Robibarer pata

গরিবের স্বাস্থ্য পরিষেবার সূচক দ্রুত নামছে রাজ্যে

বিশেষ বিভাগ ফিচার পাতা

ডাঃ ফুয়াদ হালিম
 

পশ্চিমবঙ্গে সার্বিক জনস্বাস্থ্য সূচক এবং সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চরম অবনতি ঘটেছে গত ১৫ বছরে। আমরা যদি তুলনামূলক পরিসংখ্যান মূল্যায়ন করি তাতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে কিভাবে রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে ক্রমশ পিছিয়ে পড়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে রোগগ্রস্ত হওয়ার প্রবণতা বহুল পরিমাণে বেড়ে গিয়েছে। রক্তাল্পতার চিকিৎসা থেকে ডেঙ্গু মোকাবিলা, গরিব মানুষের চোখের ছানি অপারেশন থেকে ল্যাপারেস্কোপিক টিউবেকটমি- সমস্ত ক্ষেত্রেই ব্যর্থতার নজির তৈরি করে চলেছে সরকার। 
আমরা যদি বিভিন্ন বয়সের অনুপাতে মহিলাদের মধ্যে রক্তাল্পতার বিষয়টি লক্ষ্য করি তাহলে দেখা যাবে রক্তাল্পতা বাংলায় অতি মাত্রায় বেড়েছে। ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে- এনএফএইচএস- ৩ (২০০৫-০৬), এনএফএইচএস-৪ (২০১৫-১৬) এবং এনএফএইচএস-৫ (২০১৯-২১) মাপা হয়েছে গোটা রাজ্যে। তাতে দেখা গেছে বয়ঃসন্ধি মেয়েদের (১৫-১৯ বছর) মধ্যে রক্তাল্পতা ২০০৫-০৬ সালে ছিল ৪৭ শতাংশ। ২০১৫-১৬ সালে তা বেড়ে ৬২.২ শতাংশ হয়েছে। ২০১৯-২১ সালে তা আরও বেড়ে ৭০.০৮ শতাংশে পৌঁছেছে। শুধুমাত্র বয়ঃসন্ধিকালেই নয়, মহিলাদের মধ্যেও রক্তাল্পতা এক মারাত্মক আকার নিয়েছে। অর্থাৎ ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়স পর্যন্ত বয়সের ক্ষেত্রে ২০০৫-০৬ সালে ৫৪.২ শতাংশ থেকে ২০১৫-১৬ সালে দাঁড়িয়েছে ৬২.৫ শতাংশে। পরবর্তীকালে ২০১৯-২১ সালে তা আরও বেড়ে ৭১.৪  শতাংশে পৌঁছেছে। শুধুমাত্র মেয়েদের নয়, ছেলেদের মধ্যেও ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সের ক্ষেত্রে ২০১৫-১৬ সালে ৩১.০৭ শতাংশ থেকে ২০১৯-২১ সালে দাঁড়িয়েছে ৩৮.৭ শতাংশ। 
রক্তাল্পতার মূল কারণগুলির মধ্যে অন্যতম হলো খাদ্যের অভাব। সাধারণভাবে মেয়েদের এবং ছেলেদের মধ্যেও পুষ্টির ঘাটতি ঘটেছে। খাদ্যের অভাবের সঙ্গে মহিলাদের আর্থ সামাজিক অবস্থা যুক্ত। সেদিক থেকেও রাজ্যের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। রাজ্যের তরফে চিকিৎসা পরিষেবা, প্রয়োজন অনুসারে আয়রন – ফোলিক অ্যাসিড দেওয়া-সবটাই একটা নেতিবাচক রূপ নিয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। কম বয়সে গর্ভধারণ করা, অল্প বয়সে বিবাহতে গোটা দেশের মধ্যে আমরা শীর্ষ স্থানে চলে গেছি। এর সাথে পরিশোধিত পানীয় জলের অভাব, শৌচাগারের অব্যবস্থা এবং খালি পায়ে হাঁটা, পাবলিক হেলথ ইঞ্জিনিয়ারিং দপ্তরের সরবরাহকৃত ‘নলবাহিত পানীয় জল’ না পাওয়া এবং টিউবওয়েল ব্যবহার রক্তাল্পতার কারণ হিসেবে চিহ্নিত। অল্প বয়সে গর্ভধারণ এবং বারবার গর্ভধারণ, সচেতনতার প্রসারের অভাবও এর জন্য দায়ী। সরকারের তরফে স্বাস্থ্যখাতে পরিষেবা নিয়ে যা যা বলা হয়, তা শেষ অবধি হয় না। 
