শমীক লাহিড়ী
২ নভেম্বরের রাত দেখলো, ইস্পাত কঠিন ইচ্ছাশক্তি জয়ের আড়ালে পুরুষতন্ত্রের নীরব ভাঙন। নবি মুম্বাইয়ের ডিওয়াই পাটিল স্টেডিয়াম। শুধু একটি ফাইনাল নয়, এটা ছিল ভারতীয় ক্রিকেটের বহু যুগের অপেক্ষার অবসান, এক মহাকাব্যিক রাত, যে মহাকাব্যের রচয়িতা আমাদেরই মেয়েরা।
দীর্ঘ ৫০ বছরের পথচলা, দু’বার ফাইনালের দোরগোড়া থেকে ফিরে আসার বেদনা— সব গ্লানি মুছে দিয়ে হরমনপ্রীত কৌরের ভারত অবশেষে জিতল তাদের প্রথম বিশ্বকাপ। দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৫২ রানে পরাজিত করে ইতিহাস লিখল 'ওমেন ইন ব্লু'।
নবি মুম্বাইয়ের ডিওয়াই পাটিল স্টেডিয়ামের রাত, নিছক একটা ক্রিকেট ম্যাচ ছিল কী? না, একেবারেই নয়। এ ছিল সমাজের বহু যুগের পুরানো শেকল ভাঙার ইতিহাস। এই জয় শুধু একটা ট্রফি জয় নয়, এ ছিল 'মেয়েদের ক্রিকেট' নামক উপহাসের থেকে 'ক্রিকেট' নামক মূল স্রোতে ফিরে আসার পথে এক মাইলফলক। যিনি বা যারা বলেছিলেন, ‘মেয়েদের ক্রিকেট খেলার কোনও মানেই নেই’, তাদের মেয়েদের ক্রিকেট খেলার মানে বুঝিয়ে দিয়েছে আকাশের দিকে তোলা বিশ্বকাপ হাতে হরমনপ্রীতের দল। যুগে যুগে সঞ্চিত এক স্বপ্নের রথযাত্রা, যার সারথি হরমনপ্রীত কৌর। দীর্ঘ পাঁচ দশকের অপেক্ষা, দু'বার ফাইনালের বিষাদ-নদী পেরিয়ে, অবশেষে ভারতীয় মহিলা দল স্পর্শ করল বিশ্বজয়ের 'আকাশগঙ্গা', যে আকাশে ব্রাত্য শুধু পুরুষতন্ত্রের পুরোহিতরা। 
এক অদৃশ্য বাধা ও নীরব যুদ্ধ
এই ভারতীয় দল যখন মাঠে নেমেছিল, তখন তাদের গায়ে শুধু দেশের জার্সি নয়, ছিল সমাজের অদৃশ্য অথচ কঠিন এক প্রত্যাশার বোঝা। পুরুষদের ক্রিকেটের সাথে সর্বদা তাদের তুলনা করা হয়— যেন তারা ক্রিকেট উপন্যাসের এক প্রান্তিক চরিত্র। খেলার সামান্য বিচ্যুতি ঘটলেই সমাজ নামের সেই পুরানো পিতৃতান্ত্রিক স্বর শোনা যায়, ‘মেয়েদের খেলাটা আসলে একটা ঐচ্ছিক বিনোদন মাত্র।’ এই জয় শুধু দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানো নয়, বরং সেই পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার নীরব প্রতিরোধ।
দুই ফাইনাল, জয়ের ভিন্ন সংজ্ঞা
২০১৭ সালে যখন মেয়েরা ফাইনালে অল্পের জন্য হেরেছিল, তখন সহানুভূতি ছিল, কিন্তু সেই অর্থে জাতীয় উৎসব হয়নি। পক্ষান্তরে, পুরুষ দলের সামান্য ব্যর্থতাতেও দেশজুড়ে নেমে আসে শোকের ছায়া। এই বৈষম্যের পাথরের ভার বুকে চেপে ধরে হরমনপ্রীতরা যখন খেলতে নামলেন, তখন তাদের প্রতিটা রান, প্রতিটা উইকেট ছিল যেন 'সমানাধিকারের সপক্ষে সোচ্চার কণ্ঠ'।
