Post Editorial on NEP

জাতীয় শিক্ষানীতির আগ্রাসন এবং বেহাল রা‍জ্যের শিক্ষা ব্যবস্থা

সম্পাদকীয় বিভাগ

নিলয়কুমার সাহা
 

শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে রাষ্ট্র-ভাবনার প্রকাশ ঘটে সেই রাষ্ট্র কর্তৃক গৃহীত শিক্ষানীতির মধ্য দিয়ে। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার ২০১৯ সালে জাতীয় শিক্ষানীতির যে খসড়া প্রকাশ করেছিল, সেই খসড়া জাতীয় শিক্ষানীতি ২৯ জুলাই, ২০২০ সালে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার অনুমোদনের ফলে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০’ রূপে আত্মপ্রকাশ করে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, খসড়া জাতীয় শিক্ষানীতি নিয়ে সারা দেশে আলোচনা, সমালোচনার ঝড় উঠলেও সারা বিশ্বের সাথে আমাদের দেশে মারণ ভাইরাস কোভিড-১৯ যখন অপ্রতিরোধ্য, যখন দেশের আপামর জনসাধারণ প্রতি মুহূর্তে প্রত্যক্ষ করছে, রাষ্ট্র-কেন্দ্র এবং রাজ্য— যখন দেশের মানুষকে ন্যূনতম স্বাস্থ্য পরিষেবা দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ, দেশের লক্ষ লক্ষ কাজ হারানো মানুষ যখন ঝুঁকি নিয়ে ঘরে ফিরতে গিয়ে বেঘোরে মরছে, দেশের মোট জাতীয় উৎপাদন ব্যয় শেষ তিন দশকে যখন সর্বনিম্ন স্তরে নেমেছে, দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি, সমাজ ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য পরিষেবা, প্রশাসন যখন ভারসাম্য হারিয়েছে তখন এই জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০-র আকস্মিক প্রণয়ন অনেক সন্দেহের জন্ম দেয় বৈকি! পাশাপাশি আমাদের রাজ্যে বর্তমান সরকার এই শিক্ষানীতি সম্পর্কে দীর্ঘ নীরবতা ভঙ্গ করে বিকল্প শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য একাধিকবার আনুষ্ঠানিকভাবে কমিটি গঠন করলেও এখনও পর্যন্ত এই বিষয়ে স্পষ্ট কোনও বক্তব্য পেশ করেনি। রাজ্যের বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠনের পক্ষ থেকে এই বিষয়ে রাজ্য সরকারের অবস্থান জানতে চেয়ে একাধিকবার মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীকে চিঠি পাঠালেও কোনও শিক্ষক সংগঠনের কাছেই সেই চিঠির প্রাপ্তি স্বীকার পর্যন্ত আসেনি। যদিও ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই নতুন জাতীয় শিক্ষানীতির নানা অভিমুখ সম্পর্কে অতীতে তীব্র আপত্তি উত্থাপিত হয়েছে, কোনও কোনও প্রদেশ থেকে এই শিক্ষানীতি পুরোপুরি প্রত্যাহারের দাবি আজও অব্যাহত। ইতিমধ্যেই সারা দেশ সহ আমাদের রাজ্যেও এই নতুন শিক্ষানীতি ধাপে ধাপে কার্যকর হচ্ছে আর এই প্রেক্ষিতেই সমাজের সকল স্তরের শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষাকর্মী ও শিক্ষকদের নতুন এই ব্যবস্থা সম্পর্কে সার্বিক তথ্য পরিবেশনের লক্ষ্যে এই শিক্ষানীতির স্বাতন্ত্র্যতা, বাস্তবতা এবং প্রাসঙ্গিকতার সম্ভাব্য দিকগুলির উপর আলোকপাত অত্যন্ত জরুরি।
