাট্য-সংলাপে যে ’৯০ দশকের সি-গ্রেড বাংলা দেশি সিনেমার বঙ্গপ্রভাব সেটা চোখ বুজে বলা যায়।
অথচ যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে এমন প্রতিবাদ তো নতুন নয়! ২০২০-তে সি এ এ, এন আর সি নিয়ে সারা ভারত যখন উত্তাল, ‘হম কাগজ নহি দিখায়েঙ্গে’-র দৃপ্ত ঘোষণায় যখন দিল্লির শাহিনবাগ আর কলকাতার পার্ক সার্কাস ময়দান একাকার, জামিয়া মিলিয়ায় মোদী-শাহর পুলিশের নৃশংস হামলার বিরুদ্ধে যখন প্রেসিডেন্সি, যাদবপুরও এককাট্টা তখন কলকাতার ফুটবলা ময়দানও তার শরিক হয়েছিল। যুবভারতীতে আইএসএল’র প্রথম ডার্বিতে ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের টিফো-ও যেন কোনো গেরিলা-কবির নিষিদ্ধ কবিতার লাইন: ‘রক্ত দিয়ে কেনা মাটি, কাগজ দিয়ে নয়’। এখন ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সমর্থক-ভিত্তির সঙ্গে দাঙ্গা-দেশভাগ-স্বাধীনতার ইতিহাস, সীমান্ত-কাঁটাতার, ওপার বাংলায় ফেলে আগে ভিটে মাটির স্মৃতি, এই বাংলায় বহু লড়াই পেরিয়ে তৈরি করা নতুন পরিচিতি, এমনই অনেক উপাদান জড়িয়ে আছে। সেখানে নাগরিকদের নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার ও শাসক দল বিজেপি’র নানারকম প্রশাসনিক টালবাহানা, দু-তিন মুখো নীতি এবং সাম্প্রদায়িক ঘোলা জলে ভোটের রাজনীতির মাছ ধরার চেষ্টা সংখ্যাগরিষ্ঠ ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের সন্দেহ আরও ক্ষোভ বাড়িয়েছিল। নতুন করে উদ্বাস্তু হওয়ার আশংকা জাগিয়েছিল। ফলে তাঁদের প্রতিক্রিয়াটা অনেক বেশি তীব্র ছিল। তথাকথিত ‘এদেশী’ বা ‘ঘটি’ বলে পরিচিত মোহনবাগানীরা ‘দেশ’ হারানোর বেদনা কাকে বলে সেটা প্রত্যক্ষ ভাবে না জানলেও নতুন করে বিপন্ন বোধ করা তাঁদের ‘বাঙাল’ প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রতি সহমর্মীতা দেখিয়েছিলেন। লাল-হলুদ সমর্থকদের মতো অতটা সরব না হলেও, মোহনবাগান গ্যালারিতেও ব্যানার-পোস্টার-প্রতিবাদ দেখা গেছে। আপাতভাবে কোনো রাজনৈতিক লোকসান নেই বুঝতে পেরেও পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলও সেবারে ওই ময়দানী প্রতিবাদে কোনো বাগড়া দিতে যায়নি।
