Post Editorial

ছিন্ন ষড়যন্ত্র, জিতছে মানুষ

উত্তর সম্পাদকীয়​

পলাশ দাশ
 

মেরুদণ্ড বন্ধক রাখা দলদাস প্রশাসন, সিপি আই(এম)’র সমাবেশ বন্ধ করতে পারলো না। সমাবেশ হবে কাছারি ময়দানেই। মহামান্য বিচারক রাজশেখর মান্থার এজলাসে তৃণমূলের প্রশাসনের জোলো, হাস্যকর যুক্তি টিকলো না। মহামান্য আদালতের নির্দেশে মঙ্গলবার সিপি আই(এম) উত্তর ২৪ পরগনা জেলার সমাবেশ বারাসাতের কাছারি ময়দানে হবে। জেলা প্রশাসন কিছু চোরের কাছে ভালো সাজার চেষ্টা করে নিজেদের দেওয়া অর্ডার অযৌক্তিকভাবে বাতিল করে নিজেদের নাক কাটার নির্বোধ ব্যবস্থা নিজেরাই করলেন। পুলিশ ও প্রশাসন যদি আইন মেনে চলতেন, মেরুদণ্ড যদি রাবার দিয়ে না ঢাকতেন তবে আজ রাজ্যের এই হাল হতো না। এতো বেপরোয়া চুরি, দুর্নীতি রাজ্যে থাকতো না। কেউ ভয়ে, প্রোমোশন সহ নানাবিধ সম্মান-সুযোগের আকাঙ্ক্ষায় চোরেদের দাসত্ব করছেন, কেউ কেউ সরাসরি তৃণমূলের দুর্নীতির নেটওয়ার্কে নিজেদের নাম লিখিয়েছেন। দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত একাংশ সরকারি আধিকারিক বেপরোয়াভাবে আইন, ন্যায়-নীতি বিসর্জন দিয়ে একটা অন্যায় সৌধ প্রতিষ্ঠা করতে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছেন। মিথ্যা দিয়ে বেশিদিন চলা যায় না। তৃণমূলের মন্ত্রী, বিধায়কদের সঙ্গে জেলে আছেন দুর্নীতিতে অভিযুক্ত সরকারি আধিকারিকরাও। মনে রাখা উচিত, আদালতের নির্দেশে চলছে প্রতিটি দুর্নীতির তদন্ত। সিবিআই-কে বিজেপি দিয়ে ম্যানেজ করার চেষ্টা কিছু কাল সুবিধে দিলেও একদিন আসবে যখন সিবিআই’রও কিছু করার থাকবে না। সেই আতঙ্কে পিসি-ভাইপোর ল্যাজে গোবরে অবস্থা দেখেও প্রশাসনের একাংশ আজও আইনের পথে চলতে পারছেন না। এদের লোভ আর ভয় এতো বেশি।  


