INDIAN CONSTITUTION

বৈচিত্রের ভিতেই দাঁড়িয়ে রয়েছে ভারতীয় সংবিধান

জাতীয় বিশেষ বিভাগ ফিচার পাতা

independence day 77th independence day indian constitution indian politics rss bjp bengali news

অনিন্দ্য হাজরা

 

১৯৪৭ সাল থেকে আরএসএস-এর প্রচারের অন্যতম প্রধান অভিমুখ হল সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করতে হবে। এর স্বপক্ষে সাধারণত যুক্তি দেওয়া হয়, কাশ্মীরে পৃথক সংবিধান রয়েছে, তার ফলে  কাশ্মীরীরা নিজেদেরকে ভারতীয় বলে মনে করে না। তাই কাশ্মীরিদের 'সহি' ভারতভুক্তির জন্য, এবং তাঁদের 'ভারতভক্তি' সুনিশ্চিত করার জন্য ৩৭০ ধারা রদ করা প্রয়োজন। 
২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরে এই ধারা বাতিল করেছে বিজেপি সরকার।

এখানে দুটো প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। প্রথমত, কাশ্মীরের ৩৭০ ধারার প্রয়োজন হলো কেন? এবং দ্বিতীয়ত, কাশ্মীরের মতন পৃথক সাংবিধানিক অধিকার দেশের আর অন্য কোন প্রান্তের জন্য প্রযোজ্য কিনা।

প্রথমেই আসা যাক ৩৭০ এর প্রসঙ্গে। স্বাধীনতার প্রাক্কালে ব্রিটিশ ভারতে ২  ধরনের রাজ্য ছিল। একটি ছিল 'ব্রিটিশ প্রভিন্স' যা সরাসরি ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ছিল। আর ছিল ৫৫২টি রাজন্য শাসিত রাজ্য। স্বাধীনতার সময় এই রাজন্য শাসিত রাজ্য বা 'প্রিন্সলী স্টেট' গুলিকে তিনটি সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। প্রথমত ভারত ভুক্তি। দ্বিতীয়তঃ পাকিস্তানে যোগ দেওয়া। এবং তৃতীয়ত স্বাধীন দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করা।

বর্তমান জম্মু-কাশ্মীর ছিল রাজন্য শাসিত অঞ্চল। ডোগরা রাজবংশের অধীনে। ডোগরা রাজা হরি সিং সিদ্ধান্ত নেন, তিনি ভারত কিংবা পাকিস্তানে যোগ দেবেন না। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত বলবৎ করতে যে পরিমাণ জনসমর্থন লাগে, তা হরি সিং এর ছিল না। এর প্রধান কারণ ছিল হরি সিং এর হিন্দু সামন্তরা মুসলমান প্রজাদের উপর চরম অত্যাচার চালাত। কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ কোনভাবেই রাজতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকতে চাইছিলেন না। 
এরই মাঝে, পাকিস্তান সেনার মদতে পাক উপজাতিগুলির একটি হানাদার বাহিনী কাশ্মীরে প্রবেশ করে। হরি সিং এর সেনাবাহিনীর একটা অংশ সেদিকে ঝুঁকে পড়ে। বিনা যুদ্ধেই কাশ্মীরের একটা বড় অংশের দখল নেয় পাকিস্তান। এই অঞ্চলকে পাক অধিকৃত কাশ্মীর বলা হয়।

পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ভারতের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন হরি সিং। জওহরলাল নেহেরু এবং সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের উদ্যোগে ভারতীয় সেনা কাশ্মীরে প্রবেশ করে। বর্তমান এলওসি বা নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর পাক বাহিনীর অগ্রগতি রুখে দেয় ভারতীয় সেনা।

একই সঙ্গে ভারতভুক্তি ঘটে কাশ্মীরের। কাশ্মীরের পাকিস্তান বিরোধী লড়াইয়ে সামনের সারিতে ছিল শেখ আবদুল্লার নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল কনফারেন্স। ন্যাশনাল কনফারেন্সের সশস্ত্র বাহিনী বহু জায়গায়   পাক হানাদারদের হটিয়ে দেয়। কাশ্মীরের ভারত ভুক্তির ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন শেখ আবদুল্লা। এই প্রদেশের 'ইনসানিয়াত' 'জামুরিয়াত' ও 'কাশ্মীরিয়াত' কে সুরক্ষিত রাখতে পাশ হয় ৩৭০ ধারা।

এই ধারার মাধ্যমে, একদিকে কাশ্মীর ভারতের অন্তর্গত হয়। কিন্তু সে রাজ্যের সাধারণ মানুষকে পূর্ণ অধিকার দেওয়া হয় তাদের স্বতন্ত্রতা বজায় রাখার। বলা চলে ভারতীয় সংবিধানের ভিত্তিভূমি বলে পরিচিত বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য সাধিত হয় এই ধারার মাধ্যমে।

যদিও  আরএসএস-র আগ্রাসী উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতি বহুত্ববাদকে অস্বীকার করে। তাদের কাছে স্বতন্ত্রতা মানেই দেশ বিরোধিতা। তাই প্রথম থেকে আরএসএস ৩৭০ এর বিরুদ্ধে সরব হয়েছিল। কাশ্মীরের মানুষকে বিচ্ছিন্নতাবাদী কিংবা দেশদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করেছে তারা। যদিও ইতিহাস বলছে, স্বেচ্ছায় ভারত ভুক্তি মেনে নিয়েছিলেন কাশ্মীরের মানুষ।  যেই সময় গান্ধী হত্যার অভিযোগে আরএসএস নিষিদ্ধ হয়েছে, সেই সময় নিজেদের অধিকার রক্ষায় পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিতে দ্বিধাবোধ করেননি কাশ্মীরের মানুষ ।

