Left front government

গণতন্ত্রের অভিযাত্রী বামফ্রন্ট সরকার

উত্তর সম্পাদকীয়​

বিমান বসু
 

আজ ঐতিহাসিক ২১জুন। ১৯৭৭ সালে এই দিনে পশ্চিমবাংলার অধিকাংশ বামপন্থী দলসমূহের নেতৃত্বে রাজ্যে জনস্বার্থবাহী বামফ্রন্ট সরকার গড়ে উঠেছিল। মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন কমরেড জ্যোতি বসু। ২১জুন শপথ বাক্য গ্রহণ করার পর কমরেড জ্যোতি বসু মহাকরণে পৌঁছে এক বিশাল সমাবেশের সামনে বলেছিলেন— ‘বামফ্রন্ট সরকার শুধু মহাকরণ থেকে সরকারি কাজ পরিচালনা করবে না। জনগণকে যুক্ত করে জনস্বার্থে পঞ্চায়েতী ব্যবস্থা, পৌরসভা সহ সব স্বশাসিত সংস্থা নির্বাচনের মাধ্যমে গড়ে তুলবে।’ মুখ্যমন্ত্রীর সেই ঘোষণা অনুসারেই ১৯৭৮ সালে রাজ্যে ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েতী ব্যবস্থা গড়ে ওঠে যা ভারতে সর্বপ্রথম। ধীরে ধীরে পৌরসভা এবং সমবায়গুলি জনগণের মতামতের ভিত্তিতে গড়ে উঠতে থাকে।


৪৬ বছর পর আজ একথা উল্লেখ করতেই হবে যে ’৭৭-র নির্বাচনের প্রাক্কালে রাজ্য বামফ্রন্টের পক্ষ থেকে যে নির্বাচনী ইশ্‌তেহার প্রকাশ করা হয়েছিল তা যথাযথভাবে রূপায়িত করার লক্ষ্যে বামফ্রন্ট সরকার সচেষ্ট ছিল। ফলশ্রুতিতে প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে ২৮ দফা কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়েছিল। যা সাধারণভাবে সত্যি ব্যতিক্রমী ঘটনা। যে ৮দফা কর্মসূচি কার্যকর করা সম্ভব হয়নি তা সংশ্লিষ্ট ছিল কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের সঙ্গে। উল্লেখ্য প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক পুনর্বিন্যাসের দাবিতে মাঠে-ময়দানে গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে উঠেছে আর সরকারের পক্ষ থেকে কমরেড জ্যোতি বসুর উদ্যোগে বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের নিয়ে ‘কনক্লেভের’ আয়োজন করা হয়েছে। সফল কনক্লেভ আয়োজন করার মধ্য দিয়েই বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদ্‌দের বক্তব্য সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। বাধ্য হয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে সারকারিয়া কমিশন গঠন করতে হয়। ফলে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের বিষয় নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার ও মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর ভূমিকা ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে।


নতুন প্রজন্মের কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন রাজ্যে প্রথম বামফ্রন্ট সরকার কি আকস্মিকভাবে গড়ে উঠেছিল? ঠিক তা নয়। জনগণের জীবনযন্ত্রণা লাঘব করার জন্য, বিশেষ করে গ্রামের কৃষক ও শহরে শ্রমিক-কর্মচারীদের দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মানুষের মধ্যে নতুন নতুন ভাবনা গড়ে উঠছিল। ছোট করে বললে বলা যায় এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ১৯৬৭ ও ১৯৬৯ সালের স্বল্পস্থায়ী যুক্তফ্রন্ট সরকার গড়ে ওঠার ইতিহাস। আবার যুক্তফ্রন্ট সরকারের অভিজ্ঞতা গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সমৃদ্ধ করেছিল। তবে অবশ্যই যুক্তফ্রন্ট সরকার থেকে বামফ্রন্ট সরকারে উত্তরণের ইতিহাস অনেক লম্বা এবং বন্ধুর পথ ধরেই তা সক্রিয় ছিল।