ভাঙাগড়ার খেলা: স্বাধীন ভারতবর্ষে ১৯৬৮ এবং ১৯৮৬ সালে পর্যায়ক্রমে ঘোষিত হয়েছিল দেশের প্রথম ও দ্বিতীয় জাতীয় শিক্ষানীতি। দেশের প্রথম দুটি শিক্ষানীতি সম্পর্কে বর্তমান কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় গৃহীত জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০-র মূল্যায়ন এইরকম— ‘বিগত দুটি শিক্ষানীতিতে সকলের প্রবেশাধিকার এবং সমতার উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপিত হয়েছিল।’ জাতীয় শিক্ষানীতি ১৯৮৬ যা ১৯৯২ সালে সংশোধিত হয়েছিল সে সম্পর্কে এই নয়া শিক্ষানীতিতে আরও যে তথ্য সংযোজিত হয়েছে তাহলো, ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ১৯৮৬-র অধরা লক্ষ্য পূরণের উপর যথাযথ গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০-তে। ১৯৮৬ সালের শিক্ষানীতির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন অবৈতনিক বাধ্যতামূলক শিশুশিক্ষার অধিকার আইন, ২০০৯, যা দেশের স্বারস্বত প্রাথমিক শিক্ষার ভিত্তি স্বরূপ।’ যদিও ২৯ জুলাই, ২০২০  তারিখে দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী  কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় জাতীয় শিক্ষানীতি, ২০২০ অনুমোদিত হওয়ার পরই সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েই বলেন, ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০’র অনুমোদনকে মুক্তকণ্ঠে স্বাগত জানাচ্ছি। শিক্ষাক্ষেত্রের বহু প্রতীক্ষিত এই সংস্কার আগামী দিনে লক্ষ লক্ষ জীবন বদলে দেবে।’  পরিতাপের বিষয় হলেও সত্য, স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষে অর্থাৎ বিগত ৭৫ বছরে কার্যকর শিক্ষানীতির কোনোপ্রকার মূল্যায়ন ছাড়াই ঘোষিত হয়েছে নতুন নতুন শিক্ষানীতি। নয়া এই শিক্ষানীতিতে বিগত শিল্পনীতির বেশকিছু কাঠামোগত পরিবর্তন লক্ষণীয়। যেমন প্রায় সাড়ে তিন দশক পর কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রক ফিরেছে নিজের পুরানো পরিচয় কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রকে, বিদ্যালয় শিক্ষার ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্তির বয়স ৬ বছর থেকে ৩ বছরে নামিয়ে আনা হয়েছে, বর্তমান স্কুলশিক্ষার ১০+২ ব্যবস্থার পরিবর্তে ৫+৩+৩+৪ ব্যবস্থার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, বাৎসরিক পরীক্ষার পরিবর্তে ষান্মাষিক পরীক্ষার ব্যবস্থা চালু করা, দশম এবং দ্বাদশ শ্রেণির পরিবর্তে তৃতীয়, পঞ্চম, অষ্টম এবং দ্বাদশ শ্রেণিতে বিশেষ পরীক্ষা, উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার নিয়ামক সংস্থা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি আয়োগ-এর অবসান ঘটিয়ে ভারতীয় উচ্চশিক্ষা আয়োগের দ্বারোদ্ঘাটন, স্নাতক পর্যায়ে তিন বছরের পাঠক্রমের পরিবর্তে চার বছরের পাঠক্রমের সূচনা স্নাতকোত্তর পর্যায়ে দু’বছরের পাঠক্রমের পরিবর্তে একবছরের  পাঠক্রমের সূচনা, চার বছরের  স্নাতক পাঠক্রমে ৭৫% নম্বর পেলে সরাসরি পিএইচডি করার সুযোগ ইত্যাদি। নয়া-জাতীয় শিক্ষানীতির মোড়কে কি উদ্দেশ্যে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার এই কাঠামোগত পরিবর্তন করা হলো, সেই মৌলিক প্রশ্নের কোনও উত্তর কারো জানা নেই।
