post editorial

রেলের মমতাই রাজ্যের মমতা

উত্তর সম্পাদকীয়​

চন্দন দাস
 

বাহানাগায় রেল দুর্ঘটনা হয়েছে। প্রায় ৩০০জনের মৃত্যু হয়েছে। মমতা ব্যানার্জি একাধিকবার ওডিশা গিয়েছেন। রেলমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এবং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির মধ্যে বিশেষ মিল। এবারের রেল দুর্ঘটনার প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গেলে তা স্পষ্ট।
বাহানাগা আর বাংলার মধ্যে একটি ব্রিজ আছে— যোগসূত্র।
তার জন্য আগে ১৪ বছর আগে যাওয়া যাক। ২০০৯-র জুলাই। মমতা ব্যানার্জি তখন রেলমন্ত্রী। ‘ইন্ডিয়ান রেলওয়ে ভিশন ২০২০’ ঘোষণা করেছিলেন তিনি। বরাবরই এমন ‘ভিশন’, ‘মিশন’ নামের নথি প্রকাশ করে হৈ চৈ ফেলে দেওয়া তৃণমূল নেত্রীর কৌশল। ২০০৯-র সেই ‘ভিশন’-এও চমকে দেওয়ার মত অনেক কথা ছিল। সেই নথিতে ওয়ার্ল্ড ক্লাস স্টেশন, রোলিং স্টক ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট, লজিস্টিক হাব, কিশান ভিশান প্রজেক্ট, হাই-স্পিড করিডর, অপটিক্যাল ফাইবার ছড়িয়ে দেওয়া, নতুন লাইন, ডেডিকেটেড ফ্রেট করিডরের মত শব্দগুচ্ছ।
তৃণমূল নেত্রীর ‘ভিশন’-এ আর কী ছিল? 


ছিল শূন্যপদ, রেলে নতুন চাকরির কথা। ওই নথিটির ১৫ নম্বর পাতায় লেখা হয়েছিল,‘‘ভারতীয় রেলওয়েতে পৃথিবীর অন্যতম বেশি, ১.৪ মিলিয়ন ওয়ার্ক ফোর্স (কর্মী) আছে। এই দায়বদ্ধ ওয়ার্কফোর্স (কর্মীবাহিনী) ভারতীয় রেলওয়ের শক্তির প্রধান স্তম্ভ।’’ কী চমৎকার লিখেছিলেন মমতা ব্যানার্জি! কিন্তু তারপরই আছে,‘‘...কর্পোরেট পলিসি অনুসারে, ভারতীয় রেলওয়ে একটি লক্ষ্য স্থির করেছে। তা হলো, প্রতিবছর অনুমোদিত পদের ১% করে কমানো হবে। তাছাড়াও রেলে প্রতি বছর ৩% করে কর্মীসংখ্যার ক্ষয় হয়।’’
রেলে বেসরকারিকরণেও দারুণ ভূমিকা ছিল মমতা ব্যানার্জির। এখন তিনি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার নীতির বিরুদ্ধে মাঝেমাঝেই বলেন। অথচ মমতা ব্যানার্জিই রেলে বেসরকারি টাকার ঢালাও ব্যবহারের পক্ষে সওয়াল করে রেলমন্ত্রী থাকাকালীন লিখেছিলেন যে, সেই ওয়ার্ল্ড ক্লাস স্টেশন, রোলিং স্টক ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট, লজিস্টিক হাব, কিশান ভিশান প্রজেক্ট, হাই-স্পিড করিডর, অপটিক্যাল ফাইবার ছড়িয়ে দেওয়া, নতুন লাইন, ডেডিকেটেড ফ্রেট করিডরের মত বড় পরিকাঠামো তৈরির কাজে বেসরকারি বিনিয়োগকে স্বাগত জানানো হবে।
মমতা ব্যানার্জি জানতেন, বেসরকারি সংস্থাগুলি রাষ্ট্রায়ত্ত ভারতীয় রেলে ‘দানছত্র’ করতে মোটেই আসবে না। আসেওনি। তাদের কোন কোন ধান্দা পূরণের প্রতিশ্রুতি মমতা ব্যানার্জি দিয়েছিলেন, তা ভিশন ডকুমেন্টে লেখা হয়নি। সিঙ্গুরে কিষান ভিশান বানানো হয়েছিল। সরকারি টাকায়। এবং পুরো টাকা জলে গেছে।
রেলে চাকরি, শূন্যপদ পূরণে মমতা ব্যানার্জির ট্র্যাক রেকর্ড কেমন? 


