MURSHIDABAD MIGRANTS

কিয়স্কে টাকা আসে, সলুয়াডাঙায় আসতে পারেন না শোয়েবরা

রাজ্য

অনিন্দ্য হাজরা, বহরমপুর
বহরমপুর শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে ঠিক ১০ কিলোমিটার দূরে রয়েছে সলুয়াডাঙা বলে একটি গ্রাম। আপাত নিরীহ, শান্ত। বাইরে থেকে দেখলে, মধ্যবঙ্গের আর ৫টা গ্রামের থেকে আলাদা কিছুই নয়। 
কিন্তু এই গ্রামে যে আলাদা বিশেষত্ব রয়েছে, তার ইঙ্গিত দেয় গ্রামের ঠিক মাঝখানে থাকা ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন মানি ট্রান্সফারের কিয়স্ক। 
বহরমপুর শহর থেকে বেরিয়ে, এই তল্লাটে 'মানি ট্রান্সফারের' কিয়স্ক রয়েছে মাত্র ২টো। একটা এই সলুয়াডাঙায়, অপরটি হরিহরপাড়া যাওয়ার পথে কুমারদহ ঘাট লাগোয়া বাজারে। 
এত জায়গা থাকতে সলুয়াডাঙাতেই কেন মানি ট্রান্সফারের কিয়স্ক? 
এর উত্তর মিলল কয়েকশো মিটার এগিয়ে বৈকুন্ঠপুর যাওয়ার রাস্তার উপরে ইমদাদুল শেখের কাছে। দুপুর সাড়ে বারোটায় চায়ের দোকানে ছায়ার খোঁজে তিনি। ইমদাদুলের বড় ভাতিজা শোয়েব কাজ করে ওমানের মাস্কটে। শুধু শোয়েব নয়, বহরমপুর ব্লকের শুধুমাত্র এই সলুয়াডাঙা গ্রামের প্রায় ১৬৭ জন যুবক মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে শ্রম দেন। গ্রামে তাঁরা টাকা পাঠান। সেই টাকা ভারতীয় মুদ্রায় হাতবদল হয় মানি ট্রান্সফারের মাধ্যমে। 
ভাতিজা বিদেশে কাম করে, চাচার তো তাহলে খুশি হওয়ার কথা? 
চাচার উত্তর, ‘‘খুশি হয়ে কী হবে? ছেলেগুলো একবার বাইরে গেলে তিন, সাড়ে তিন বছরের আগে ঘরে ফিরতে পারে না। বাড়িতে বাজ পড়লেও না। বাড়িতে কেউ...’’
অপরিচিত শহরের লোকের সামনে আর মুখ খোলা উচিত হবে না মনে করে হাঁটা লাগালেন ইমদাদুল শেখ। 
তিনি যেটা বললেন না, সেটুকু জানা গেল জামির মোল্লার কাছে। সিপিআই(এম) মুর্শিদাবাদ জেলা কমিটির সম্পাদক। দীর্ঘদিন পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করেছেন। তাঁর কথায়, "বিদেশে যাওয়া ছেলেদের পাসপোর্ট নিয়ে রেখে দেয় দালালরা। বাড়িতে মা মরুক, বাপ মরুক, ঘরে ফেরা যায় না। দাস শ্রমিক বললে কম বলা হয়।" 
মুর্শিদাবাদ জেলায় ৮০ লক্ষের কাছে জনসংখ্যা। আর পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা আনুমানিক ৮ থেকে ১০ লক্ষ, জেলার জনসংখ্যার ১০ শতাংশের আশেপাশে। এই সংখ্যা আনুমানিক, কারণ সরকারের তরফে ব্লক কিংবা জেলা স্তরে কোনও সমীক্ষা হয়নি। এই জেলার গ্রামে যেটুকু পাকা বাড়ি ওঠে, কিংবা সাচ্ছল্যের মুখ দেখে, সবটাই পরিযায়ীদের রক্ত জল করা টাকার বিনিময়ে। কিন্তু তাঁদের বিষয়ে সরকার উদাসীন। বিড়ি কিংবা নির্মাণ শিল্প থেকে সংগৃহীত শ্রমিক কল্যাণ সেস শ্রমিকদের জন্য খরচ হয় না। 
হরিহরপাড়া বিধানসভার মাদারতলা গ্রামের তাজুদ্দিন মন্ডল। তাঁর ভাইয়ের ছেলেও বিদেশে। কুয়েতে। এই ঘরে ৩০-৪০ জন থাকে। তাজুদ্দিনের ক্ষোভ দালালদের উপরেই বেশি। তিনি বলছেন, ‘‘ ১০০ টাকার মজুরির চুক্তি হলে দালালরা ৫০ টাকা পকেটে ঢোকায়। ছেলেদের নিজেদের পয়সায় প্লেনের টিকিট কেটে যেতে হয়। পাসপোর্ট বানাতে থানার মেজবাবু ছোটবাবুরা যা খুশি কাটমানি খায়।’’
জামির মোল্লার কথায়, "১৯৮৯ সালের পরিযায়ী শ্রমিক আইন আছে। সেই আইনে শ্রমিকদের এবং শ্রমিক ঠিকাদারের নাম নথিভুক্ত করার কথা। সেটা হয় না। কন্ট্রাকটর সাব কন্ট্রাকটর দিয়ে কাজ করায়। শ্রমিক প্রভিডেন্ট ফান্ড, ইএসআই কিছুই পায় না। প্রশাসনের কোনও ভূমিকাই নেই।"