আসলে এটাই হয়ে থাকে। ফুটবলের সঙ্গে শাসকের সম্পর্কটা চিরকালই নানান দ্বান্দ্বিকতা ও স্ববিরোধিতায় ভরপুর। ফুটবলের ‘সফ্ট পাওয়ার’-কে তারা কখনোই উপেক্ষা করতে পারে না। নিজেদের রাজনীতি, ক্ষমতার স্বার্থে তাকে ব্যবহার করে। আবার ফুটবলের সেই শক্তিকেই সে ভয় পায়। বিশ্বাস করতে পারে না। উদ্বেগ-আশঙ্কায় থাকে। সেটা শুধু বাঙালির ফুটবলের ইতিহাসে নয়, বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন সময়েই ঘটে থাকে, ঘটে থেকেছে। এই তো সপ্তদশ শতকেই ‘সিটি’ বনাম ‘ইউনাইটেড’-এর ‘ম্যান ডার্বির’ শহর খোদ ম্যানচেস্টারেই একবার ফুটবল খেলা নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। আজকের অ্যাসোসিয়েশন ফুটবল আসতে তখনও অনেক দেরি। মানুষ নিজের আনন্দে খেলেন। খেলাটা উপভোগ করেন। যত না খেলেন, তারচেয়েও বেশি হই চই করেন। শহরের সম্ভ্রান্ত মানুষজন অভিযোগ করলেন, ‘জঙ্গি’ ফুটবলারদের দৌরাত্ম্যে ঘরবাড়ি বাঁচানোই দায় হয়েছে। বাপে তাড়ানো, মায়ে খেদানো ছেলেপুলেরা যেখানে একটু জায়গা পাচ্ছে ফুটবল নিয়ে মেতে যাচ্ছে। পায়ে পায়ে ছিটকে আসা বড় বড় চামড়ার বলের গুঁতোয় গেরস্তর জানলার একটা কাঁচও আজ আস্ত থাকছে না। সুতরাং খেলা বন্ধ। এই ঘটনারও অনেক বছর আগে। একই রকম ফুটবল অশান্তির কারণেই লন্ডনের মেয়রও তাঁর শহরে এমনই নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। তাঁর আদেশনামার সঙ্গে ৫০০ বছর পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুলিশের বয়ান ভারী মিলে যায়। মেয়র বলেছিলেন, ফুটবল যারা খেলে আজ তাদের ঘিরে যে বিশাল দর্শক হুল্লোড় আর গুঁতোগুঁতি করে, তাদের আসল উদ্দেশ্য শহরের শান্তিভঙ্গ করা। সেটা কিছুতেই বরদাস্ত করা যাবে না। যেন বিধাননগর কমিশনারেটের ডিসি সাংবাদিক সম্মেলন করছেন।
তাও তো এসব ফুটবলের প্রাগঐতিহাসিক যুগের কথা। কিন্তু তখনও ক্ষমতা বা প্রতিষ্ঠান ফুটবলকে বিপজ্জনক মনে করত মনে করুন, কারণ ফুটবলকে ঘিরে বরাবরই অনেক মানুষের জমায়েত আর সেই মানুষদের আবেগের বিস্ফোরণের সম্ভাবনা থেকে যায়। ফুটবলই সেই একমাত্র খেলা, কোনো রাজনৈতিক দাবি আন্দোলন ছাড়াই সে বহু হাজার মানুষের জমায়েত ঘটিয়ে ফেলতে পারে। মাঠে যে ২২জন খেলোয়াড়, একটা মাত্র বলের দখল নিয়ে লড়ছেন, আর গ্যালারিতে যে অনেক হাজার বা লক্ষাধিক মানুষ তাঁদের সমর্থনে গলা ফাটাচ্ছেন একই রকম আবেগ-উত্তেজনা তাঁদের অন্তর্গত রক্তস্রোতে অ্যাডরিনালিনের সাগর-মহাসাগর বইয়ে দিচ্ছে। ফুটবল ঘিরে এই গণ-সমাবেশ, এই আবেগের উদ্দাম, বন্য, উচ্ছ্বলতাকে যারা মামুলি যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারেন না, আমেরিকান কবির মতো তাঁরাই বলবেন , The crowd at the Ball game is moved uniformly by a spirit of uselessness which delights them…”
