Wrestler issue

ব্রিজভূষণরাই বিজেপি’র আসল মুখ

উত্তর সম্পাদকীয়​

সঞ্চারী চট্টোপাধ্যায়

আগস্ট, ২০২২। 
বার্মিংহামে কমনওয়েলথ গেমসের মঞ্চে দাঁড়িয়ে সাক্ষী মালিক। চোখে জল, গলায় স্বর্ণপদক। বারবার উচ্চারিত হচ্ছে ভারতের নাম। সাক্ষীকে পদক পরানোর পরই বেজে উঠল জনগণমন। জাতীয় সঙ্গীত শেষ হতে হতেই সাক্ষী আর চোখের জল আটকে রাখতে পারলেন না। অঝোরে কাঁদছেন। শুধু নিজের জয়ের কান্না নয়, সেই আনন্দাশ্রু দেশকে বিশ্বমঞ্চে সমাদৃত করারও। 
জুন, ২০২৩। 
সাক্ষী মালিকের চোখে আবার জল। রাজধানীর রাজপথে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের পুলিশ মারতে মারতে টেনে হিঁচড়ে তাঁকে আর তাঁর সহযোদ্ধাদের তুলে নিয়ে গিয়েছে, জেলে। 
অপরাধ একটাই, যৌন হেনস্তায় অভিযুক্ত বিজেপি সাংসদের শাস্তি এবং নিজেদের জন্য ন্যায়বিচার চাওয়া। সাক্ষীর সঙ্গেই মার খেয়েছেন বীনেশ ফোগট, সঙ্গীতা ফোগট, বজরঙ পুনিয়ারা। প্রত্যেকেই দেশের নাম উজ্জ্বল করেছেন, দেশকে সম্মান এনে দিয়েছেন। তাঁরা যখন মার খাচ্ছেন, তখন সেই বিজেপি সাংসদ ব্রিজভূষণ শরণ সিং নতুন সংসদ ভবনে দাঁড়িয়ে ‘পোজ’ দিয়ে ছবি তুলছেন। 


একটা হাথরস, একটা কাঠুয়া, একটা উন্নাও কিংবা একজন বিলকিস বানোর মাধ্যমে বারবার প্রমাণিত হয়েছে বিজেপি’র চরিত্র। নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের মহিলা বিরোধী মানসিকতা। মেয়েদের সঙ্গে চূড়ান্ত বর্বরতা হলে যে দলের নেতা-মন্ত্রীরা ধর্ষকদের সমর্থনে মিটিং-মিছিল করেন, বলা ভালো, মেয়েদের সম্মান-হরণ যাঁরা ‘এনজয়’ করেন, তাঁদের চরিত্র দিনের আলোর চেয়েও বেশি পরিষ্কার। সব জেনেবুঝেই সাক্ষী-বীনেশরা ময়দানে নামেন। মনে জোর ছিল, পদক জয়ের পর ডেকে যে সরকার ‘সম্মান’ দিয়েছে, সে সরকার নিশ্চয়ই তাঁদের কথা শুনবে, মানবে। ক্রিকেটময় জগতে গ্রামের গরিব ঘরের মেয়েরা কুস্তি শিখতে এসে ফেডারেশন প্রধানের হাতেই নিগৃহীত হচ্ছে। ধীরে ধীরে সাহস জুগিয়ে সাক্ষী-বীনেশরা তাদের মুখ খুলিয়েছেন। মোদীর উপর আস্থা রেখেছিলেন। অবশ্য সাক্ষীরা ভুল ছিলেন। যে প্রধানমন্ত্রী স্বাধীনতা দিবস সহ অহরহ মেয়েদের সম্পর্কে দ্বিচারিতা করেন, তাঁর উপর কতটা আস্থা রাখা যায়? যন্তরমন্তরে রাতের অন্ধকারে মোদী-শাহের পুলিশ তাঁদের উপর যখন চড়াও হয়, তখন কাঁদতে কাঁদতে বীনেশ ফোগট আকুতি করেছিলেন, আমরা এসব দিন দেখার জন্য পদক জিতেছিলাম? সেই পদক তাঁরা হরিদ্বারের গঙ্গায় ভাসিয়ে দিতে চাইলেও মোদী-শাহ বা দলের কেউ আটকাতে আসেননি। 


