২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে সিপিআই(এম) নেতৃত্বাধীন বাম-গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট নির্বাচনী ইশ্তেহারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল জিতে ফের ক্ষমতায় এলে কেরালা থেকে চরম দারিদ্র নির্মূল করা হবে। নির্বাচনে জয়ের পর পিনারাই বিজয়নের নেতৃত্বে দ্বিতীয় এলডিএফ সরকার শপথ নেবার পর মন্ত্রীসভার প্রথম বৈঠকেই পাঁচ বছরের মধ্যে কেরালাকে চরম দারিদ্রমুক্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং সেই লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। শেষপর্যন্ত ঘোষিত সময়সীমার আগেই ১ নভেম্বর কেরালা রাজ্যের ৬৮তম প্রতিষ্ঠা দিবসে মুখ্যমন্ত্রী বিজয়ন আনুষ্ঠানিকভাবে কেরালাকে দেশের প্রথম চরম দারিদ্রমুক্ত রাজ্য হিসাবে ঘোষণা করেন। এমন নজিরবিহীন সাফল্য ও গৌরব উদ্যাপনের জন্য এদিনই অনুষ্ঠিত হয় কেরালা বিধানসভার বিশেষ অধিবেশন এবং আয়োজন হয় এক সুবিশাল জন সমাবেশের। আন্তর্জাতিক ও জাতীয় মাপকাঠি অনুযায়ী যে যে শর্তপূরণ না হলে এবং যে যে অভাব বা ঘাটতি পূরণ না হলে কাউকে চরম দারিদ্র বলে চিহ্নিত করা হয় গত চার বছর ধরে নিরলস ও ধারাবাহিক প্রচেষ্টায় কেরালা সরকার সেই সব শর্ত পূরণ করেছে এবং সব অভাব ও ঘাটতি পূরণ করেছে। ফলে কেরালায় এখন এমন একজন মানুষকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না যিনি চরম দারিদ্রের শিকার। দারিদ্র পীড়িত ভারতের বুকে এমন অনন্য সাফল্য অর্জন করতে পারে একমাত্র বামপন্থীরা। কোনও গেরুয়াধারী সনাতনী রামরাজ্যের স্বপ্ন ফেরিওয়ালাদের পক্ষে একাজ সম্ভব নয়। আসামে মোদী অনুরাগী বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী যখন রাজ্য থেকে মুসলিম তাড়ানোর প্রতিজ্ঞা করছেন তখন কেরালার বামপন্থী মুখ্যমন্ত্রী রাজ্য থেকে চরম দারিদ্র বিতাড়ন করে জীবনমানের উন্নতির বিচারে কেরালাকে বিশ্বের যেকোনও উন্নত দেশের সমকক্ষ করার সংকল্প করছেন। ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের ব্যাপারিদের সঙ্গে বামপন্থীদের এখানেই পার্থক্য।
একাজ মোটেই সহজসাধ্য ছিল না। কয়েক হাজার হোক বা লক্ষ মানুষকে চরম দারিদ্র থেকে তুলে আনা হয়ত কঠিন কোনও কাজ নয়। কিন্তু গোটা রাজ্যের প্রতিটি গ্রামে-মহল্লায় কোথায় কে চরম দারিদ্রে আছে তার সন্ধান পাওয়াই দুরূহ কাজ। আশা কর্মী, সরকারি কর্মীরা দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কার্যত জনগণনার মতো ঘরে ঘরে গিয়ে খুঁজেছেন চরম দরিদ্রদের। তারপর তাদের রোজগার, বাসস্থান, স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা হয়েছে। তাদের রেশন কার্ড, আধার কার্ড দেওয়া হয়েছে। বহুমুখী প্রকল্পের মাধ্যমে তাদের সবদিক থেকে সহায়তা দিয়ে দারিদ্র থেকে টেনে তোলা হয়েছে।
এই অনন্য সাফল্যের পর মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেন নতুন কেরালা গড়ার। যেখানে কেরালাবাসীর জীবনযাত্রার মান হবে উন্নত দেশের সমান। শুধু আকাশচুম্বী বাড়ি বা ঝাঁ চকচকে রাস্তা নয়, গুটিকতক শতকোটিপতির হাতে যাবতীয় সম্পদের কেন্দ্রীভবন নয়, কেরালার উন্নয়নের মডেল হলো সব মানুষকে নিয়ে একসঙ্গে এগিয়ে যাওয়া। একটি সহানুভূতিশীল, সাম্যবাদী ও কল্যাণমুখী সমাজই প্রকৃত উন্নত সমাজ। এই লক্ষ্যে কিছু মাপকাঠিতে ইতিমধ্যেই কেরালা আমেরিকাকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। প্রতি একলক্ষ জন্মে মায়ের মৃত্যু, ১০০০ জন্মে শিশুর মৃত্যু, স্বাক্ষরতার হার, মহুমাত্রিক দারিদ্র ইত্যাদিতে কেরালা আমেরিকা থেকে অনেকটা এগিয়ে। কেরালা শুধু আজকের সমস্যার সমাধান করছে না, আগামীর সম্ভাব্য সমস্যা নিরসনেরও আগাম পরিকল্পনা করে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সত্যিকারের এক উন্নত সমাজ উপহার দেবার কথা মাথায় রেখে কাজ করে। এটাই আসলে ‘কেরালা স্টোরি’।
editorial
আসল কেরালা স্টোরি
×
Comments :0