এবার আসা যাক দ্বিতীয় প্রসঙ্গে। কেবল ৩৭০ নম্বর ধারা নয় । ভারতবর্ষের বহু রাজ্যে সাংবিধানিকভাবে কিছু বিশেষ সুবিধা পেয়ে আসছে।  এই সবটাই করা হয়েছে দেশের অখন্ডতা ও বহুত্ববাদকে রক্ষার জন্য। ভারতীয়ত্ব মানে এক রঙ কিংবা এক ভাষা নয়। ভারত চেতনার মূলে রয়েছে ভিন্নতা উদযাপন করা। সেই চেতনাকে পূর্ণতা দিয়েছে এই বিশেষ সংস্থানগুলি।

যেমন ধরা যাক ৩৭১ নম্বর ধারার কথা। এই ধারার মাধ্যমে ভারতের রাষ্ট্রপতি গুজরাট এবং মহারাষ্ট্রের রাজ্যপালকে বিশেষ কিছু দায়িত্ব প্রদান করেন। সেই দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, বিদর্ভ , মারাঠওয়ারা, সৌরাষ্ট্র, কচ্ছ প্রভৃতি জায়গার উন্নয়নের জন্য বিশেষ বোর্ড গঠন করা। এবং এই উন্নয়ন বোর্ডের রিপোর্ট প্রতি বছর দুই রাজ্যের বিধানসভায় পেশ করা বাধ্যতামূলক।

একইভাবে সংবিধানের ৩৭১-এ ধারা নাগাল্যান্ডের জন্য বিশেষ কিছু সুবিধার বন্দোবস্ত করেছে। ঐতিহাসিকভাবে নাগাল্যান্ডের ভারতভুক্তির পথ রক্তে রঞ্জিত। সে রাজ্যের নাগা উপজাতি গুলির ভিন্নতা এবং স্বতন্ত্রতা বজায় রাখার জন্যই এই পদক্ষেপ। এই ধারার মাধ্যমে নাগা উপজাতিগুলির সামাজিক প্রথা, সামাজিক আইন রক্ষিত হয়েছে। এই উপজাতিগুলির শাস্তির বিধানও তাদের সামাজিক আইন মোতাবেক হয়। সেখানে আইপিসি বা সিআরপিসি লাগু হয় না।

অসমের উপজাতি নিবিড় অঞ্চল গুলির স্বতন্ত্রতা রক্ষায় রয়েছে ৩৭১-বি ধারা। মণিপুরের পার্বত্য উপজাতিদের অধিকার সুরক্ষিত রয়েছে সংবিধানের ৩৭১-সি ধারায়। প্রসঙ্গত, সেই অধিকার সঙ্কুচিত হওয়ার ফলেই মনিপুরে আগুন জ্বলছে। গোটা দেশকে গেরুয়া রঙে রাঙাতে গিয়ে দেশের অখণ্ডতাকে  প্রশ্নের মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে নরেন্দ্র মোদি সরকার।

অন্ধ্রপ্রদেশ এবং তেলেঙ্গানার জন্যও পৃথক সংস্থান রয়েছে সংবিধানে। ৩৭১-ডি এবং ৩৭১-ই ধারা এই দুই রাজ্যের জন্য প্রযোজ্য। 
প্রাথমিকভাবে এই ধারা অখণ্ড অন্ধ্রপ্রদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল। ২০১৪ সালে তেলেঙ্গানা গঠিত হওয়ার পরে, তেলেঙ্গানা এই দুই ধারার সুবিধা পায়।

ভারতীয় সংসদ আইন পাশ করে ১৯৭৫  সালে সিকিমকে ভারতের একটি রাজ্যে পরিণত করে। তার আগে সিকিম একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র ছিল। ভারতভুক্তির পরে সিকিমের মানুষের স্বতন্ত্রতা সুনিশ্চিত করার  জন্য সংবিধানে যুক্ত হয় ৩৭১-এফ ধারা।  সংবিধান সংশোধন করা হয় এর জন্য।

মিজোরামের পার্বত্য উপজাতিদের সুরক্ষা এবং স্বতন্ত্রতা সুনিশ্চিত করার জন্য পাশ  হয় ৩৭১-জি ধারা। অরুণাচল প্রদেশের জন্যও রয়েছে পৃথক সংস্থান। সংবিধানের ৩৭১-এইচ ধারা।

এর পাশাপাশি গোয়া এবং কর্নাটকের ক্ষেত্রেও রয়েছে পৃথক সংস্থান। ৩৭১ আই দ্বারা প্রযোজ্য গেয়ার জন্য, এবং ৩৭১ যে  ধারা প্রযোজ্য কর্নাটকের হায়দ্রাবাদ কর্ণাটক অঞ্চলের জন্য।

সংঘ পরিবার এই বৈচিত্রকে বারবার প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। তাঁদের দাবি, রাজনৈতিক সুবিধার জন্য বিশেষ বিশেষ অঞ্চলকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। আরএসএস'র ভাষায় এটা হল তুষ্টিকরণের রাজনীতি। 

তলিয়ে ভাবলে, এই জাতীয় মানসিকতা জন্ম নেয় অসহিষ্ণুতা থেকে। ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের শিক্ষা হল ‘ইন্টিগ্রেশন' বা সংমিশ্রণ। সেই শিক্ষা থেকে সরে গিয়ে, বৈচিত্রকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করালে দেশের কি অবস্থা হতে পারে, তা মণিপুরের ঘটনা থেকেই স্পষ্ট।

Comments :0

Login to leave a comment