এই স্বৈরাচারী সরকারের গত ৯ বছরের চরিত্র বিশ্লেষণ করতে গেলে খুব বেশি নাড়াচাড়া না করে কয়েকটি ঘটনাতেই এদের মহিলা-বিরোধী চিন্তাধারা সহজে ধরে ফেলা যায়। সঙ্ঘ পরিবারের মদতপুষ্ট রাজনৈতিক দলটি মনুস্মৃতি আরোপিত নানা ধরনের ফতোয়া মহিলাদের উপর বিভিন্ন সময়েই জারি করেছে। কী পরবে, কীভাবে পরবে, কী পরলে ধর্ষণ হবে, কী পরলে ধর্ষণ হবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহারের পর বিজেপি’র লোকজনই মশকরা করে বলত, এবার কাশ্মীরি মেয়েদের বিয়ে করা আর কোনও ব্যাপার না! বিজেপি ঠিক এটাই ভাবে। মেয়ে মানেই বিয়ে, সন্তান জন্ম দেওয়ার মেশিন, গেরস্থালির কাজ এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজের যাবতীয় অত্যাচার নির্বিবাদে মেনে নেওয়া। বিজেপি ক্ষমতায় আসার বছর তিনেকের মধ্যেই সাধ্বী প্রাচী একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। চার বা তার বেশি সন্তানের জন্ম দেওয়া মা-বাবাদের ফুলের মালা পরিয়ে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। বেছে বেছে নিয়ে আসা হয়েছিল দ্বারিকা সিং, রামপাল সিং, গুরনাম সিংকে। যাঁদের মধ্যে কেউ ১১ বার, কেউ বা ন’বার প্রসব যন্ত্রণায় কষ্ট পেয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গেরই এক বিজেপি নেতা বলেছিলেন, আমি হিন্দু মা-বোনেদের অনুরোধ করছি, প্রত্যেকে অন্তত পাঁচজন সন্তানের জন্ম দিন। হিন্দু সন্তান বাড়ানোর উদ্দেশে মা-বোনেদের এই উপদেশ, এই অনুরোধ। গর্ভ সংস্কার প্রকল্প পর্যন্ত চালু করে ফেলেছে বিজেপি। 


আর এই মা-বোনেরাই যখন নির্যাতিত হন, তখন দেখেও না দেখা, শুনেও না শোনার ভান চলে। মোদী স্বাধীনতার ৭৫ বছরে যখন লালকেল্লা থেকে মহিলাদের নিরাপত্তা-সুরক্ষা নিয়ে ভাষণ দিচ্ছেন, তখন গুজরাটে বিলকিস বানোর ধর্ষকদের বেকসুর খালাস করে দেওয়া হয়।
উত্তর প্রদেশের উন্নাওয়ের ঘটনা মনে আছে ? যোগী আদিত্যনাথের বাড়ির বাইরে গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করছেন এক কিশোরী, পাশে বাবা। যোগী আদিত্যনাথের সরকারের তখনকার বিধায়ক কুলদীপ সিং সেঙ্গার তাকে ধর্ষণ করে। প্রবল সমালোচনার মুখে সেঙ্গারকে লোক দেখাতে গ্রেপ্তার করা হলেও বিজেপি সরকার তাকে সমস্ত রকমভাবে সহায়তা করে জেলে বসেই কার্যসিদ্ধি করার। সেঙ্গারের ছকে একে একে ওই নির্যাতিতার বাবা, কাকা সহ আরও আত্মীয়েরা প্রাণ হারান (পড়ুন খুন হন)। নাবালিকা থেকে সেই নির্যাতিতা সাবালিকা হন। তাঁকে এবং তাঁর আইনজীবীকেও খুনের ছক করা হয়। এই যোগীরাজ্যেই একের পর এক হাথরস, বলরামপুর, উন্নাওয়ের ঘটনা ঘটে গিয়েছে। প্রমাণ ধামাচাপা দিয়েছে বিজেপি। নির্যাতিতার পরিবারকে একঘরে করে দিয়েছে। সুবিচার তো দূর অস্ত, বারবার ধর্ষকদের সমর্থনে মিটিং-মিছিল করেছে বিজেপি। এই উন্নাওয়েই এক ধর্ষিতাকে আদালতে যাওয়ার পথে গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয় ধর্ষকরা। জ্বলন্ত শরীরে রাস্তা দিয়ে ছুটছিলেন সেই নির্যাতিতা। প্রাণে বাঁচেননি। সুবিচারও পাননি। জম্মু-কাশ্মীরের কাঠুয়ায় আট বছরের ওই শিশুকে মন্দিরের পুরোহিত, পুলিশ এবং আরও সহচররা মিলে টানা সাতদিন ধর্ষণের পর খুন করে দেয়। সেই ধর্ষকদের সমর্থনে পথে নেমেছিলেন বিজেপি’র নেতা-মন্ত্রীরা। উড়িয়েছিলেন তিরঙাও। সেই বিজেপি বাহুবলী ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে সামান্য যৌন হেনস্তার অভিযোগ উঠতেই তাকে গ্রেপ্তার করে নেবে, এ ভাবনা ভাবাই বোধহয় বোকামি। সে যে যতই ‘পদক টদক’ আনুন না কেন! ওতে তো বিজেপি’র বিভাজনের রাজনীতির স্বার্থ মিটবে না বা ভোটবাক্সও ভরবে না। 


