JOB CARD SCAM

অস্তিত্বহীন ‘ব্যাক’, ‘রামু’র অ্যাকাউন্টে কয়েক হাজার কোটি

রাজ্য জেলা

hundred days work scam

এক গ্রামবাসীর নাম ‘ব্যাক’। তালিকায় ইংরেজি ছোট হরফে সেই নাম লেখা। তার নামে জবকার্ড হয়েছে। হুগলীর হরিপাল ব্লকের হরিপাল আশুতোষ পঞ্চায়েতে এই ‘ব্যাক’ কাজও করেছে। 
আরও আছে এমনকাণ্ড। ওই পঞ্চায়েতেরই একটি জবকার্ডের নম্বর ডব্লিউবি-০৬-০০৭-০০১—০০২/১৬০। যার জবকার্ড তার নাম কী? পঞ্চায়েত জানাচ্ছে, ওই ব্যক্তির কোনও নাম নেই। কোনও জাত, ধর্ম, লিঙ্গ পরিচয় নেই। তিনি শুধুই ওই জবকার্ডের নম্বরটি। 
মুর্শিদাবাদের একটি পঞ্চায়েত কী বলছে? সাগরদিঘির ওই পঞ্চায়েতটির নাম গোবর্ধনডাঙা। পঞ্চায়েতের ৫১৪৮টি জবকার্ড বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে প্রশাসন। কিন্তু তার একটি অংশের বাতিলের কারণ হিসাবে লেখা হয়েছে ‘ডুপ্লিকেট জবকার্ড।’ ২০২৩-র ২৮জানুয়ারি থেকে ৮ফেব্রুয়ারির মধ্যে ওই জবকার্ডগুলি বাতিল দেখানো হচ্ছে। কিন্তু তার আগে ওই জবকার্ডের অনেকগুলির ভিত্তিতেই কাজ দেখানো হয়েছে বলে অভিযোগ। 
সারা রাজ্যে এমন উদাহরণ দেদার। ভুয়ো জবকার্ডে কয়েক হাজার কোটি টাকা চুরি হয়েছে রাজ্যে, তৃণমূল-শাসনে। সেই টাকা ফেরতের কাজ মমতা ব্যানার্জি করবেন না। 
তিনি এখন বলছেন যে, বকেয়া টাকা ২১লক্ষ জব কার্ডধারীর অ্যাকাউন্টে দেবেন। 
কী ভাবে ভুয়ো জবকার্ডে টাকা তোলা হয়েছে? উদাহরণ দেখা যাক। 
ঘটনাস্থল বাঁকুড়া জেলার পাত্রসায়র ব্লক। পঞ্চায়েতের নাম বেউড় দেতুর। গত আর্থিক বছরে, পঞ্চায়েত নির্বাচনের পরে সেই পঞ্চায়েতের ১১৩টি পরিবারের জবকার্ড বাতিল করেছে প্রশাসন। বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে বলাই সঠিক। ওই ১১৩টি পরিবারের সদস্যদের জবকার্ড কেন বাতিল করা হয়েছে, তার কারণ হিসাবে তালিকায় নামের পাশে লেখা হয়েছে ‘ডুপ্লিকেট জবকার্ড।’ এমনই ডুপ্লিকেট জবকার্ডধারীদের একজনের নাম রামু মাতে। সেই রামু মাতের নামে ২০২২-এ ৭টি মাস্টার রোল তৈরি হয়েছে। মাস্টার রোলগুলির নম্বর যথাক্রমে ১৩৯৩, ১৪৩৯, ২০৬৮, ২২৪৩, ২৫০৩, ২৬৬৫ এবং ৩০৫০। এই মাস্টারগুলিতে দেখানো হয়েছে সেই রামু মাতে একশো দিনের প্রকল্পে কাজ করেছেন। যথাক্রমে ৬দিন, ৬দিন, ১২দিন, ১২দিন, ১২দিন, ৯দিন এবং ৩দিন। অর্থাৎ ওই আর্থিক বছরে রামু মাতে একশো দিনের প্রকল্পে কাজ করে উপার্জন করেছেন ১২,২৯৬ টাকা। 