পুলিশ ও প্রশাসন জনগনের টাকায় সংসার চালালেও আইন ছেড়ে তৃণমূলকে প্রভু বানিয়েছেন। জনগণকে প্রতারিত, বঞ্চিত রেখে তাদের ওপর অহেতুক অত্যাচারের যে নিদর্শন ১২ বছর ধরে সৃষ্টি করেছেন তার পরিণতিতে মানুষের চোখে পুলিশ ও প্রশাসন হয়ে উঠেছে ঘৃণার বস্তু। জনগণের ক্ষোভ, উষ্মার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে নানা সময়। পুলিশ তো আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করবে, কিন্তু সেই পুলিশ আর তৃণমূলের দুষ্কৃতী, দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা এক নেটওয়ার্কের মধ্যে চলে আসায় রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। সব পৌরসভা, পঞ্চায়েত বিরোধী শূন্য করতে পারতো না তৃণমূল, যদি না এই সময়ে সব স্থানীয় প্রশাসন নির্বাচনকে লুট করতে প্রশাসন সাহায্য না করতো। পঞ্চায়েতে মানুষ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেনি, ভোট দিতেও পারেনি। পৌরসভা নির্বাচনে মাত্র ৩০ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছেন, ভোট পোল হয়েছে ৯০ শতাংশ। আজ সবাই দেখছেন পৌরসভা আর পঞ্চায়েত তৃণমূলের লুটের খনি হয়ে উঠেছে। সব কাজেই চুরি আর দুর্নীতি। মানুষকে এতকাল মুখ বন্ধ করিয়ে রাখা হয়েছিল। এত সন্ত্রাস, এত অত্যাচার- পুলিশের সামনেই হয়েছে, তাদের প্রত্যক্ষ সাহায্যে অপরাধ করা হয়েছে। আজও হচ্ছে। এইসব “সরকার পোষিত” মানুষেরা মনে রাখছেন না, কোনও সরকারই চিরস্থায়ী নয়, আর তৃণমূলের এই দুর্নীতির রাজত্ব তো কখনোই বেশিকাল চলবে না। তৃণমূলের নেতাদের মুখে থাকা একটা লাইন এইসব সরকারি মহামান্যদের জন্য বলতে চাই, ‘‘আইন আইনের পথে চলবে’’। আর উর্দু শায়েরির সেই লাইন, ‘‘সব কুছ ইয়াদ রাখখা জায়েগা’’। এই মেজাজেই সমাবেশ হবে। এক ইঞ্চি জায়গা আর কোথাও তৃণমূল আর তার দোসর বিজেপি-কে ছাড়া হবে না। 


সময় খারাপ যাচ্ছে তৃণমূলের। জমিদারি চলছিল বেশ। কিন্তু ছন্দ পতন ঘটছে, খারাপ সময় চলছে। ধরা পড়ছে একের পর এক দুর্নীতি। সব দুর্নীতিই ইঙ্গিত করছে কোনও এক অদৃশ্য মস্তিষ্কের উপস্থিতি। পার্থ-অর্পিতা, মানিক-অনুব্রত দলের স্তম্ভ, বীর, বাঘেরা তাদের বান্ধবী, পরিবার নিয়ে উন্নয়নের সাদা-নীল কম্বল গায়ে দিয়ে এখন তিহারে, প্রেসিডেন্সি জেলে। অপেক্ষায় আরও অনেকে। দুর্নীতির তদন্তে গ্রেপ্তারি এড়াতে শুধু পিসির ভাইপো এই যোগ্যতায় রাজ্য সরকারের খরচে সুপ্রিম কোর্টে আইনজীবী নিয়োগ করা হয়েছে। রক্ষাকবচ মেলেনি, কোনও গণৎকার হয়ত বলেছে কালো শার্ট পরলে শনির দশা কাটবে, ভাইপো তাও করছে। ডুবন্ত মানুষ খড়কুটো ধরে বাঁচতে চায়। কালীঘাট এখন নিজেদের বাঁচাতে বিজেপি-কে রাজ্যের যতটা বেচা যায় তার রফা আলোচনায় গোপন চেষ্টা চালাচ্ছে, যেমন এতকাল চালিয়েছে। আরেকদিকে জনগণের তৃণমূল সম্পর্কে যে ঘৃণা তৈরি হয়েছে তার মেরামতি করার চেষ্টাও করছে। এদিকে নিজের দলের বেহাল অবস্থা। একাংশ আর এত অন্যায়, দুর্নীতির সঙ্গে থেকে অসম্মানের ভাগীদার হতে চাইছে না। কংগ্রেসের বিধায়ক কিনে শক্তি দেখানোর চেষ্টা করলেও, এটাও যে তাদের বিরুদ্ধে গেল তা বোঝার বুদ্ধি আজ এই বিপদে তৃণমূলের মাথায় নেই। একটা বিধায়ক কিনে কী লাভ হলো, যেখানে হাজার হাজার তৃণমূল কর্মী, সমর্থকদের দল ছেড়ে চলে যাওয়া আটকাতে পারছে না তৃণমূল। 