এই যে ‘‘স্পিরিট অফ ইউজলেসনেস’’ অকারণ পুলক, অনর্থক শিল্প— এটাই তো স্টেডিয়াম ভর্তি ফুটবল দর্শকের চোখে ঘোর। এই ঘোর-নেশা-মোহ-,,,, ফুটবল-পাগল দর্শককে ছুটিয়ে বেড়ায়। প্রিয় দলের ম্যাচের প্রতিটা বিকেল-সন্ধ্যে মাঠ তাঁদের চুম্বকের মতো টানে। এই মাতোয়ারা দর্শক, তাঁদের তীব্র, শ্রদ্ধা আবেগের জন্যই প্রতিটা ফুটবল স্টেডিয়ামই আসল রাজনীতির ভরা আঁতুরঘর। শাসক যাকে এড়িয়ে যেতে পারে না। সে জন্যই ইতালির মুসোলিনী ও তাঁর ফ্যাসিস্ত পার্টি রাজধানী রোমের ফুটবল দল লাজিও’র দখল নেয়। আসলে তারা সেই ফুটবল মাঠের আবেগের দখল নিতে চেয়েছিল আর সে পথেই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মগজের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল ফ্যাসিস্ত মতাদর্শের আধিপত্য। ফ্যাসিবাদের সেই ভূত লাজিও’র উগ্র সমর্থকদের যৌথ স্মৃতি ও অবচেতনে আজও তাড়া করে। তাই গ্যালারিতে ফ্যাসিবাদের পক্ষে রাজনৈতিক স্লোগান তুলতে বা নাৎসিবাদের প্রতীক ‘স্বস্তিকা’ চিহ্ন দেখাতে তাদের গলা বা হাত একটুও কাঁপে না। এমন কি রোমান ডার্বিতে এ এস রোমাকে হারানোর পদে লাজিও’র এক ফুটবলার পাওলো ডি ক্যানিও দর্শকদের অভিনন্দন কুড়োতে এসে নাৎসি কায়দায় ‘স্যালুট’ও করে বসেন। সে জন্য জরিমানা দিলেও একটুও অনুতপ্ত না হয়ে বলে দিতে পারেন— ‘আয়্যাম ও ফ্যাসিস্ত, নট এ রেসিস্ট’। মানে ফুটবলের আবেগকে ভুল রাজনীতির রাস্তায় বইয়ে দেওয়ার দিক আয়োজন।
তবে ফুটবল নিয়ে ফ্যাসিস্ত সামরিক স্বৈরশাসন খেলাটা যেমন সত্যি তেমনই প্রতিরোধের পালটা ভাষাটাও তো এই ফুটবল মাঠ থেকেই শুরু হয়। ডি ক্যানিও যদি মাঠের মধ্যে নাৎসি সেলাম ঠুকতে পারেন, ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগের ফুটবলাররাও খেলা শুরুর আগে সেন্টার সার্কেল হাঁটু মুড়ে বসতে পারেন। ব্রিটেনের রক্ষণশীল দলের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর তাতে ঘোরতর আপত্তি থাকলেও পারেন। সেভাবেই লাজিও দলের ফ্যাসিস্ত আল্ট্রা’র অটসউইচ কনসেন্ট্রেসন ক্যাম্প বা আনা ফ্রাঙ্কের স্মৃতিকে ব্যঙ্গ করে পোস্টার বা ব্যানার আনলে, পালটা পাটকেলটা তাদেরকেও খেতে হয়। ২০১৯’র গ্লাসগোয় লাজিও’র সঙ্গে তাঁদের হোম ম্যাচে সেল্টিক-এর সমর্থকেরাও একটা মহাবিস্ফোরক রাজনৈতিক পোস্টার সঙ্গে এনেছিলেন। সেখানে জনরোষে নিহত একনায়ক মুসোলিনির ঝুলন্ত মৃতদেহের গ্রাফিক্স ছবির পাশেই লেখা : ‘ফলো ইওর লিডার’! যার মানেটা দাঁড়ায় নেতার সঙ্গে তোমরাও জাহান্নামে যাও!