সিএজি রিপোর্ট জানায় ২০০৯-র মার্চে রেলে কর্মী ছিলেন ১২লক্ষ ৯৬ হাজার। একবছরের মধ্যে তা কমে নেমে আসে ১২লক্ষ ৭২ হাজারে। মমতা ব্যানার্জি দ্বিতীয় ইউপিএ সরকার থেকে বেরিয়ে আসেন ২০১২-র সেপ্টেম্বরে। পরে দেখা যাচ্ছে পদ সঙ্কোচনের সেই নীতিতে রেলের কর্মীসংখ্যা সেই আর্থিক বছরে দাঁড়িয়েছিল ১২ লক্ষ ১৮ হাজারে। নিয়োগ তো দূরের কথা। নতুন নিয়োগ পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি। মেট্রো, পূর্ব রেল, দক্ষিণ-পূর্ব রেল সহ ভারতীয় রেলের জোনগুলিতে অপারেটিং, সিভিল, মেকানিক্যাল এবং ইলেক্ট্রিক্যাল — এই চারটি ডিপার্টমেন্টে শুধুমাত্র ‘সেফটি ক্যাটাগরি’-তে তখন পদের সংখ্যা ছিল ৫ লক্ষ ১২ হাজার ১৮৬। মমতা ব্যানার্জি যখন রেলমন্ত্রী হন সিএজি তার রিপোর্টে জানিয়েছিল, তখন ওই সেফটি ক্যাটাগরির পদের মধ্যে ৮৬হাজার ১০২টি পদ শূন্য ছিল। তার একটিও পূরণ করেননি মমতা ব্যানার্জি। পদগুলিই অবলুপ্ত করে দেওয়ার পরিকল্পনার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি।
কেন্দ্রে যখন এই নীতি নেওয়া হয়, তখন দ্বিতীয় ইউপিএ সরকার। প্রথম ইউপিএ সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থন দিয়েছিল বামপন্থীরা। সেই সময়ে রেগার মত প্রকল্প শুরু হয়েছিল। আদিবাসীদের বনাঞ্চলের জমি দেওয়ার নীতিও সেই সময়েই। বামপন্থীরা এই প্রশ্নে লাগাতার চাপ দিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকারকে। মমতা ব্যানার্জি দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের শরিক। তিনি রেলমন্ত্রী হিসাবে চাকরির সুযোগ কমানো, শূন্যপদ পুরোপুরি তুলে দেওয়া, সরকারি লাভজনক ক্ষেত্রকে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার মত কাজই করেছিলেন।
নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি সরকার সেই বেসরকারিকরণ, বিলগ্নীকরণ, চাকরির সুযোগ কমানোর নীতিই প্রয়োগ করছে— আরও প্রবলভাবে।
মমতা ব্যানার্জি সে পথের বিরোধী তো ননই, আসলে ঘোর সমর্থক। 
২০০৯-এও ছিলেন। এখনও আছেন।