পুরানো যুগের রাজা রাজড়াদের মতো তাঁবু নিয়ে শিকার শিকার খেলতে বেরিয়েছে ভাইপো। ৫২ গাড়ির দামি কনভয়। বাবুর্চি, খানসামা, লোক-লস্কর, হাতি-ঘোড়া। তটস্থ আইএএস-আইপিএস অফিসাররা, এসডিও, বিডিও থেকে থানার আইসি মায় কনস্টেবল পর্যন্ত। সার্কাস পার্টি আসার আগে লাঠি মেরে রাস্তা থেকে অবাধ্য প্রজা হটাচ্ছে আড়াই হাজার পুলিশ থেকে সিভিক। যদি অভদ্র প্রজা "চোর চোর" বলে চেঁচিয়ে ওঠে, যদি ঘরের তালিকা, রেগার টাকা, স্কুলের চাকরি, বালি-কয়লা-গোরু পাচার নিয়ে প্রজারা ঘিরে ধরে পিসির প্রতিনিধি ভাইপোকে, তাই রাজার পুলিশ নির্মম হাতে জনতাকে পিটিয়ে সরাচ্ছে ভাইপোর পথ থেকে। উত্তর ২৪ পরগনায় ভাইপো আসছে ১০ জুন। পুলিশ প্রশাসনের ঘুম নেই আপ্যায়নের চিন্তায়। আসার আগেই লাল ঝান্ডার সমুদ্রের কথা জেনেই ভাইপোকে আসতে হবে। গোষ্ঠী কোন্দলে দীর্ণবিদীর্ণ তৃণমূল। ভাইপো ভুলেও পা রাখবেন না বারাকপুর, বারাসতে। চলেছেন সীমান্ত দেখতে। পড়ন্ত বিকেলে ইছামতীর হাওয়া খেয়ে কালীঘাটে ফিরতে পরামর্শ দিচ্ছি। যে ভাটা তৃণমূলে চলছে তাতে চোরেরাও বুঝছে চোর জোয়ার আর আসবে না বঙ্গে। লাল জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে গ্রাম, শহর। ভাড়া করা গেরুয়া দিয়ে লাভ হবে না। 
স্বৈরাচারের আরেকটি অস্ত্র সন্ত্রাস। ভয়ে মানুষকে কুঁকড়ে দেওয়া। পিসি-ভাইপো বুঝছে ওদের পৈতৃক জমিদারির যুগ শেষ। আর ভয় পাচ্ছে না মানুষ। নভেম্বর থেকে চোর তাড়াতে গ্রামে শহরে জোট বেঁধেছে মানুষ। পঞ্চায়েত আর ব্লকে বিক্ষোভ ফেটে পড়েছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ আগ্রহের সঙ্গে তৃণমূলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদনে সই দিয়েছেন সপরিবারে। তৃণমূল সমর্থকরাও দলে দলে সই করছেন। পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে রোজ। তা বুঝেই মুখ্যমন্ত্রীর মনে পড়েছে তাঁর “বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না খ্যাত” সুব্রতদার কথা, ‘‘সিপিএমকে সপ্তাহে একদিন পেটাতে হবে’’। দেওয়ালের লিখন আজ আর মুখ্যমন্ত্রীর চোখে পড়ে না। অনেক ক্ষমতা মানুষকে দাম্ভিক আর দৃষ্টিহীন করে দেয়। উনি বুঝছেন না আজ মারলে, পালটা মার তার চোর জোচ্চর ভাইদের কপালে জুটবে। 