আমাদের মনে রাখতে হবে সেল্টিক-এর সমর্থকরাও কিন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আইরিশ সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের একটা উত্তরাধিকার বহন করেন। তাঁদের ফুটবল প্রেম কিন্তু রাজনীতি নিরপেক্ষ নয়। যেমন এক এফসি কার্সিলোনাদ ফ্যানদেরও। কারণ তাঁদের কাছে ‘বার্সা’। শুধু একটা প্রিয় ফুটবল ক্লাব নয় — মাদ্রিদ তথা মূল ভূখণ্ডের স্পেনীয় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যরাদের বিরুদ্ধে কাতালুনিয়ার জনগণের প্রতিরোধের প্রতীক। ১৯৩৬-এ স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময় বার্সা কর্মকর্তা ও সমর্থকেরা বিদ্রোহী রিপাবলিকান ব্রিগেড-এর সঙ্গে ছিলেন। কবি লোরকার মতোই হিটলার-মুসোলিনির মদতপুষ্ট একনায়ক জেনারেল ফ্রাঙ্কের গুপ্ত বাহিনীর হাতে শহীদ হয়েছিলেন ক্লাবের জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট। এদিকে রিয়েল মাদ্রিদের মাথার ওপরে বরাবরই ফ্রাঙ্কোর আর্শীবাদী হাত থেকেছে। রিয়েল মাদ্রিদের কিংবদন্তী প্রশাসক সান্তিয়াগো ,,,, (রিয়েলের এখনকার স্টেডিয়াম যাঁর নামে) ছিলেন ফ্রাঙ্কোর ঘনিষ্ট বন্ধু, সহযোগী। সুতরাং রিয়েল বনাম বার্সার ‘এল ক্লাসিকো’ কোনোভাবেই শুধু একটা ডার্বি ম্যাচ হয়ে থাকতে পারে না। সেটা একটা রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক যুদ্ধ। রিয়েল-এর সমর্থকদের কাছে কাডালান ‘বিচ্ছিন্নতাবাদীদের’ সবক্ শেখানোর আর বার্সা-ফ্যানদের কাছে কাতালুনিয়ার স্বাধিকারের লড়াই।
এমনকি স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন ক্যাম্প ন্যু-তে কেন ‘এল ক্লাসিকো’ হবে, সেজন্য নিজেদের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও বার্সা সমর্থকেরা বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। ডার্বি বাতিলের দাবিতে স্টেডিয়ামে সামনে ব্যারিকেড গড়েছেন। বৃহত্তর রাজনৈতিক ইস্যুতে ফুটবল ভক্তদের ক্ষোভ এভাবেই বাররার মাঠ অবধি পৌঁছে গেছে। এই তো সেদিন বুন্দেশলিগায় তাদের প্রথম ম্যাচের দিনেই বরসির্য়া ডর্টমুন্ডের সমর্থকেরা স্টেডিয়ামের ভেতরে ও বাইরে বিক্ষোভ দেখালেন, কারণ তাঁদের ক্লাব কর্তৃপক্ষ জার্মানির এক অস্ত্র নির্মাণ কোম্পানিকে স্পন্সর বানিয়েছে। ফুটবলের খাতিরে তো তাঁরা মানবতার প্রতি নিজেদের দায় তো অস্বীকার করতে পারেন না। মনুষ্যত্বের এই দায়বোধ থেকেই তো গত ১৮ আগস্ট বাতিল ডার্বির দিনে যুবভারতীর সামনে জোট বেঁধেছিলেন ইস্টবেঙ্গল-মহামেডানের সমর্থকেরা। আতঙ্কগ্রস্ত শাসক হামলা চালিয়ে সেই শান্তিপূর্ণ সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক জমায়েতকেও রাজনৈতিক মাত্রা দিয়ে ফেলল। নির্যাতিতার জন্য বিচারের দাবির পাশেই তাই উঠে এল টাটকা স্লোগান ‘হাবুল সেনের পাশেই প্যালা। ভয়ে শাসকের শুকিয়ে যাচ্ছে গলা।’ ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে ১৮ আগস্ট একটা সোনালী দিন হিসেবেই থেকে যাবে। ফিফা র্যা ঙ্কিং-এ ভারতীয় ফুটবল যত নম্বরেই থাকুক, ওই একদিন অন্তত এই শহরের ফুটবল-সমাজ মানবিক সচেতনতার সর্বোচ্চ মান ছুঁয়ে ফেলেছেন। ছুঁয়ে এসেছেন প্রতিরোধের শিখর।
Comments :0