যেমন ২০২৩-২৪ সালে বলা হয়েছিল স্বাস্থ্য এবং পরিবার কল্যাণ দপ্তর খরচ করবে ১৮ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা। কিন্তু শেষমেষ ১৭ হাজার ২২৬ কোটি টাকা পশ্চিমবঙ্গ সরকার খরচ করতে পেরেছিল। অর্থাৎ ১২৬৩.৩১ কোটি টাকা কম খরচ হয়েছে যা বাজেটের প্রায় ৭ শতাংশ। যা ঘোষনা করা হচ্ছে সেই লক্ষ্যমাত্রায় পৌছাতে পারছে না সরকার। ফলে সাধারণ মানুষ তাঁদের প্রাপ্য স্বাস্থ্য পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
একইভাবে ডেঙ্গুর ক্ষেত্রেও বাড়বাড়ন্ত লক্ষ্য করা গেছে গত কয়েক বছরে। জনসমাজে ডেঙ্গুর প্রকোপ সাংঘাতিক বেড়ে গিয়েছে। তথ্য বলছে ২০০৮ সালে রাজ্যে ১০২০ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ছিলেন। ২০১০ সালে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৮০৫ জন। ২০১২ সাল থেকে এই সংখ্যা বাড়তে থাকে। ওই বছর ৬৪৫৬ জন আক্রান্ত হয়েছিলেন। ২০১৬ সালে ২২৮৬৫ জন, ২০১৯ সালে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৫ হাজারে। এবং ২০২২ সালে ডেঙ্গু বিস্ফোরক হয়ে ওঠে, ওই বছর আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৬৭২৭১। এই তথ্য হেলথ অন মার্চ সহ বিভিন্ন আদালতে দাখিল করা তথ্য এবং সংবাদ মাধ্যমের থেকে প্রাপ্ত।  
পশ্চিমবঙ্গ সরকার স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য ২০১৮ সাল থেকে অর্থাৎ কোভিডের ২ বছর আগে থেকে প্রকাশ করা বন্ধ করে দিয়েছে। ২০২০-২১ সালে কোভিড চলাকালীন ডেঙ্গুর পরিসংখ্যান সর্বভারতীয় স্তরে সঠিকভাবে নথিভুক্ত করা যায়নি। ২০১৫ সালের পরবর্তী পরিসংখ্যানগুলি বিভিন্ন আদালত, সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে রাজ্যের পক্ষ থেকে জমা দেওয়া পরিসংখ্যান, সংবাদ মাধ্যম এবং কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থাগুলি থেকে যেমনভাবে সরবরাহ করা হয়েছে, সেটাই পাওয়া যাচ্ছে। যদিও এই পরিসংখ্যানগুলি অসম্পূর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা আছে এবং আসল পরিসংখ্যান রাজ্য সরকার প্রকাশ করলে হয়তো ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা আরও অনেক বেশি হবে। জনস্বাস্থ্য এবং মশার প্রাদুর্ভাবকে মোকাবিলা করার পরিকাঠামো শোচনীয় অবস্থায়। রাজ্যজুড়ে এলাকায় এলাকায় প্রশাসনের সাফাই কাজ, জমা জল নিষ্কাশন নিয়ে ভূরি ভূরি অভিযোগ রয়েছে। উপযুক্ত পরিকল্পনার অভাবে দুর্ভোগ ভুগতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার সাফল্য যে বিভিন্ন জনস্বাস্থ্যমূলক প্রকল্পতে বহুল পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে তা প্রমাণিত। 