জবাব বালেশ্বরের দুর্ঘটনায়। হতাহতদের সিংহভাগ পশ্চিমবঙ্গবাসী। তাঁদের বেশিরভাগ পরিযায়ী শ্রমিক— অর্থাৎ ভিন রাজ্যের সস্তা শ্রম। মোদ্দা কথা, রাজ্যে কাজ নেই। তাই অনেকেই ভিন রাজ্যে কাজের খোঁজে যাচ্ছিলেন। যেমন রাজ্যের মানুষ যান। কয়েক লক্ষ। 
রাজ্যে কাজ নেই কেন? দুটি কথা উঠে আসছে দুর্ঘটনার পরে। প্রথমত, রাজ্যে রেগারও কাজ নেই। প্রায় দেড় বছর টাকা দিচ্ছে না কেন্দ্রীয় সরকার। অভিযোগ রাজ্যে তৃণমূলের পঞ্চায়েতগুলি রেগায় দেদার অনিয়ম করেছে। অর্থাৎ টাকা চুরি করেছে। নানা কৌশলে। ২০১৩-তে প্রথমবার মমতা ব্যানার্জির শাসনে পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়েছে। রাজ্যের প্রতিটি প্রায় প্রতিটি পঞ্চায়েত গায়ের জোরে তারা দখল করেছে। তারপর থেকে রেগায় দেদার চুরি হয়েছে। এই অভিযোগ বামফ্রন্ট ২০১৪ থেকে বারবার জানিয়েছে। মোদী সরকার কান দেয়নি। কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের অন্যতম লক্ষ্য রেগাকে তুলে দেওয়া। বাজেটে তারা লাগাতার রেগার বরাদ্দ কমিয়েছে। রেগার গুরুত্ব কমানোর চেষ্টা করা হয়েছে মোদী-শাসনে। আর রাজ্যে রেগাকে একটি বেপরোয়া চুরির প্রকল্পে পরিণত করেছে তৃণমূল-শাসন। বিজেপি টাকা বন্ধ করেছে কখন? যখন জনমানসে রেগার গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা খাটো করে দিয়েছে তৃণমূলীরা। দেড় বছর রাজ্যে রেগা বন্ধ। কী করেছে তৃণমূল? সভায় ভাষণ দিয়েছে। ফাঁকা হুঁশিয়ারি দিয়েছে। ২২টি সাংসদ নিয়ে, রাজ্যে প্রায় ২২৫জন বিধায়ক নিয়ে রেগা ফিরিয়ে আনার জন্য কোনও ভূমিকাই মমতা ব্যানার্জির দল পালন করেনি।
কারণ— রেগার লক্ষ্য মমতা ব্যানার্জি মানেন না। নয়া আর্থিক নীতিতে বিধ্বস্ত গ্রামীণ গরিবের জন্য ১০০ দিন কাজের নিশ্চয়তা, কাজ না দিতে পারলে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নীতি তৃণমূলের নীতি নয়। রেগা ঠিক মত প্রয়োগ হলে, গ্রামের গরিবের কাজের কিছু নিশ্চয়তা হলে দেশে সস্তা শ্রমের বাজার অল্প হলেও ধাক্কা খাবে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে যাওয়া গরিবদের ভিন রাজ্যে যেমন খুশি, কোনও নিরাপত্তা ছাড়াই খাটানোর কৌশল সামান্য হলেও ধাক্কা খাবে।
বিজেপি চায় না। তৃণমূলও চায় না। রেগা এই দুই শক্তিই পূর্ণোদ্যমে চালু করতে চায় না। বামফ্রন্ট যখন তৃণমূলের চুরি আটকাতে পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছিল, তখন কেন্দ্র সেই উদ্যোগ নিলে চুরি বন্ধ হতে পারত। অন্তত কিছুটা। রেগা চালু থাকতে পারত এখন। কেন্দ্রীয় সরকার এমন সময় বন্ধ করেছে, যখন তা থেকে তৃণমূল আর বিজেপি— দুটি দল ফায়দা পেতে পারে ভোটে। বিজেপি বলবে, তৃণমূল চুরি করে। তাই রেগা বন্ধ। আর তৃণমূল বলবে, বলছেও— আমাদের প্যাঁচে ফেলতে রেগা বন্ধ। আসলে দুজনেই চায় না রেগা চালু হোক। কারণ— গরিব গ্রামবাসীদের সামনে আয়ের দ্বিতীয় কোনও রাস্তা তারা চায় না।


