অরুণাভ মিশ্র
বাংলা ভাষায় ‘বিজ্ঞান’ শব্দটি ব্যবহৃত হতো ‘ব্যুৎপত্তিগত ব্যাপক অর্থে’, বিজ্ঞান শিক্ষা চেয়ে লর্ড আমহার্স্টকে রামমোহনের পাঠানো চিঠিটির কিছু আগে পরে । এমনটাই জানিয়েছেন সুকুমার সেন। বিজ্ঞান চর্চা ও লেখালেখির কাজ আমাদের দেশে ইউরোপীয়রা শুরু করে এবং বিজ্ঞানের বদলে ‘বিদ্যা’ কথাটি তখন চালু ছিল। শ্রী সেন বলেছেন, বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বিজ্ঞান রহস্য’ প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে ‘বিদ্যা’র বদলে ‘বিজ্ঞান’ শব্দটির উপর সিলমোহর পড়ে যায়। এদেশে বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা শুরুও হয় ইউরোপীয়দের হাতে। রবার্ট মে’র অঙ্ক পুস্তকং ১৮১৭ সালে লেখা। আর প্রথম দ্বিভাষিক যে পত্রিকায় বাংলায় বিজ্ঞানের লেখালেখি থাকতো তা হলো জন ক্লার্ক মার্শম্যানের ‘দিগদর্শন’ (এপ্রিল ১৮১৮)। এর উদ্যোগ ছিল শ্রীরামপুরের খ্রিস্টান মিশনারিদের। প্রকাশের প্রথম বছরেই পৃথিবীর আকর্ষণের বিবরণ, প্রতিধ্বনি বিষয়ে, পৃথিবীর অসংখ্যভাগ বিষয়ে, কোম্পাসের আকার, চুম্বক পাথরের প্রথম অনুভব, হিন্দুস্থানের সীমা বর্ণনা, বেলুনে সাদলার সাহেবের আকাশ গমন ও কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার প্রভৃতি বিজ্ঞান বিষয়ে লেখা ছিল। লেখা ছিল ভারতবর্ষের স্বাভাবিক বৃক্ষ, বীবর পশুর বিষয়ে, ইংল্যাবন্ডে কয়লার আকর, মকর মৎস্যের বিবরণ প্রভৃতি লেখাও। বাংলায় বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের সেই শুরু ইউরোপীয়দের হাতে।
তারও আগে ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে আর এক ইউরোপীয় মানুষ উইলিয়াম কেরীর উদ্যোগে তৎকালীন গভর্নর লর্ড মার্কুইস ওয়েলেসলি ‘রেগুলেশন-৬’ জারি করে গঙ্গায় সন্তান বিসর্জনের নৃশংস ও অমানবিক প্রথার অবসান ঘটান। ঘটনাক্রমে দেশে ঐ কুপ্রথার অবসানে রেগুলেশন - ৬ জারি হয় ২০ আগস্ট তারিখে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বিসর্জন’ কবিতায় এই কুপ্রথার বলি হয়ে স্বামীহারা মল্লিকার একমাত্র সন্তানটিকেও হারানোর হাহাকার তুলে ধরেছেন। নিবেদিত জ্বরভারাতুর সন্তানের জ্বর তাপ শুষে নিয়ে জাহ্নবী তাকে মায়ের কোলে ফিরিয়ে দেবেন, এই ছিল মল্লিকার বিশ্বাস। আর বাস্তবে মল্লিকার প্রশ্ন ও আর্তি রবীন্দ্রনাথের ভাষাতেই তুলে ধরি —
“….কই মা? কোথায় ?
পরিপূর্ণ চন্দ্রালোকে বিহ্বলা রজনী
গঙ্গা বহি চলি যায় করি কলধ্বনি
চিৎকারী উঠিল নারী, ‘দিবি নে ফিরায়ে?’