বৃষ্টিতে ম্যাচের শুরুটা কিছুটা দেরিতে হলেও, ভারতের ওপেনিং জুটি দ্রুতই সেই অপেক্ষার দাম চুকিয়ে দিল। ২৩ বছরের শেফালি বর্মা খেললেন এক বিধ্বংসী ইনিংস (৭৮ বলে ৮৭ রান)। তাঁর এবং স্মৃতির (৪৫) ১০৪ রানের ওপেনিং পার্টনারশিপ ভারতের বিশাল সংগ্রহের (২৯৮/৭) ভিত্তি তৈরি করে দেয়। শেফালীর ৮৭ রান যেন সমাজের চোখে চোখ রেখে বলা — আমরা 'পুরুষদের মতো নই, আমরা আমাদেরই মতো'। শেফালির প্রতিটা শট ছিল জয়পুর বা আজমগঞ্জের নর্দমায় ফেলে দেওয়া কন্যা ভ্রূণের মৃতসঞ্জীবনী, আর হত্যাকারীদের প্রতি সরব ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ। পাঞ্জাব হরিয়ানা যেখানে সবচেয়ে বেশি কন্যা ভ্রূণ হত্যা হয়, সেখানকার মেয়ে হরমনপ্রীত কাউর, শেফালি ভার্মা, প্রতিকা রাওয়ালের মায়েরা টিভি পর্দায় নিজের মেয়েদের বিশ্বজয় করতে দেখে চিকচিক করা চোখে ভাবছিলেন - একেই তো ১০ মাস ১০ দিন গর্ভে ধারণ করেছিলাম। এরাই আমাদের গর্ব।
এরপর মিডল অর্ডারে দ্রুত কয়েকটি উইকেট হারানোর চাপ সামলে নেন দীপ্তি শর্মা। চাপের মুখে ৫৮ রানের এক পরিণত ইনিংস খেলে তিনি শুধু স্কোরবোর্ডকে সম্মানজনক জায়গায় নিয়ে যাননি, মেয়েদের সম্মানকে তুলে ধরেছেন। রিচা ঘোষের ঝড়ো ক্যামিও (৩৪ রান) ভারতকে প্রায় ৩০০ রানের কাছে পৌঁছে দেয়। দীপ্তি শর্মার অলরাউন্ড পারফরম্যান্স প্রমাণ করে দিল, শ্রেষ্ঠত্ব লিঙ্গ-নিরপেক্ষ, এর কোনও উপমা হয় না। রিচার মারা চার-ছয় মাঠ পেরিয়ে বার্তা পোঁছে দিয়েছিল - অভয়া, নির্ভয়াদের বাপ-মায়ের চোখের জল যেন এভাবেই প্রতিবাদী আগুনের গোলা হয়ে সমাজের গ্যালারিতে আছড়ে পড়ে।  
অশ্রু নয়, এ হলো স্বাধীনতার প্রতিচ্ছবি
ঘড়ির কাঁটা রাত ১২ টা পেরিয়ে গেছে। ৩০ কোটি মানুষের চোখে ঘুম নেই, রয়েছে শুধু বিস্ময়। তখনও চলছে ভলভার্টের যুদ্ধ, যেন একাকী এক যোদ্ধার শপথ। দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক লরা ভলভার্ট একাই নিলেন বিপক্ষের দুর্গে শেষ প্রহরীর শপথ। তাঁর ব্যাট থেকে বেরোনো শতরান (১০১) ছিল প্রোটিয়াদের রণভেরী, যা ভারতের চোখে চোখ রেখে লড়ছিল। এক সময় মনে হচ্ছিল, তাঁর একক বিক্রমেই হয়তো ভারতের স্বপ্নের মুকুট হাতছাড়া হয়ে যাবে।
খেলা যখন দোদুল্যমান পেন্ডুলামের মতো একবার ভারতের দিকে, তো একবার দক্ষিণ আফ্রিকার দিকে ঝুঁকছে, ঠিক তখনই আসলো সেই মুহূর্ত। ভলভার্টের শট... বল শূন্যে ভাসমান... ছুটে গেলেন আমানজোত কৌর এবং বলটি ধরতে পারলেন না। কোটি কোটি হৃদয়ের গতি তখন স্তব্ধ! কিন্তু মাটিতে পড়ার আগে, যেন জয়ের মুকুট তিনি মুঠোয় ভরে নিলেন। ভলভার্টের এই লড়াই দেখিয়ে দিল – হ্যাঁ মেয়েরাও লড়তে জানে। 
দীপ্তি শর্মার বলে শেষ উইকেটটি পড়তেই, ডিওয়াই পাটিলের গ্যালারি 'আনন্দের আগ্নেয়গিরি'তে পরিণত হলো। অধিনায়ক হরমনপ্রীত কৌর যেন স্বয়ং বিজয়ের দেবী, শূন্যে হাত ছুঁড়ে দিলেন। স্মৃতির চোখে জল, রিচার কণ্ঠ থেকে চিৎকারের ঢেউ —এসবই ছিল বহু বছরের যন্ত্রণা আর অপেক্ষার পর ঝরে পড়া 'আনন্দাশ্রু, যা হীরে হয়ে ঝরে পড়ছিল'।