সম্ভাব্য অনিশ্চয়তা: এই নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি, ২০৪০ সালের মধ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে ভারতবর্ষকে ‘জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন’-এ বসাতে বদ্ধপরিকর। এই নীতি দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করেছে, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অসাম্যকে দূরে স‍‌রিয়ে দিয়ে দেশের সমস্ত শিক্ষানীতির সামনে উন্মুক্ত হবে সর্বোচ্চ গুণসম্পন্ন শিক্ষাক্রম, যা সৃষ্টি করবে ‘এক ভারত, শ্রেষ্ঠ ভারত।’ বিদ্যালয় শিক্ষাক্রমে যে অভিনবত্ব এই নয়া নীতিতে অনুসৃত হয়েছে, সেই নীতি কার্যকর করার আগে যে প্রশ্নগুলির উত্তর খোঁজা অত্যন্ত জরুরি, তা হলো— যে দেশে অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যা (৪৬.৬০%) সারা পৃথিবীতে সর্বাধিক, কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রকের ২০১৮ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী যে দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রয়োজনের তুলনায় ৯.০৮ লক্ষ শিক্ষকের অপ্রতুলতা রয়েছে, সেই দেশে যথার্থ পরিকাঠামো নির্মাণের পরিকল্পনা ছাড়াই প্রাক-প্রাথমিক স্তরে দেশের ৩ বছর বয়সি শিশুদের আমন্ত্রণের মধ্যে কি বিপদ লুকিয়ে আছে, তা উপলব্ধির জন্য কি গবেষণা প্রয়োজন? যে দেশে মিড ডে মিল প্রকল্প পরিচালনায় পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, সেই দেশে বিদ্যালয়ের সব স্তরের সকল শিক্ষার্থীর জন্য ধারাবাহিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা সহ একশো শতাংশ টিকাকরণ কর্মসূচির বাস্তবায়ন এবং প্রত্যেক শিক্ষার্থীর পৃথক হেলথ কার্ড সংরক্ষণের প্রস্তাব কতটা বাস্তবসম্মত? প্রস্তাবনা অবশ্যই সাধুবাদযোগ্য! এই শিক্ষানীতিতে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত স্থানীয় ভাষায় পঠন-পাঠন পরিচালনার নির্দেশিকা নিয়ে সারা দেশে সৃষ্টি হয়েছে এক অস্থিরতা। যদিও স্থানীয় ভাষার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষা শিক্ষার কথা এখানে উল্লিখিত হয়েছে। এই শিক্ষানীতি ভারতীয় দ্রুপদী ভাষা এবং সাহিত্য বলতে সংস্কৃত, তামিল, তেলেগু, কন্নড়, মালয়ালাম, ওডিশা, পালি, পার্শিয়ন এবং প্রাকৃত-এর উল্লেখ করলেও বাংলা ভাষার স্থান হয়নি এই তালিকায়। প্রাদেশিকতার সীমা অতিক্রম করেও একজন বাংলাভাষী মানুষ হিসাবে আমাদের যন্ত্রণা কি অমূলক? রাজ্যের বিদ্যালয় শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে রাজ্য সরকার এখনও কোনও অবস্থান স্পষ্ট করেনি। বিদ্যালয় শিক্ষাব্যবস্থা পুরোপুরি রাজ্য নিয়ন্ত্রণাধীন কাজেই রাজ্য সরকারকেই দায়িত্ব নিয়ে যে বিষয়টি পরিষ্কার করতে হবে তা হলো, আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে বিদ্যালয় স্তরে নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি অনসৃত হবে কি না? রাজ্য সরকার বিদ্যালয় শিক্ষকদের বদলির জন্য চালু করেছে ‘উৎসশ্রী’ পোর্টাল। রাজ্য শিক্ষক বদলির বিষয়ে অস্বচ্ছতা, অবৈধ আর্থিক লেনদেনের নানান খবর আজ আর গোপন বিষয় নয়। এই অব্যবস্থার পাশাপাশি গ্রামাঞ্চল থেকে শিক্ষকদের শহরমুখীতা বিদ্যালয় শিক্ষাব্যবস্থায় গভীর সঙ্কট সৃষ্টি করেছে কারণ বহু ক্ষেত্রেই গ্রামের বিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষক স্বল্পতার কারণে ব্যাহত হচ্ছে প্রাত্যহিক পঠন-পাঠন।