চোখের ছানি কাটানো বা ছানি অপারেশনের ক্ষেত্রে বলা যায়, ন্যাশনাল প্রোগ্রাম ফর প্রিভেনশন অব ব্লাইন্ডনেস-এর অধীনে ছানি অপারেশনের জন্য টাকা ধার্য হয় কেন্দ্রীয়ভাবে। একটি লক্ষ্যমাত্রা স্থির থাকে এক্ষেত্রে। আর রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো বেশি বেশি অপারেশন করে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা, এর বিনিময়ে যা খরচ হবে তা কেন্দ্রীয় প্রকল্পের বরাদ্দ থেকে আদায় করা। এই খাতে রাজ্যকে বাড়তি কোনও অর্থ ব্যয় করতে হয় না। শুধুমাত্র স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে কার্যকরীভাবে প্রয়োগ করলেই পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে অন্ধত্ব থেকে রেহাই দেওয়া যায়। গত শতাব্দীর শেষের দিক থেকে এই শতাব্দীর প্রথম দশকের মধ্যে গোটা পশ্চিমবঙ্গে ছানি অপারেশন বিভিন্ন চক্ষু বিভাগের তরফ থেকে সর্বনিম্ন ৮৪ শতাংশ এবং সর্বোচ্চ ১৩০.৪ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা হতো। লক্ষ্যমাত্রার ওপর অতিরিক্ত অপারেশন করলে বাড়তি টাকা এই প্রকল্পের মাধ্যমে আদায় করা যায়। 
কিন্তু হেলথ অন মার্চ এবং রাজ্য সরকারের বাজেট বই থেকে জানা যাচ্ছে, রাজ্য সরকারি পরিকাঠামোয় এই ছানি অপারেশন অতিমাত্রায় কমতে শুরু করেছে ২০১১-১২ সাল থেকে। ২০১৬-১৭ সালে লক্ষ্যমাত্রা থেকে ৪৭.৬ শতাংশ কম হয়েছে। ফলে এই প্রকল্পের বরাদ্দ টাকা এবং অন্যান্য কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলির লক্ষ্যমাত্রা না পূরণ হওয়ার ফলে বরাদ্দ টাকা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে ফেরৎ চলে গেছে। ২০২৩-২৪ সালে কেন্দ্রের বিভিন্ন প্রকল্পের বরাদ্দ ছিল ৩২৭৭ কোটি টাকা। এই রাজ্যে যার ব্যবহার হয়েছে মাত্র ১৮৭৩. ৬৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ ১৪০৩.৩৭ কোটি টাকা বিভিন্ন কেন্দ্রীয় প্রল্পের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না করার ফলে  ফেরত গেছে। শতাংশের বিচারে যা ৪২.৮২ শতাংশ। টাকা ফেরৎ যাওয়া মানে সময়োপযোগী এবং জরুরি কাজগুলি হয়নি। মানুষ চিকিৎসা পরিষেবা পেলেন না। এই দায়ভার বর্তায় রাজ্যের ওপরেই। 
সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বিভিন্ন ক্ষেত্রেই কমেছে। পরিবার পরিকল্পনার জন্য জন্মনিয়ন্ত্রণে মাইক্রো সার্জারির সাহায্যে ল্যাপারেস্কোপিক টিউবেকটমি অপারেশন করা হয়, পেট কেটে প্রথাগতভাবেও এই অপারেশন করা যায়। হেলথ অন মার্চের তথ্য বলছে, ২০১০-১১ সালে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাইক্রো সার্জারি ল্যাপারেস্কোপিক টিউবেকটমি ৩৭৯১০ জনের হয়েছে। এই সংখ্যা প্রতি বছর নিম্নমুখী হয়ে ২০১১-১২ সালে ৩০৩৬৯ –এ নেমেছে। এরপর ২০১২-১৩ সালে হয়েছে ২৩৯০৩ জনের, ২০১৩-১৪ সালে হয়েছে ১৮৪০২ জনের ক্ষেত্রে ল্যাপারেস্কোপিক টিউবেকটমি অপারেশন করা হয়। এরপর কমতে কমতে ২০১৭-১৮ সালে এই সংখ্যা দাঁড়ায় মাত্র ৮৪৪৬। রাজ্য সরকার এই পর্যন্তই তথ্য দিয়েছে।  