দেশে শেষ জনগণনা হয়েছিল ২০১১ সালে। সেই হিসাবে মহিলা এবং পুরুষের অনুপাত ৯১৯: ১০০০। দেশের ইতিহাসে সবথেকে কম। নিঃসন্দেহে এ এক জাতীয় সঙ্কট। মোদী সরকার প্রচুর গুরুত্বের কথা শুনিয়ে গাল ভরে ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ প্রকল্প নিয়ে এল। আর, আখেরে কী দেখা গেল? প্রকল্প তহবিলের ৫৬ শতাংশ টাকা খরচ হয়েছে শুধু বিজ্ঞাপনী প্রচারে, ২৪ শতাংশ দেওয়া হয়েছে রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মধ্যে ভাগ করে। আর বাকি টাকার কী হয়েছে, তার হিসাব নেই। বেটিদের বাঁচানো বা বেটিদের পড়ানো, বেটিদের নিরাপত্তা কোনোটাই বিজেপি’র অগ্রাধিকার তালিকায় নেই। লকডাউনের সময় যখন ডিজিটাল মাধ্যমেই পড়াশোনা একমাত্র পথ হয়ে দাঁড়ায়, তখন প্রত্যন্ত অংশের বহু ছেলেমেয়ে স্কুলছুটের তালিকায় পড়েছে। তার মধ্যে আবার মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। কিন্তু বিজেপি সরকার কোনওরকম হেলদোল দেখায়নি। উলটে নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নেই জোর দিয়েছে। মোদীর সরকারই উজ্জ্বলা প্রকল্প তৈরি করে ধোঁকা দিয়েছে মহিলাদের। মিড ডে মিল, আশা, অঙ্গনওয়াড়িদের মতো লক্ষ-লক্ষ মহিলা কর্মীদের বঞ্চনা করেছে বিজেপি সরকার। 
সিএএ-এনআরসি’র বিরুদ্ধে আন্দোলন হোক বা কৃষি আইনের বিরোধিতা, নির্যাতনের বিরুদ্ধে তো বটেই, বারবার পথে নেমেছেন মহিলারা। আর পুলিশের নৃশংসতার শিকার হয়েছেন। ২০১৪ সালে বিজেপি’র ইশ্‌তেহারে মহিলা ক্ষমতায়নের কথা ছিল। সমাজের উন্নয়নে নারী শক্তির গুরুত্ব নিয়ে বাগাড়ম্বরও বাদ যায়নি। অথচ বিজেপি শাসনের ন’বছরে লাফিয়ে বেড়েছে নির্যাতন। এনসিআরবি’র রিপোর্ট থেকেই দেখা গিয়েছে, ২০১২ সালে যেখানে মহিলাদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের ঘটনা ছিল ২ লক্ষ ৪৪ হাজার, ২০২১-এ সেই সংখ্যা প্রায় ৪৩ শতাংশ বেড়ে পৌঁছে গিয়েছে ৪ লক্ষ ৩০ হাজারে। ক্ষমতায়ন শব্দটিও উপহাসস্বরূপ। বেকারত্ব চরমে পৌঁছেছে। মহিলাদের কাজের সংস্থান উত্তরোত্তর কমেছে। কোভিড পরবর্তী সময়ে অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। লকডাউনে গার্হস্থ্য হিংসা বেড়েছে চড়চড় করে। সমস্ত ক্ষেত্রেই মহিলাদের ক্রমশ পিছনের দিকে টেনে ফেলার চেষ্টা করছে বিজেপি। এমনকি আইনসভায় যে ৩৩ শতাংশ সংরক্ষণের বিলও আটকে রেখে দিয়েছে। ধর্মীয় বিভাজনের খেলায় যখন যেভাবে ইচ্ছা হয়েছে, বিজেপি ব্যবহার করেছে মহিলাদের। সে সবরিমালা মন্দিরে প্রবেশাধিকার হোক বা তিন তালাক বাতিল। হিজাব নিয়ে সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়াতেও বাচ্চা মেয়েদের হাতিয়ার করে বিজেপি। 


বিজেপি’র কাছে আসলে মহিলাদের অধিকার, মহিলাদের সম্মান, মহিলাদের পছন্দ-অপছন্দ পুরোটাই পুরুষতান্ত্রিক বা পুরুষের অধিকার সর্বস্ব। 
দীপা মেহতা ‘লায়লা’ ওয়েব সিরিজে দেখিয়েছিলেন, আজ থেকে চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর পর কাল্পনিক এক হিন্দুরাষ্ট্রে মেয়েদের কী দুর্দশা হতে পারে। শালিনি চরিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছিলেন সেই সময়ের চিত্র, কীভাবে শিশু-মনেরও ‘ব্রেনওয়াশ’ হচ্ছে, কীভাবে মহিলাদের অন্ধকার ঘরে আটকে রেখে অত্যাচার হচ্ছে ইত্যাদি! বাস্তবকে সেই পথে এগতে দেওয়া কি তবে ঠিক হবে?
 

Comments :0

Login to leave a comment