মর্মরিল বনভূমি দক্ষিণের বায়ে।”
২০ আগস্টের ‘রেগুলেশন - ৬’ ও কেরী
উইলিইয়াম কেরীর স্মারকলিপিকে ভিত্তি করে গঙ্গায় সন্তান বিসর্জন প্রথার বিষয়ে অনুসন্ধান করেন ওয়েলেসলি। পরে নিশ্চিত হলে জারি হয় রেগুলেশন - ৬ । এতে বলা হয়, —
“ক) গভর্নর জেনারেল-ইন-কাউন্সিলের কাছে একটি অমানবিক ও নৃশংস প্রথার বিষয়ে প্রতিবেদন এসেছে। জানা গিয়েছে সাগরদ্বীপ, বাঁশবেড়িয়া, চৌগাথা ও গঙ্গা নদীর অন্যত্র শিশু সন্তানদের ডুবিয়ে মারা হচ্ছে। কোন কোন জায়গায় শিশুদের জলে ফেলে দেওয়ার পর উদ্ধার করা হলেও সাগরে তা কখনো করা হয় না। হিন্দু আইনে এমন নিষ্ঠুর কুপ্রথার কোনও নিদান নেই। বেশিরভাগ মানুষ এই কুসংস্কারে বিশ্বাস করেন না। এমন কি কোনও হিন্দু বা মুসলমান রাজত্বে এমন কুপ্রথার অস্তিত্ব ছিল না। তাই এই ধরনের শিশুহত্যা বন্ধ করার জন্য বাংলা, উড়িষ্যা ও বেনারসে এই রেগুলেশন জারি করা হলো।
খ) যদি কোনও ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ কোনও শিশুকে ইচ্ছাকৃতভাবে সাগর, গঙ্গা অথবা কোনও নদী, জলাশয়ে ডুবিয়ে মেরে ফেলে তাহলে এমন ব্যক্তি/ ব্যক্তিবর্গকে হত্যার অপরাধে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। এই অপরাধের সহযোগীদেরও একইভাবে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।” (অনুবাদ লেখকের)
কেরী শ্রীরামপুরে আসেন ১৭৯৩ এর ১১ নভেম্বর। পরে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যাপক হন। তাই ভারতে কুসংস্কার ও কুপ্রথার অবসানে আইনি পথে প্রথম উদ্যোগী যে ইউরোপীয়রাই হয়েছিলেন তা না বললেও চলে। আর তাও ঘটেছিল ২০ আগস্ট।
সুকুমার সেন ও বঙ্কিমচন্দ্র
এটাই বাস্তব। এটাই হওয়ার ছিল। মনে রাখতে হবে, এঘটনা রামমোহনের তুহফাৎ লেখারও (১৮০৪) আগে। শ্রী সেনের স্পষ্ট মত, “আমাদের দেশে ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তনের আগে বিজ্ঞানের অনুশীলন অসম্ভব ছিল। তার প্রধান কারণ আমাদের মনের ধারা। এ জগৎ মায়া, এ সংসার মিথ্যা।…এই আধ্যাত্মসর্বস্বতার কুজ্ঝটিকা সর্বদা ঘিরে থাকলে বাস্তব দৃষ্টি প্রসারিত হয় না। বিদেশের হাওয়া এসে সেই কুয়াশা খানিকটা পাতলা করে দিলে পরে তবেই আমাদের বিজ্ঞান অনুসন্ধিৎসা জেগেছে” (বঙ্গ সাহিত্যে বিজ্ঞান, ভূমিকা)। তুহফাৎ- এ রামমোহনের যুক্তিবাদী ভাবনার যে প্রকাশ তাতে এই ঘটনাটি বা অন্য পাশ্চাত্য-প্রভাব ছিল না এমনটা বলা যায় না। ইংরেজি লেখায় তিনি তখন সড়গড় না হলেও, ইংরেজি পড়ে বুঝতে পারেন বলে মনে করেছেন শিবনারায়ণ রায়।