জেলার অধিকাংশ ঠিকাদারের লাইসেন্স নেই। সেটা দেখারও কেউ নেই। তার ফলে শ্রমিকেরও নাম নথিভুক্ত হয় না। দুর্ঘটনায় পড়লে কিংবা ভিনরাজ্যে প্রাণ হারালে দেহ বাড়ি ফেরাতে হিমশিম খেতে হয় পরিবারগুলিকে। মেলে না ক্ষতিপূরণ। 
জামির মোল্লার বক্তব্য, ‘‘পরিযায়ীদের স্বার্থ দেখার জন্য কোনও রাজ্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পরিযায়ী কল্যাণ বোর্ড নেই, নেই রেসিডেন্ট অফিসার। দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে সিপিআই(এম) ও সিআইটিইউ সাংগঠনিক ভাবে শক্তিশালী হওয়ায় কিছুটা সুরাহা দেওয়া যায়, কিন্তু উত্তর ভারতে অবস্থা ভয়াবহ।"
তৃণমূলের প্রচারের বক্তব্য, সরকারের তরফে পরিযায়ীদের জন্য ‘স্নেহের পরশ’ ও ‘প্রচেষ্টা’ নামে দু’টি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেটা খায় না মাথায় দেয় তা তাজুদ্দিন মন্ডল কিংবা ইমদাদুল শেখরা জানেন না। 
পরিযায়ীদের সুবিধায় সিপিআই(এম)'র তরফে প্রতিটি ট্রেনে পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য ২টি কামরা সংরক্ষিত করার দাবি তোলা হয়েছে। মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রের প্রচারেও সেই দাবি উঠে এসেছে।
মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রের সিপিআই(এম) প্রার্থী মহম্মদ সেলিমের কথায়, " গ্রামের পর গ্রাম পুরুষশূন্য। সন্তানের জন্ম থেকে শুরু করে মা-বাবার মৃত্যু, পরিবারের পাশে থাকতে পারেন না পরিযায়ীরা। সামাজিক সঙ্কট তৈরি হচ্ছে। গ্রামে কাজ নেই, কাজের জন্য কমবয়সে ড্রপ আউট হয়ে বাইরে চলে যাচ্ছে ছেলেরা।"
পরিযায়ী সঙ্কট ঠেকাতে সিপিআই(এম)'র বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গী কী? 
মহম্মদ সেলিমের ব্যাখ্যা, " এই অঞ্চল কেন্দ্র থেকে দূরে। প্রান্তিক। মূলস্রোতে ফেরাতে প্রয়োজন সড়ক সংযোগ ব্যবস্থা জোরদার করা। কৃষ্ণনগর থেকে রেল লাইন টেনে করিমপুর থেকে জলঙ্গী,  ডোমকল হয়ে ভগবানগোলা অবধি নিয়ে আসতে হবে। ইউপিএ-১ সরকারের সময়ে এই প্রক্রিয়ার বল গড়াতে শুরু করলেও তৃণমূল বিজেপি এসে সব বন্ধ করে দিয়েছে।"
সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক বলছেন, ‘‘আমরা জিতলে মুর্শিদাবাদ অঞ্চলের বাংলাদেশ সীমান্তে বর্ডার হাট তৈরি করা হবে। অর্থনৈতিক হাব তৈরি হবে। বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য গুজরাট, মুম্বাইয়ের বদলে মুর্শিদাবাদ থেকে পরিচালিত হবে। গোটা ব্যবস্থা 'অফিশিয়াল' হলে 'আন-অফিশিয়াল' বাণিজ্য বন্ধ হবে। জেলায় কাজ ও আয় বাড়ার দিগন্ত খুলে যাবে। ভাগীরথীর পূর্ব পাড়ে দীর্ঘদিন উন্নয়ন হয়নি। এক সময়ের মূল কেন্দ্র প্রান্তিক অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। সেটা বদলানোর সময় হয়েছে।’’

গ্রাফিক্স: মনীষ দেব

Comments :0

Login to leave a comment