পশ্চিমবঙ্গে বিগত এক দশকে ন্যূনতম পরিকাঠামো ছাড়াই একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আত্মপ্রকাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি করলেও সৃষ্টি হয়েছে চূড়ান্ত অব্যবস্থা। রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজ্যের সাংবিধানিক এবং প্রশাসনিক দুই প্রধানের বৈরিতা কেবল রাজ্যের উচ্চশিক্ষাকে কালিমালিপ্ত করেনি, সৃষ্টি করেছে প্রশাসনিক সঙ্কট! রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মাননীয় উপাচার্য নিয়োগের বৈধতার বিষয়টি বর্তমানে আদালতে বিচারাধীন। আদালতের নির্দেশের উপরই নির্ভর করছে রাজ্যের লাখ লাখ ছাত্র-ছাত্রীর ভবিষ্যৎ যারা এই সময়কালে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নানান পর্যায়ের পাঠক্রম শেষ করেছে। পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষক সমাজ এই বিষয়ে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন কারণ উপাচার্য নিয়োগের বিষয়টিই যদি বৈধতার প্রশ্নে আটকে যায় সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত ডিগ্রির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না তো? বেসরকারি বি এড কলেজের লাগামহীন অনুমোদন এবং শিক্ষার্থী ভর্তি সংক্রান্ত অবৈধ আর্থিক লেনদেনের যে চেহারা রাজ্যবাসী প্রত্যক্ষ করেছেন তা হিমশৈলের চূড়ামাত্র!
এই শিক্ষানীতি অনুসারে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর স্তরে পাঠক্রম ছেড়ে যাওয়া শিক্ষার্থীরা যে কোনও সময়ে পুনরায় পাঠক্রমে যোগ দিতে পারবে। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর সর্বশেষ মূল্যায়নে প্রাপ্ত গ্রেড জমা থাকবে ‘ডিজিটাল লকার’-এ এবং সেই গ্রেড প্রারম্ভিক জের হিসাবে জীবন্ত হয়ে উঠবে শিক্ষার্থী যখন পুনরায় যোগ দেবেন ছেড়ে যাওয়া শিক্ষাক্রমের বাকি অংশ শেষ করার লক্ষ্যে। অর্থাৎ এই নয়া নীতির সাহায্যে উচ্চশিক্ষায় ‘ওপেন এন্ট্রি ওপেন একজিট’ ব্যবস্থা কার্যকরী হবে। বর্তমান পরিকাঠামোয় এই ব্যবস্থা কি আদৌ বাস্তবসম্মত? অতি সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়কে ভারতবর্ষে ক্যাম্পাস খোলার অনুমতি বিষয়ক সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে। আমাদের আশঙ্কা কেন্দ্রীয় সরকারের এই পদক্ষেপ শিক্ষা ব্যবস্থাকে পুরোপুরি সঁপে দেবে বেসরকারি পুঁজির হাতে আর এই সুযোগে দীর্ঘ সময় আটকে থাকা ‘প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ’-এর প্রবেশ ঘটবে ভারতীয় মুক্ত শিক্ষার বাজারে।