কিন্তু রামু মাতে নেই— অস্তিত্বহীন। কিন্তু পঞ্চায়েত অস্তিত্বহীন রামু মাতের কাজের মজুরি দিয়েছে। মজুরি জমা পড়েছে একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কে। বন্ধন ব্যাঙ্কের কান্তাবন শাখায় ( ব্রাঞ্চ কোড-বিডিবিএল০০০১০৭৯)-এ সেই রামু মাতের অ্যাকাউন্টে টাকা জমা পড়েছে। 
প্রশ্ন হলো— অস্তিত্বহীন রামু মাতের নামে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে খুলল কে? কীভাবে খুলল? জমা পড়া মজুরির টাকা তুলল কে? গ্রামে কোনও সন্দেহ নেই, এই দুঃসাহসিক নির্লজ্জ চোট্টামো তৃণমূল ছাড়া কারও করা সম্ভব নয়। গ্রামবাসীদের অভিযোগও তাই। নাম প্রকাশে অনিচছুক দু-তিনজন গ্রামবাসীর বক্তব্য, এই টাকা গত বেশ কয়েক বছর টাকা তুলেছে তৃণমূলের নেতারা। 
এই ক্ষেত্রে আর একটি বিষয়ও আছে। কোন কাজের জন্য রামু মাতের নামে মজুরি বরাদ্দ হয়েছে? অর্থাৎ কী কাজ তিনি করেছেন? মাস্টাররোলগুলি বলছে, রামু মাতে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার ঘর বানিয়েছেন। যে ব্যক্তির অস্তিত্ব নেই, তার ঘর বরাদ্দ হয় কী করে? রাজ্যে আমফানের মতো বিপর্যয়ের পরে অনেক গ্রামবাসীর ঘর ভেঙেছে। তাঁদের বড় অংশ আবাস যোজনার সুবিধার পাননি। অথচ অস্তিত্বহীন রামু মাতের নামে ঘরও বরাদ্দ হয়েছে। আবাস যোজনার নিয়ন অনুসারে ঘর বানানোর টাকা যেমন মিলনে, তেমনই সেই ঘর বানানোর জন্য একশো দিনের কাজের প্রকল্পে ৯০দিন কাজও করতে পারে উপভোক্তা। 
এই ক্ষেত্রে তাহলে দু’বার চুরি হয়েছে রামু মাতের নামে। প্রথমে তার নামে ঘর বরাদ্দ করে সেই টাকা চুরি করা হয়েছে। আবার সেই ঘর বানানোর জন্য একশো দিনের কাজ দেখিয়ে মজুরির টাকা চুরি করা হয়েছে।
এমন রামু মাতে কয়েক লক্ষ আছে রাজ্যে— অস্তিত্বহীন। ভুয়ো। কিন্তু তার নামে কার্ড বানিয়েছে তৃণমূল নেতারা। কাজ দেখিয়েছে। সেই টাকা চুরি করেছে। এ’ শুধু একবছরের বিষয় নয়। বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে ভুয়ো জবকার্ডের ভিত্তিতে এমন ভাবে কয়েক হাজার কোটি টাকা লুট হয়েছে রাজ্যে।
চলতি আর্থিক বছরে, রবিবার পর্যন্ত রাজ্যে ৬লক্ষ ৪ হাজার ৯৬জনের জবকার্ড বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে রাজ্য সরকার। তার আগের বছর, অর্থাৎ ২০২২-২৩-এ রাজ্যে বাতিল হয়েছিল ৮৩লক্ষ ৪৩ হাজার ৫৩২জনের ভুয়ো জবকার্ড। হাতের ছাপ মিলিয়ে ভুয়ো জবকার্ড চিহ্নিতকরণের এই কাজ মমতা ব্যানার্জির সরকার এড়িয়ে গেছে বারবার। যদিও ২০১৮থেকেই ভুয়ো জবকার্ডের বিষয়ে রাজ্য সরকারের মধ্যেই আমলাদের একটি ছোট অংশ সোচ্চার হওয়ার চেষ্টা করেন। দিব্যেন্দু সরকার রাজ্যের রেগার কমিশনার থাকাকালীন