ভারতীয়দের বৈজ্ঞানিক মনন জাগাতে পাশ্চাত্য প্রভাবের কথা বঙ্কিমচন্দ্রও লিখেছেন তাঁর ‘দা স্টাডি অব হিন্দু ফিলোসফি’তে। লিখেছেন,“হিন্দুদের স্কন্ধে এক ভ্রান্ত পদ্ধতিতন্ত্রের বোঝা চাপিয়াছিল। … পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষাবিধান, দর্শন ও বিজ্ঞান চর্চার পক্ষে হীন কর্ম বলিয়া গণ্য হইত। শুধু তাহাই নহে, এমনকি অবরোহী প্রণালীকেও যুক্তিসম্মত পরিণতির অভিমুখে যাইতে দেওয়া হইত না।। ফলত অবরোহী প্রণালীর শ্রেষ্ঠতর আয়ুধে সজ্জিত হইয়াও হিন্দু চিন্তাবিদগণ কল্পনাত্মক সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়া সন্তুষ্ট থাকিতেন। প্রায় অলৌকিক মেধাসম্পন্ন ব্যক্তিগণের সম্মুখে সত্যের অতি শক্তিশালী ক্ষণপ্রভা ঝলসাইয়া উঠিত, কিন্তু হিন্দু ঋষিগণ তাহার আলোয় পথ অনুসরণ করিয়া যুক্তিসম্মত সিদ্ধান্তে উপনীত হইবার প্রয়াস পাইতেন না।” ( বিজ্ঞান ও মতাদর্শ, আশিস লাহিড়ী)
উদাহরণ দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র দেখিয়েছেন কেমন করে ইউরোপে টরিসেল্লি বায়ুর চাপে জলের ৩২ ফুট ওঠার অভিজ্ঞতা বেশি ঘন পারদ ব্যবহার করে কমিয়ে এনেছিলেন। শুধু তাই নয়, পাস্কাল তাকে বায়ুর চাপ মাপায় কাজে লাগানো যাবে তা প্রমাণ করেছিলেন সমতল আর পাহাড়ের উপরে পারদস্তম্ভের ওঠা নামা দেখিয়ে। অথচ, আর্যভট পৃথিবীর আহ্নিক গতি, স্থির জ্যোতিষ্ক, গ্রহের পর্যায় গতি আর সূর্যের বার্ষিক আপাত চলন জানতেন। এসব থেকে যৌক্তিকভাবে সৌরকেন্দ্রিক বিশ্বের সিদ্ধান্ত আসা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু তা প্রমাণ করার কোনও চেষ্টা এখানে হয়নি। কারণ, এই যুক্তিনিষ্ঠ এবং বিশ্লেষণী মনোভাব তখনও এদেশে গড়ে ওঠেনি।
প্রাচীন ভারতীয় জ্ঞানের আস্ফালন!
এসব পুরানো কথা কেন? কারণ ভারতকে আবার ভাববাদী নিগড়ের অন্ধকারময় অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। আইআইটি মান্ডি তে ‘পুনর্জন্ম’, ‘মৃত্যুর কাছাকাছি সময়ে নিজের শরীরের বাইরে থাকার অভিজ্ঞতা’ এবং ‘সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম শরীরের ধারণা’ প্রভৃতি বিষয়ে ৬ মাসের একটি আবশ্যিক কোর্স সকল পড়ুয়াকে পড়তে হবে স্থির হয়েছে। ‘প্রাচীন ভারতীয় জ্ঞান ব্যবস্থা’র (IKS) নামে জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০ তে নতুন যেসব বিষয় যুক্ত হয়েছে এটি তারই অন্তর্ভুক্ত। ২০২২ থেকে এইসব বিষয় পড়ানোর প্রবল প্রচেষ্টা চলছে সর্বত্র। সরকার থেকে প্রভূত অর্থ দেওয়া হচ্ছে এই IKS কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা আর তার গবেষণায়। ২০২৩ থেকে এসব পড়ানোর ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ামক সংস্থা (UGC) থেকে সুনির্দিষ্ট রূপরেখাও করে দেওয়া হয়েছে। ক্যাম্পাসের ভিতরের খবর, বিষয়টি ডিরেক্টর লক্ষ্মীন্দর বেহেরার পছন্দ করা। গত বছর বিষয় ছিল ‘মাংস খাওয়া আর ভূমিধসের সম্পর্ক’। আমরা জানি ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কহীন বিষয়কে যখন সম্পর্কযুক্ত দেখানোর চেষ্টা হয় তখন সেটা অবশ্যই কুসংস্কার। তাই বিষয়টি শিক্ষার্থী মহলে প্রবল তখন সমালোচিত হয়। ফলত এবার বিষয় বদল!