একমুখী কেন্দ্রীকতা: নয়া এই শিক্ষানীতি অনুসারে দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় সর্বোচ্চ নিয়ামক সংস্থা হলো ‘হায়ার এডুকেশান কমিশন অব ইন্ডিয়া’। উচ্চশিক্ষা বিষয়ক সর্বোচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন এই আয়োগের অধীনে ‘ন্যা শনাল হায়ার এডুকেশান রেগুলেটারি কাউন্সিল’, ‘ন্যাশনাল অ্যাকরিডিটেশন কাউন্সিল’, ‘হায়ার এডুকেশান গ্রান্ডস কাউন্সিল’ এবং ‘জেনারেল এডুকেশান কাউন্সিল’ এই চারটি সংস্থা দে‍‌শের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় নির্দিষ্ট বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। পাশাপাশি এই শিক্ষানীতি দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করেছে, যথা — রিসার্চ ইনটেনসিভ ইউনির্ভাসিটি, টিচিং ইনটেনসিভ ইউনির্ভাসিটি, এবং অটোনমাস ডিগ্রি গ্র্যান্টিং কলেজেস। রিসার্চ ইনটেনসিভ ইউনির্ভাসিটির প্রাথমিক কাজ হবে গবেষণা, গবেষণার পাশাপাশি এই শ্রেণিভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে অল্পবিস্তর পঠন-পাঠনের কাজও পরিচালিত হবে। টিচিং ইনটেনসিভ ইউনির্ভাসিটি প্রধানত পঠন-পাঠনের উপর গুরুত্ব আরোপ করবে এবং অল্প কিছু গবেষণার কাজও পরিচালনা করবে। দেশের সমস্ত মহাবিদ্যালয়কে তৃতীয় শ্রেণিভুক্ত করার প্রস্তাব এই নীতিতে বর্তমান। এই নীতি অনুযায়ী দেশের কোথায়ও কোনও অনুমোদিত মহাবিদ্যালয়ের অস্তিত্ব থাকবে না। ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের সমস্ত মহাবিদ্যালয়কে স্বশাসিত অনুমোদিত খেতাব প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানে উন্নীত হতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠান প্রস্তাবিত স্তরে উন্নীত হতে পারবে না সেগুল প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে মিশে যাবে। আশঙ্কা এই নীতি কার্যকর হলে সরকারি অনুদানে পরিচালিত দেশের বহু উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ২০৩০ সালের মধ্যে বন্ধ হয়ে যাবে। পাশাপাশি যেসব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান খেতাব প্রদানের অনুমতি পাবে সেগুলির পক্ষেও বর্তমান আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসাবে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা দুষ্কর হবে। ফলত এক বিরাট বিপর্যয় নেমে আসবে ভারতীয় উচ্চশিক্ষাঙ্গনে। গবেষণার জন্য ‘ন্যাশনাল রিসার্চ ফাউন্ডেশান’ নামক পৃথক একটি সংস্থার সুপারিশ করে কেন্দ্রীয় সরকার এই শিক্ষানীতির মাধ্যমে দেশের গবেষণার পরিসরকে সঙ্কুচিত করতে বদ্ধপরিকর। নয়া এই শিক্ষানীতিতে বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তি নির্ভরতার পরিবর্তে প্রাচীন ভারতীয় কলাবিদ্যার অন্তর্ভুক্তি দেশের বহুত্ববাদের উপর এক চরম আঘাত। আন্তর্জাতিক স্তরে ব্রিটেন, চীন এবং ইউরোপের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের স্থায়ী নিয়োগ এবং ‘পেনশন’ প্রক্রিয়াকে শিক্ষাব্যবস্থার একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হিসাবে বজায় রেখেছে। আমাদের দেশ আমেরিকার ‘মডেল’ অনুসরণে বদ্ধপরিকর, যে মডেল অস্থায়ী শিক্ষক নিয়োগের নীতিকেই নির্দেশ করে। এই মডেল অত্যন্ত মেধাবী শিক্ষিত সম্প্রদায়কে শিক্ষাঙ্গন থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ে শিক্ষার মানোন্নয়নের পরিবর্তে শিক্ষাব্যবস্থার অবনমনের পথকেই প্রশস্ত করবে। বহুমাত্রিকতার দেশ ভারতবর্ষের শিক্ষাব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক কাঠামোকে আঘাত করার পাশাপাশি এই শিক্ষানীতি ধর্মনিরপেক্ষতাকেও প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেবে, যা এক-দেশ, এক-ধর্ম, এক-ভাষা এবং এক-শিক্ষার একমুখী নীতিকেই বাস্তবায়িত করবে। 


নতুন জাতীয় শিক্ষানীতির আগ্রাসনের পাশাপাশি আমরা পশ্চিমবঙ্গবাসী প্রত্যক্ষ করে চলেছে পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষাক্ষেত্রে কি সীমাহীন দুর্নীতি! রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষা অধিকর্তা, উপাচার্য সকলেই কোটি কোটি টাকার বিনিময়যোগ্য প্রার্থীদের বঞ্চিত করে অযোগ্যদের শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মী পদে নিয়োগের অভিযোগে আজ জেলে এবং বিচারাধীন, যা কেবল শিক্ষক সমাজকে নয়, রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঠেলে দিয়েছে চরম অনিশ্চয়তার মুখে। রাজ্য তথা দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বেসরকারি শিক্ষাক্রমের করাল গ্রাস থেকে রক্ষা করার পাশাপাশি রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্রকে কলুষমুক্ত করতে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ বাতিল এবং রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থাকে কালিমালিপ্ত করার খলনায়কদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে শিক্ষার্থী, শিক্ষাকর্মী, শিক্ষক, অভিভাবক সহ সমাজের বৃহত্তর অংশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন জনসাধারণকে।
 

Comments :0

Login to leave a comment