ভুয়ো জবকার্ড বাতিলের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়। কারণ— রেগার টাকা চুরি করে ধনী হয়েছে তৃণমূলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা। টাকা চুরির জন্য তৃণমূলের নেতারা প্রতি বছর ভুয়ো জবকার্ড বানিয়েছে। জাল মাস্টাররোল বানিয়েছে। আর সেই মাস্টাররোলে কাজ দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা লুট করেছে। 
সেই ভুয়ো জবকার্ডের একটি বড় অংশ এখনও রয়ে গেছে বলেই আশঙ্কা। মমতা ব্যানার্জি আগামী ২১ফেব্রুয়ারি ২১লক্ষ জবকার্ডধারীর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাবেন বলে ঘোষণা করেছেন। যে টাক বকেয়া আছে বলে তাঁর দাবি। কিন্তু যে কাজ দেখিয়ে টাকা বকেয়া বলা হচ্ছে, তা মূলত ২০২১-২২ এবং ২০২২-২৩-র। সেই সময়ে দেদার কাজ দেখানো হয়েছে একশো দিনের প্রকল্পে। তার একটি বড় অংশ ভুয়ো জবকার্ডের ভিত্তিতে। তাহলে এখন যদি সরকারি কোষাগার থেকে সেই ভুয়ো কাজের মজুরি দেওয়া হয়, তাহলে সরকারি টাকার একাংশ সরাসরি, সরকারি পৃষ্টপোষকতায় চুরি হবে বলেই রাজ্যের গ্রামোন্নয়ন দপ্তরের আধিকারিকদের আশঙ্কা।
ফলে দু’ভাবে টাকা চুরির ব্যবস্থা হলো তৃণমূলের। প্রথমবার আগেই চুরি হয়েছে। সেই টাকা ফেরতের কোনও উদ্যোগ সরকার নেয়নি। আর এখন ভুয়ো জবকার্ড, ভুয়ো মাস্টাররোলের ভিত্তিতে দেখানো কাজের টাকাকে বকেয়া দেখিয়ে আবার চুরির সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।
যেমন উত্তর ২৪ পরগনার দেগঙ্গা ব্লকের চৌরাসিতে হয়েছে। সেখানে চলতি আর্থিক বছরে এখনও পর্যন্ত ৪২৫টি জবকার্ড বাতিল করা হয়েছে। এতগুলি জবকার্ড বাতিল করতে প্রশাসন, পঞ্চায়েত সময় নিয়েছে মাত্র দু’দিন— গত ২৭এপ্রিল এবং ১২মে। কেন বাতিল করা হলো? প্রত্যেকের নামের পাশে একই যুক্তি লেখা হয়েছে— ‘নন এক্সিসটেন্ট ইন পঞ্চায়েত।’ অর্থাৎ পঞ্চায়েত অঞ্চলে এদের অস্তিত্ব নেই। অর্থাৎ থাকেন না। কিন্তু যাঁরা ওই এলাকায় থাকেন না, তাঁরা কাজ করলেন কী করে? উদাহরণ— ‘আসমত’। জবকার্ডে (নং-ডব্লিউবি-১৫-০০৪-০০৬-০০৯/৬১৪)-র তথ্য বলছে আমফানে ভাঙা ঘরের কাজ, খাল সংস্কার, মাছ চাষের পুকুর পরিস্কার, গাছ লাগানোর নানা কাজ এই ‘আসমত’ করেছেন ২০২১ থেকে। ১১টি মাস্টাররোল হয়েছে তার নামে।প্রায় ৩০ হাজার টাকা ঢুকেছে তার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে। 
যে লোক থাকেই না, ‘নন এক্সিসটেন্ট’, তিনি কাজ করলেন কী করে? টাকাই বা পেলেন কী করে?


 

Comments :0

Login to leave a comment