উত্তর ২৪ পরগনা জেলায় পুলিশের সাহায্যে সৃষ্টি করা তৃণমূলী সন্ত্রাসের ঘাঁটি একটার পর একটা ভেঙে পড়ছে। গ্রাম জাগানো থেকে শুরু করে ঘর, রেগার বকেয়া টাকা, খেতমজুরের মজুরি, শ্রমজীবী মানুষের জীবন ও জীবিকার দাবি, বেকারের কাজের দাবিতে আন্দোলনের পর আন্দোলনে উত্তাল হয়েছে গোটা জেলা। এই আন্দোলনকে দমাতে পুলিশি সন্ত্রাস নামিয়ে আনা হয়। ১০ জন ছাত্র-যুব কর্মীকে মিথ্যা মামলায় ১৪ দিন জেল খাটিয়েছে দলদাস পুলিশ। আক্রমণের পর আক্রমণ যেমন হয়েছে জেলার নানা প্রান্তে তেমনই তৃণমূলকে এবার প্রতিরোধের সামনে পড়তে হয়েছে। বারাসাত ২ ব্লক, হাড়োয়া, মিনাখাঁ, সন্দেশখালি, বারাকপুর, হালিশহর, বিরাটি-বিশরপাড়ায় গত ৭ দিনে বেপরোয়া আক্রমণ চালানো হয়েছে, পুলিশের সাহায্যে। তৃণমূল ও পুলিশ প্রতিটি জায়গাতেই টের পেয়েছে হার না মানা প্রতিরোধের শক্তির। আমডাঙায় লড়াই চলছে আজও। বারাসত ২ ব্লকে দীর্ঘকাল ধরে চলা সন্ত্রাসের রাজত্ব ভেঙে পড়েছে। এই মুহূর্তে পার্টির ৯ জন কর্মী, তৃণমূলের আক্রমণে গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কিন্তু জেনে রাখা ভালো গ্রামের মানুষের প্রতিরোধের সামনে দুষ্কৃতীদের পালাতে হয়েছে। কাতারে কাতারে মানুষ প্রতিদিন লাল ঝান্ডা ধরছেন। নির্লজ্জ থানা প্রশাসন তৃণমূলকে সব সাহায্য করলেও শেষ অবধি তারাও পারবে না জনজোয়ার আটকাতে। আক্রমণ মোকাবিলা করেই কয়েক হাজার মানুষ শুধু শাসন আর তার সংলগ্ন এলাকা থেকেই আসবেন। 


২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচন পরবর্তীতে বিজেপি অদৃশ্য হয়ে গেছে পাড়ায়, পাড়ায়। বিভাজনের ছক বানচাল হয়েছে। সংখ্যালঘু, তফসিলি জাতি-উপজাতি, আদিবাসি মানুষকে টুকরো টুকরো করে ভোট ব্যাঙ্ক যা দুই পার্টি তৈরি করেছিল আজ তাও ভেঙে যাচ্ছে। দুই শাসক পার্টিরই মাথা খারাপ হচ্ছে সিপিআই(এম)’র শক্তি বৃদ্ধি দেখে। বিজেপি’র টেলিভিশন অভিনেতা কয়েকজন থাকলেও এত বিস্তীর্ণ জেলার পাড়ায় পাড়ায় মানুষ কোনও বিজেপি-কে চেনেন না। দুই পার্টিই জানছেন সিপি আই(এম) কর্মীরা প্রতিটি বুথে মানুষের বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন। মানুষের আস্থা, বিশ্বাস যে লাল ঝান্ডার প্রতি বহুগুণ বেড়েছে তা বুঝেই বিজেপি-আরএসএস তৎপর তা রুখতে। চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র, সন্ত্রাস, আক্রমণ, পুলিশি নির্যাতন কোনও কিছুই কমিউনিস্ট পার্টিকে ধ্বংস করতে পারে না। বরং ফিনিক্সের মতো নতুন শক্তি, নতুন উদ্যম নিয়ে হাজির হয়। কমিউনিস্টরাই গরিব, মেহনতি মানুষের প্রকৃত বিশ্বস্ত সাথি, পরম বন্ধু, তা মানুষ জীবনের অভিজ্ঞতায় বুঝছেন। 
মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার লড়াইকে বিস্তৃত করতে, দুর্নীতিমুক্ত বাংলা গড়তে, রুটি-রুজি, জীবন-জীবিকার দাবিতে,  মানুষের পঞ্চায়েত গড়ার চ্যালেঞ্জ জানাতে মঙ্গলবার জেলার সব পথ মিশবে বারাসতের কাছারি ময়দানে। জনসমুদ্রের কাছে কাছারি ময়দান হয়ে যাবে নিতান্তই ছোট, গোটা বারাসত দেখবে লাল ঝান্ডা হাতে মানুষের ঐতিহাসিক প্লাবন।

Comments :0

Login to leave a comment