আজ আমাদের একথা স্মরণ করতেই হবে যে বামফ্রন্ট মন্ত্রীসভার প্রথম বৈঠকেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে রাজ্যের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক অধিকার এবং নাগরিক স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার সব ধরনের কাজ করা হবে। রাজনৈতিক আনুগত্য না দেখে সমস্ত রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হবে। সকল নকশালপন্থী ও অন্যান্য বন্দিদের প্রায় ১৭০০ জনকে মুক্তি দেওয়া হয়। এবং দলমত নির্বিশেষে সব রাজনৈতিক দলের নেতা ও কর্মীদের বিরুদ্ধে রুজু করা ১০হাজার ফৌজদারি মামলা প্রত্যাহার করা হয় এমনকি ২১৮ জন ‍‌মিসার বন্দিকেও মুক্তি দেওয়া হয়। ঠিক এমন সিদ্ধান্ত অতীতে পশ্চিমবাংলায় কোনদিন গৃহীত হয়নি, কার্যকরী করা তো দূরের কথা। প্রসঙ্গত, কমরেড জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে প্রথম সাংবাদিক বৈঠকের কিছু কথা উল্লেখ করতে চাই। সাংবাদিকরা তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘‘আপনি বলছেন, আপনাদের সরকার ৫ বছর স্থায়ী হবে, কীসের ভিত্তিতে আপনাদের এই বিশ্বাস?’’ জ্যোতি বসু উত্তরে বলেছিলেন, ‘‘আমাদের সরকার ৫ বছর স্থায়ী হবে এটা মনে করছি এইজন্য যে আগের দুটি যুক্তফ্রন্ট সরকারের তুলনায় এই সরকারের শক্তি ও জনসমর্থন অনেক বেশি। আমরা আগের থেকে অনেক বেশি ঐক্যবদ্ধ। সাধারণ মানুষের যে জনসমর্থন আমরা পেয়েছি তাতেই বলতে পারি আমরা ৫ বছর থাকব। জনগণও তাই চান।’’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘‘আমরা রাইটার্স বিল্ডিং থেকে কাজ চালাবো না। নতুন সরকার জনগণের ও তাদের সংগঠনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে তাদের সমস্যাগুলি জেনে নিয়ে বিভিন্নভাবে কাজ চালাবে।’’


অনেক গবেষক মনে করেন পশ্চিমবাংলায় কৃষি ক্ষেত্রে ভূমি সম্পর্কের যে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে তা বামফ্রন্ট সরকার ব্যতীত অন্য কোনও রাজ্যে তেমন সাফল্য অর্জন করেনি। একথা তো সত্য পঞ্চায়েতী রাজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর দেখা গেছে সারা দেশের ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে বণ্টিত জমির মধ্যে ২২ শতাংশ জমি আমাদের রাজ্যের। অথচ আমাদের রাজ্যে জনসংখ্যার ৮ শতাংশ মানুষ বসবাস করেন। এই কর্মসূচিতে ২০১০ সালের হিসাব অনুযায়ী ভূমিহীন ও গরিব কৃষকের জমির পরিমাণ ছিল ১১.২৭ লক্ষ একর। এক্ষেত্রে উপকৃত হয়েছিলেন প্রায় ৩০ লক্ষ পরিবার। আর এই জমি বণ্টনের নিয়মনীতির ফলে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছিলেন তফসিলি জাতি, আদিবাসী এবং ধর্মীয় বিচারে সংখ্যালঘু জনগণ। গ্রামীণ গরিবের মধ্যে নতুন উন্মাদনা, রাজ্য সরকারের মিনিকিট সহ অন্যান্য সহযোগিতার ফলশ্রুতিতে পশ্চিমবাংলা খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বনির্ভর হয়ে উঠল।
গ্রামবাংলার আর্থিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে খাদ্যশস্য সহ কৃষির সাফল্য এক নতুন সম্ভাবনার দিক উন্মোচন করে। এক্ষেত্রে অসংখ্য সমবায় সমিতি কৃষক জনগণকে সহায়তা করার লক্ষ্যে গড়ে ওঠে। এমনকি আদিবাসী নিবিড় এলাকায় অসংখ্য ল্যাম্পস গড়ে উঠতে থাকে। কৃষিজাত পণ্য বিকিকিনি করতে অসংখ্য সমবায় সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। ধীরে ধীরে গ্রামীণ অর্থনীতি পুষ্ট হলে শিল্পজাত পণ্যের চাহিদা গ্রামবাংলায় বাড়তে থাকে।


শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্যের অবসান ঘটিয়ে শিক্ষা প্রসারের কর্মসূচিতে বামফ্রন্ট সাফল্য অর্জন করেছিল। অসংখ্য প্রাথমিক, জুনিয়র, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল। সাধারণ শিক্ষার প্রসারের লক্ষ্যে ব্যাপক সংখ্যক বিদ্যালয় গড়ে তোলা হলেও জেলায় জেলায় নতুন নতুন কলেজ ও কারিগরী শিক্ষা প্রসারের কর্মসূচিও কার্যকরীভাবে রূপায়িত হচ্ছিল। ইস্কুলে উঁচু ক্লাসে কম্পিউটার শিক্ষার প্রচলনও করা হয়েছিল। বেড়েছিল সরকারি উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়। ছাত্রছাত্রীর সংখ্যাও ব্যাপকভাবে বেড়েছিল। উল্লেখযোগ্য বিষয় বামফ্রন্ট সরকার শিক্ষানীতি, ভাষানীতি ও পাঠক্রম গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বি‍‌শেষজ্ঞদের মতামতের উপর গুরুত্ব আরোপ করে এসেছে।
শিল্প-সাহিত্য ও সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশের জন্য নানা ধরনের প্রতি‍‌যোগিতা সরকারি উদ্যোগে আয়োজন করা হতো। সত্যি কথা বললে একথা বলতেই হবে বামফ্রন্ট আমলে আর যাই হোক অপসংস্কৃতির যে রমরমা এখন দেখা যায় তা অনুপস্থিত ছিল।


বামফ্রন্ট সরকারের জন্মলগ্ন থেকেই দেশি-বিদেশি প্রতিক্রিয়ার শক্তি ও কায়েমী স্বার্থবাদী শক্তি এই সরকারের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করেছে। প্রথম দিন থেকেই জনস্বার্থবাহী কর্মসূচি রূপায়ণে বাধা দিয়েছে। বিভিন্ন সময়ে কেন্দ্রীয় সরকারের বাধাও অতিক্রম করতে হয়েছে। সরকারের বিরুদ্ধে লাগাতার অপপ্রচার চালানো হয়েছে। জনগণকে সঙ্গে নিয়েই এই সমস্ত বাধার মোকাবিলা করেই সরকারকে এগতে হয়েছে।


৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকারের সাফল্যের খতিয়ান তুলে ধরার লক্ষ্যে এ নিবন্ধ নয়। বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪ বছর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যেমন সাফল্যের খতিয়ান আছে তেমন কিছু ক্ষেত্রে ত্রুটি-বিচ্যুতি ও অসাফল্যও রয়েছে। সব থেকে বড় কথা, মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে, তার প্রসার ঘটানোর সাফল্য অবশ্যই বিরাট। রাজ্যে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে নাগরিক স্বার্থরক্ষা করা এবং দুর্নীতিমূলক কার্যকলাপ বন্ধ করার ক্ষেত্রে বামফ্রন্ট সরকার সংকল্পবদ্ধ থেকেছে। সরকার ও প্রশাসনের কোনও স্তর থেকেই দুর্নীতিমূলক কার্যকলাপের পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রশ্রয় দেওয়া হয়নি। যা এখন সবক্ষেত্রেই ব্যাপক ও প্রকট আকার ধারণ করেছে। এখন মন্ত্রীসভার সদস্য, আধিকারিক, শিক্ষা সংস্থার কর্তাব্যক্তি এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে জেলবন্দি। যা এরাজ্যে অতীতে কেউ কখনও কল্পনা করতে পারেনি।
স্বাভাবিকভাবে রাজ্যের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন, গণতন্ত্রপ্রিয় জনগণের ঐক্যবদ্ধভাবে রাজ্যের অপশাসন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রামে ব্রতী হওয়াই হবে এ মুহূর্তের জরুরি কর্তব্য।
 

Comments :0

Login to leave a comment