আর একটা সাম্প্রতিক উদাহরণ। ‘ভূতবিদ্যা’ বিষয়ে এবছর ছ’মাসের একটি সার্টিফিকেট কোর্স শুরু করেছে প্রখ্যাত ‘বেনারস হিন্দু ইউনিভারসিটি’। কাদের জন্য জানেন? BAMS আর MBBS, অর্থাৎ আয়ুর্বেদ ও এলোপ্যাথ ডাক্তারদের জন্য। এই অলৌকিক বিষয়ে পড়ে ভাবীকালের ডাক্তাররা নাকি মনোচিকিৎসায় তার প্রয়োগ ঘটাবেন। এমনকি যেসব অসুখ কি কারণে ঘটে বলে আজও জানা যায়নি, তার নিরসনেও ভুতবিদ্যার জ্ঞান ব্যবহৃত হবে। ডাক্তারি পড়ানোর সঙ্গে যুক্ত ১৬টি বিভাগের প্রধানরা একমত হয়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সুতরাং গণতন্ত্র উপচে পড়েছে সিদ্ধান্ত গ্রহণে!
সাংবিধানিক অধিকার, গণতন্ত্র কোথায়?
ভারতীয় সংবিধানের ৭৫তম বার্ষিকীতে এসেছি আমরা। সংবিধানের প্রস্তাবনাতে ভারতবর্ষকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র হিসাবে দেখানো হয়েছে। এই গণতান্ত্রিক মনোভাব স্বাধীন মতপ্রকাশ, বিতর্ক, ভিন্নমত হওয়ার অধিকার, আর নিয়ন্ত্রণহীন জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে বিজ্ঞানের প্রসারের জন্য আবশ্যিক। আজ কি দেশে সেই আবহাওয়া আছে? সংখ্যালঘু ও জাতিগত বৈষম্য আজকে চরম আকার নিয়েছে। গণতান্ত্রিক পরিবেশ ভূলুণ্ঠিত। মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিপন্ন। তথ্য ও প্রমাণ ভিত্তিক যুক্তি এবং বিশ্লেষণী মনোভাবের বৈজ্ঞানিক গ্রাহ্যতাকে প্রতিদিন অস্বীকার করা হচ্ছে। বিপন্ন হচ্ছে সাংবিধানিক অধিকার। সংবিধানের ৫১ এ (এইচ) ধারা, যা বিজ্ঞান মানসিকতা অনুসন্ধিৎসা ও মানবতার বিকাশকে কর্তব্য হিসাবে তুলে ধরে, তা আজ অসহায় দর্শক মাত্র!
সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটির যে ঘটনার কথা এখন বলব সেখানে গণতন্ত্র কোথায়? বিশ্ববিদ্যালয়টি সম্পূর্ণত ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নয়। তবু সেখানে গণতন্ত্র এমনই যে একটি ছাত্রকে তার গবেষণা প্রকল্প লেখার জন্য ক্ষমা চাইতে হয়েছে। তার গবেষণা প্রকল্পের বিষয় ছিল ‘কাশ্মীরের জাতিতত্ত্ব ও রাজনীতি’। বিষয়টি আকর্ষণীয় সন্দেহ নেই। কিন্তু কাল হয়েছে সোশাল মিডিয়ায় নোয়াম চমস্কির সঙ্গে তার ছবি! তাছাড়া, কাশ্মীর সরকারের কাছে একটা আতঙ্কের বিষয়। সেইসঙ্গে বিশ্লেষণী গবেষণা, স্বাধীন চিন্তা, অর্থনৈতিক নীতি আলোচিত হবে এমনটা সরকারের না-পছন্দের। ফলে ছাত্রটির গবেষণা প্রকল্পটি ‘দেশদ্রোহিতা মূলক’ বলে চিহ্নিত করেছে কর্তৃপক্ষ। পূর্ণত ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় না হওয়া সত্ত্বেও তার গবেষণার আঙিনা সংকুচিত ও নিয়ন্ত্রিত আজ। এ থেকে ধারণা করে নিন, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কি চলছে এখন।
বন্ধ হয়ে গেল ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেস
২০২৪ সালে ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেস বন্ধ করে দেওয়া হলো। ২০২৩ সাল থেকে বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ ও বৈজ্ঞানিক মনন গড়ার কাজ করত যে প্রতিষ্ঠান, সেই ‘বিজ্ঞান প্রসার’ বন্ধ। এবার বন্ধ করা হলো মৌলিক বিজ্ঞান গবেষকদের বার্ষিক পারস্পরিক মতবিনিময়ের জায়গা ‘ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেস’। ১৯১৪ সালে কলকাতায় তৈরি হওয়া ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেস অ্যাসোসিয়েশন ছিল প্রতি বছর জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে এই কংগ্রেসের আয়োজক। ৩০,০০০ এর বেশি বিজ্ঞানী এর সদস্য। প্রথম এই কংগ্রেস হয় ১৯১৪ সালের ১৫-১৭ জানুয়ারি, কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির প্রাঙ্গণে। সভাপতি ছিলেন আশুতোষ মুখার্জি। ২০১৫ সাল থেকে এই মঞ্চ ব্যবহার করে ক্রমাগত অবৈজ্ঞানিক প্রচার চালিয়ে আসছিল দেশের সরকার আর তার ধামাধরা বিজ্ঞানীরা। তাই যশস্বী বিজ্ঞানীরা এথেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলেন। প্রতিবাদও করছিলেন। ফলে অ্যাসোসিয়েশন এই অপবৈজ্ঞানিকতা ছড়ানো বন্ধ করতে কংগ্রেসে বক্তারা কি বলবেন তা আগে থেকে জেনে নেবার নিয়ম করেন। এতে প্রমাদ গোনে অপবিজ্ঞানের প্রচারকরা। তাই প্রথমে চেষ্টা হয ‘ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেস অ্যাসোসিয়েশন’ কে দখল করার। তাতে সফল না হওয়ায় কেন্দ্রীয় অর্থ সাহায্য বন্ধ করে এই শতাব্দী প্রাচীন সংগঠন ও তার ঐতিহ্যকে গলা টিপে স্তব্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। দেশের সরকার মৌলিক জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চা যে চায় না এ তার এক উজ্জ্বল উদাহরণ।
আর একটা কারণ হলো বিজ্ঞানভারতী নামে দেশের শাসকদের মদতপুষ্ট বিজ্ঞান সংগঠনকে জনমানসে জায়গা করে দেওয়া। তাদের অন্যতম কাজ পাশ্চাত্য যুক্তিবাদী চিন্তা চেতনাকে নস্যাৎ ও প্রাচ্যের পরীক্ষা ও প্রমাণহীন বিশ্বাসভিত্তিক অপবিজ্ঞানকে মদত। তাদের নীতি হলো ‘সায়েন্স উইথ স্পিরিচুয়ালিটি’। আধ্যাত্মবাদী বিজ্ঞান দর্শনগতভাবে বৈজ্ঞানিক চেতনার পরিপন্থী। ‘সায়েন্স উইথ স্বদেশী স্পিরিট’ তাদের মটো। বিজ্ঞান আন্তর্জাতিক। তাতে দেশ- বিদেশ টেনে, আধ্যাত্মবাদ টেনে অপবিজ্ঞানই করা যেতে পারে, বিজ্ঞান নয়। অথচ সেই বিজ্ঞানভারতীর নেতৃত্বেই প্রতি বছর দেশের সরকারি দপ্তরগুলোর সরাসরি অংশগ্রহণে ‘India International Science Festival’ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সরকার চাইছে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পরম্পরা ও ঐতিহ্যবাহী বিজ্ঞান কংগ্রেস নয়, বিজ্ঞান ভারতীর ফেস্টিভ্যালই প্রতিষ্ঠিত হোক। সরকারের এই বার্তা কি স্পষ্ট নয়?
এসবের অবসান হবে না?