বালেশ্বরের ট্রেন দুর্ঘটনায় আহতদের কথায় বারবার উঠে এসেছে রাজ্যে রেগারও কোনও কাজ না থাকার কথা।
দ্বিতীয়ত, রাজ্যে গত ১২ বছরে বড়, মাঝারি শিল্পে কোনও অগ্রগতি হয়নি। ক্ষুদ্রশিল্পে বিরাট সাফল্য দাবি করে তৃণমূলের সরকার। কিন্তু বড়, মাঝারি শিল্পের সম্ভাবনাই যেখানে মুখ থুবড়ে পড়েছে, সেখানে ক্ষুদ্রশিল্পের সাফল্য আসতে পারে না।
রাজ্যে মমতা ব্যানার্জি কতগুলি শিল্প সম্মেলন করেছেন, তার মোদ্দা ফল হয়েছে অশ্বডিম্ব, রাজ্যে গত ১২ বছরে কোনও বড় শিল্প হয়নি, ২০১১-তে তাঁর দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলি সব এখন স্রেফ ভাঁওতায় পরিণত হয়েছে— এই সবকিছুই প্রমাণিত। দুটি বিষয় এই ক্ষেত্রে স্পষ্ট। এক, শিল্পের যে নতুন সম্ভাবনা পশ্চিমবঙ্গকে ঘিরে তৈরি হয়েছিল বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে, তাকে ধ্বংস করেছিল তৃণমূল এবং তাদের তৎকালীন সহযোগীরা। সেই দলে বিজেপি ছিল। আজকের অবস্থায় পশ্চিমবঙ্গকে পৌঁছে দেওয়ার ‘ভিশন’ তৈরি হয়েছিল ২০০৬ পরবর্তী সময়ে। গুজরাট, কর্নাটক, ওডিশার সামনে পশ্চিমবঙ্গ প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়াক— এটি বহুজাতিকরা চায়নি। তাই বিজেপিও চায়নি। তৃণমূলও না। দুই, রাজ্য সরকারের শূন্যপদগুলি পূরণের প্রতিশ্রুতি ছিল মমতা ব্যানার্জির। ২০১১-য় বিধানসভা নির্বাচন উপলক্ষে তাঁর ঢাউশ ইশ্‌তেহার দেখলেই তা বোঝা যাবে। কিন্তু গত ১২ বছরে রাজ্যের শূন্যপদ পূরণ হয়নি। 
রেলেও ঠিক একই পদ্ধতির কথা ‘ভিশন ২০২০’-তে ঘোষণা করেছিলেন মমতা ব্যানার্জি। 
তাঁর পথ কী তিনি রেলের মন্ত্রী থাকাকালীনই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। 


রাজ্যে শূন্যপদ পূরণের চেষ্টার নামে কী হয়েছে, তা আজকালের নিয়োগ-দুর্নীতির দিকে তাকালেই বোঝা যায়। সেখানেও দেদার লোক ঠকিয়ে চুরি করেছে তৃণমূল। রাজ্য সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গত ১২ বছরে যা নিয়োগ হয়েছে, তার বেশিরভাগ চুক্তিতে। ঠিকাকর্মী, চুক্তিভিত্তিক কর্মী নিয়োগ করেছেন মমতা ব্যানার্জি। এমনকি পুলিশেও একই পদ্ধতিতে নিয়োগ হয়েছে— ‘সিভিক’-র নামে। যাঁদের কাজের কোনও নিশ্চয়তা নেই, নেই অবসরকালীন কোনও নিরাপত্তা। তাঁরা সবসময় আশঙ্কায় থাকেন। তাই তাঁদের প্রশাসনে থেকে তৃণমূলের পক্ষে যা খুশি করানো সহজ।
এটিও সস্তায় শ্রম ব্যবহারের কৌশল। গরিব, মধ্যবিত্তকে চাপে রেখে, ভয় দেখিয়ে চূড়ান্ত নিরাপত্তাহীনতায় কাজ করিয়ে নেওয়ার পন্থা।
এই নীতিকে ধাক্কা দিতে হলে এখন তৃণমূল আর বিজেপি’কে হারাতেই হবে। আর সেই নীতির মুখ উল্‌টো দিকে ঘুরিয়ে দিতে হলে সিপিআই(এম)কে শক্তিশালী করতে হবে। জয়ী করতে হবে।
বালেশ্বরে মমতা ব্যানার্জি যতবারই যান, তাতে এই সত্য বদলাবে না।

Comments :0

Login to leave a comment