এই অপারেশন করার জন্য এক বিশেষ আধুনিক পরিকাঠামো, আধুনিক যন্ত্রাংশ, বিশেষ টিম এবং হাসপাতালের মধ্যে আধুনিক প্রযুক্তিকে ব্যবহার করার বিশেষ পরিবেশ থাকা দরকার। যা ক্রমশ গোটা রাজ্যে অবলুপ্ত হয়েছে। ঝাঁ চকচকে হাসপাতালের রূপ বাইরে যেটা দেখা যায়, আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগের বাস্তব চেহারার সঙ্গে তার অনেক ফারাক। সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল নামেই হয়েছে, কিন্তু পরিকাঠামো বাড়ানো হয়নি। রাজ্যে যত সংখ্যক চিকিৎসক স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগের দরকার তার অনেক কম রয়েছে সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থায়। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সংখ্যা প্রয়োজনের থেকে অনেক কম। চূড়ান্ত অভাব অ্যাম্বুল্যান্সের। প্রত্যন্ত গ্রামীণ এলাকায় স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির মধ্যে বহু কেন্দ্রে অচলাবস্থা তৈরি হয়ে রয়েছে, ভরেছে আগাছা, জঙ্গলে। প্রকৃতপক্ষে রাজ্য সরকার গত কয়েক বছরে এসবের উন্নতি সাধন করতে পারতো, মুখে নানা প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে কিন্তু সে কাজ হয়নি। একটি গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যে যে সুবিধা থাকা দরকার সেসব মানুষের জানার অধিকার আছে। অথচ সরকারি তথ্য প্রকাশ করছে না রাজ্য সরকার। 
চিকিৎসা ব্যবস্থায় সরকারি ক্ষেত্রের অবহেলা বেসরকারি ক্ষেত্রকে উৎসাহ জোগাচ্ছে। বলা যায় চিকিৎসা ক্ষেত্রে বেসরকারি সংস্থাগুলি মুনাফার একটি ছাকনি তৈরি করছে। এই ছাকনি থেকে মুনাফা বাদ দিয়ে যেটুকু বাঁচবে সেটুকুই গরিব মানুষের কাছে পৌঁছবে। বাকিটা মুনাফাবাজরা আত্মসাৎ করবে। এই হয়ে দাঁড়িয়েছে বর্তমান চিকিৎসার হাল হকিকত। চিকিৎসায় খরচ জোগাতে গিয়ে মানুষকে দারিদ্রসীমার নিচে চলে যেতে হচ্ছে। প্রান্তিক গরিব মানুষের কাছে চিকিৎসা অত্যন্ত দামি হয়ে উঠছে। ওদিকে প্রসূতি মৃত্যু ও শিশু মৃত্যু গুরুতর আকার নিতে চলেছে রাজ্যে। রেফার কেস রুখতে মনিটরিং সিস্টেম চালু, বা বিভিন্ন হাসপাতালগুলির মধ্যে সমন্বয় গড়ার বিষয়ে যা যা ব্যবস্থা নেওয়ার কথা রাজ্য সরকার বলেছিল তার কিছুই কার্যত দেখা যাচ্ছে না। জাল ওষুধ, স্যালাইন চক্র ঠেকাতেও ব্যর্থ রাজ্য সরকার। বিশুদ্ধ পানীয় জল, পুষ্টি, শিক্ষা, সুষম খাদ্য যা গরিব মানুষের দরকার সেগুলি অবহেলিত থেকে যাচ্ছে। আর সরকার বেসরকারি ক্ষেত্রগুলিকে ক্রমশ উৎসাহিত করছে সুকৌশলে। এভাবে বাংলা বাঁচবে না, বাংলার মানুষকে বাঁচাতে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে আরও অনেক বেশি জোর দিতে হবে সরকারকে।                                    
 

Comments :0

Login to leave a comment