এসবের অবসানকল্পেই আমরা ১৯২৪ এর জাতীয় বিজ্ঞান দিবসে গ্রহণ করেছি ‘বিজ্ঞান মনস্কতার কলকাতা ঘোষণাপত্র’। সারা দেশ থেকে ৪০০র বেশি প্রতিনিধির উপস্থিতিতে এক কনভেনশনে গৃহীত হয়েছে এই ঘোষণাপত্র। এই ঘোষণাপত্রের মুখ্য কথাগুলো হলো, বিজ্ঞান মনস্কতা বিকাশে সাংবিধানিক নাগরিক কর্তব্য থাকলেই শুধু হবে না, রাষ্ট্রের কর্তব্যও সুনির্দিষ্ট করতে হবে। এত বড়, ভাষা ধর্ম, বর্ণ, ও জাতি বৈচিত্রের দেশে রাষ্ট্রের সুস্পষ্ট ও বলিষ্ঠ অংশগ্রহণ ছাড়া সমাজকে বিজ্ঞানমনষ্ক করা যায় না। সেইসঙ্গে বিগত দশ বছরের অভিজ্ঞতা ভিত্তিতে আমাদের স্পষ্ট ঘোষণা, একমাত্র প্রমাণভিত্তিক যুক্তিকেই সমাজে গ্রহণীয় ও প্রতিষ্ঠিত করে তুলতে হবে। কোনও বিশ্বাস বা অতীতগ্রাহ্যতা দিয়ে নয়, একমাত্র প্রমাণভিত্তিক যুক্তি আর বিশ্লেষণী মনোভাব দিয়ে ঠিক হবে সমাজে বা ব্যক্তিজীবনে তা গ্রহণীয় বা গ্রহণীয় নয়, - সেই বিষয়টা। বিচার ব্যবস্থাও যখন বিশ্বাসের ভিত্তিতে রায় দেন, তখন আমাদের যুক্তি ও প্রমাণের ভিত্তিকে আরও শক্ত করে তুলতে হয়। আর প্রতিহত করতে হবে সব বিজ্ঞান বিরোধী এবং অবৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টা। সেকাজে বিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী আর বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানগুলোকে সামনে এগিয়ে আসতে হবে। ডারউইনবাদ আর পিরিয়ডিক টেবল সিলেবাস থেকে মুছে ফেলার পর কেন্দ্রীয় সরকার একাদশ শ্রেণির সিলেবাসে আয়ুর্বেদ শাস্ত্র পড়াতে চাইছে। আয়ুষে দোষ দেখি না। আয়ুর্বেদচর্চা প্রাচীন ভারতে প্রকৃতিবিজ্ঞান চর্চার দুয়ার খুলে দিয়েছিল। কিন্তু ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বা নিরাময়জ্ঞাপক পরীক্ষানিরীক্ষা ছাড়া আজ আয়ুর্বেদের সব প্রাচীন জ্ঞানকে যদি অন্ধবিশ্বাসে সমাজে চালানোর চেষ্টা হয়, তবে কলকাতা ঘোষণাপত্র তুলে ধরে তার প্রতিবাদ করতেই হবে। রক্ষা করতে হবে দেশের ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের আদর্শ। ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে আমাদের বোধকে ষ্পষ্ট করতে হবে। এটা সব ধর্মকে সমান গুরুত্ব বা রাষ্ট্রের কোনও ধর্মে না মদত দেওয়ার প্রশ্ন নয়। এটা আদপে চিন্তা ও বোধের সেই জগৎ যা ষ্পষ্ট ও দৃঢ়ভাবে মানবীয় কাজকর্মে ঈশ্বরের ভূমিকাকে অস্বীকার করে। যে বিশ্বে বাস করি তার বাইরে অন্য কোনও জগৎ নেই - এটাও ধর্মনিরপেক্ষতা দ্যোতক চেতনা। এই বলিষ্ঠ চেতনাগুলোর সঙ্গে জাতি ব্যবস্থার বিলিয়ন ও মানবতাকে আয়ুধ করে তৈরি হয়েছে বিজ্ঞানমনস্কতার কলকাতা ঘোষণাপত্র।
ঘোষণাপত্রের মূল কথা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও সমাজজীবনে প্রতিষ্ঠিত আর লালিত করার জন্য কঠোরতর পরিশ্রম করাই আজকের বিজ্ঞান আন্দোলনের সাংবিধানিক অধিকার ও দায়িত্ব। আসুন সে কাজে আত্মনিয়োগ করি।
Comments :0