এই জয় শুধু একটি ম্যাচের জয় নয়। এটি ছিল মিতালী-ঝুলনদের ফেলে আসা সকল কষ্টের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি, ভবিষ্যতের প্রতিটি ভারতীয় মেয়ের জন্য 'মুক্তির সনদ'। প্রোটিয়দের শেষ উইকেট পড়ার পরে যখন উল্লাস শুরু হলো, ক্যামেরা যখন হরমনপ্রীত, স্মৃতি বা দীপ্তির আনন্দের অশ্রু শুধুমাত্র শুধুমাত্র জয়ের আবেগ ছিল না, ছিল যুগে যুগে নিগৃহীত স্বপ্নগুলোর মুক্তি। এ ছিল সেইসব নারীর জন্য 'স্বাধীনতার বার্তা', যারা আজও খেলাধুলা বা কর্মজীবনে পা বাড়াতে ভয় পান। নীল বসনের উল্লাস যেন দেশের ১৪০ কোটি মানুষের সামনে এক সোচ্চার ঘোষনা – হ্যাঁ আমরাও পারি, সব মেয়েরাই পারে।
এই বিশ্বকাপ জয় দেশের কোটি কোটি মেয়েকে এক নতুন দিশা দিয়েছে – পথ কঠিন হতে পারে, সমালোচনা তীব্র হতে পারে, কিন্তু যদি ইচ্ছাশক্তি ইস্পাত কঠিন হয়, তবে এই সমাজকে নিজেদের নিয়মে চলতে বাধ্য করা যায়। 
আমাদের মেয়েরা শুধু বিশ্বকাপ জেতেনি, তারা দেশের নারী সমাজের জন্য সমতার এক নতুন হাইওয়ে নির্মাণ করেছে। 
এই মেয়েরা পুরো আকাশ চায়নি পুরুষতন্ত্রের মতো। তাই তো সেমিফাইনাল শেষে জেমিমা রডরিগস বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাঁর ১২৬ রানের ঝড় ছিল ভীনেশ ফোগাট, সাক্ষী মালিকদের হয়ে ব্রীজভুষণ শরণ সিংদের গালে একশো ছাব্বিশ সিক্কার এক থাপ্পড়। 
পুরো আকাশ ওরা চায়নি, তাই স্যার অমল মুজুমদারকে মাথায় তুলে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েছিল হরমনপ্রীতরা। এই উচ্ছ্বাস ছিল স্যারের প্রতি অবিচারের তীব্র প্রতিবাদ। ক্রান্তি গৌড়ের ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার গতিবেগে ছোঁড়া বলগুলো ছিল যেন ধনী-দরিদ্র বৈষম্য আর তার বাবার প্রতি অবিচারের বিরুদ্ধে ক্রোধের মিসাইল বর্ষণ। দীপ্তি শর্মা’র ঘুর্ণি শুধু দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংসই নয়, ছিল পুরুষতন্ত্রের মাথাদের প্রতি না-পসন্দ উদ্ধত এক চ্যালেঞ্জ। 
ট্রফি নেওয়ার আগে ভারতীয় অধিনায়কের নাচ, তামান্নার বাপ-মা অশ্রুসজল নয়নে তখন নিশ্চয়ই ভাবছিলেন – আজ তামান্না বেঁচে থাকলে ঘরের উঠোন জোড়া নাচে আঁকতো জয়ের এক নতুন আলপনা।
 
                                        
                                    
                                
                                    
                                    
                                    
                                    
                                    
                                    
Comments :0