আর জি করের ঘটনায় একের পর এক সরকারি পুরস্কার ও পদ ফেরাচ্ছেন বিশিষ্ট লেখক, চিত্রকর, অভিনেতা, সুরকার ও ক্রীড়াবিদরা। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্জুন পুরস্কার প্রাপ্ত প্রাক্তন ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় দীপু ঘোষ, চিত্রকর সনাতন দিন্দা ও প্রদোষ পাল, সোমেন চন্দ পুরস্কার প্রাপ্ত লেখক শমীক ঘোষ, অভিনেতা সুপ্রিয় দত্ত, সুরকার শুভদীপ গুহ রাজ্য সরকার প্রদত্ত বিভিন্ন পুরস্কার ও সরকারি পদ প্রত্যাখ্যান করলেন।
বীতশ্রদ্ধ হয়ে বাংলার গৌরব পুরস্কার ফেরাতে চান প্রাক্তন ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় দীপু ঘোষ। দেশের হয়ে একাধিক আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে খেলেছেন। ভাই রমেন ঘোষকে সঙ্গে নিয়ে দু’বার খেলেছেন টমাস কাপের ডাবলসে। সাতবারের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন দীপু ঘোষ। অর্জুন পুরস্কার রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। ভারতীয় ব্যাডমিন্টনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বহু বছর। বর্তমানে তিনি সিঙ্গাপুরের বাসিন্দা। ৮৫ বছরের দীপু ঘোষ রাজ্যের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে বিরক্ত। আপামর বাঙ্গালির মতো তাঁকেও আর জি করের ঘটনা আঘাত করেছে। তাই রাজ্য সরকারের দেওয়া পুরস্কার তিনি ফেরাতে চান। ফেরাতে চান পুরস্কারের প্রাপ্ত এক লক্ষ টাকাও।
বিশিষ্ট চিত্রকর সনাতন দিন্দা রাজ্য সরকারের চারুকলা পর্ষদের পদ ইস্তফা দিতে চেয়ে বলেছেন, আমার বোন ‘তিলোত্তমা দিন্দা’ যাঁকে আমি আমার নিজের বোন বলছি। তার জন্য সারা বাংলা এবং বাংলার বাইরে প্রতিবাদ হচ্ছে। আমি একজন সহ নাগরিক, একজন পিতা হিসাবে প্রতিবাদ জানাচ্ছি। যাঁরা রাজ্য চারুকলা পর্ষদের স্বনামধন্য সদস্য হয়ে আছেন তাঁরা থাকুন। প্রতিবাদে তাঁদের অনেকেরই কোনও ভূমিকা নেই। একজন সন্তানের অভিভাবক হিসাব আমার মনে হচ্ছে এখানে না থাকাই ভালো। তাই আমি বাধ্য হয়ে এই সিদ্ধান্ত নিলাম। শিক্ষক দিবসে আমাদের সন্তানরাই শেখাচ্ছে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’।
রাজ্য সরকারের বাংলা আকাদেমি প্রদত্ত সোমেন চন্দ স্মারক পুরস্কার ফেরালেন সাহিত্যিক শমীক ঘোষ। ২০১৯ সালে তিনি এই পুরস্কার অর্জন করেন। বাংলা আকাদেমির সচিবের কাছে পাঠানো এক বার্তায় সাহিত্যিক শমীক ঘোষ বলেছেন, আর জি কর হাসপাতালের নারকীয় ঘটনা এবং তার পরবর্তী সময়ে রাজ্য সরকার তথা রাজ্য প্রশাসনের ভূমিকা আমাকে গভীর ভাবে হতাশ এবং ব্যথিত করেছে। একইসঙ্গে বিচার চেয়ে আন্দোলরত জুনিয়ার ডাক্তার এবং জনসাধারণের প্রতি রাজ্য প্রশাসন ও রাজ্যের শাসক দলের কিছু নেতা কর্মীর আচরণ ও মন্তব্যের আমি তীব্র নিন্দা জানাই। তিলোত্তমার বিচার চেয়ে প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়া পশ্চিমবঙ্গের আপামর জনসাধারণ ও জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতি সমর্থন ও সংহতি জানাতে আমি এইটুকু অবশ্যই পারি।
রাজ্য চারুকলা পর্ষদের বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী প্রদোষ পালও আর জি করের ঘটনার প্রতিবাদে পর্ষদের পদ ফিরিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। এই মুহূর্তে শিল্পী কলকাতার বাইরে, শহরে ফিরে এ বিষয়ে যাবতীয় করণীয় কাজ সম্পূর্ণ করবেন বলে জানিয়েছেন।
রাজ্যের সাম্প্রতিক নানা ঘটনা এবং আর জি করের চিকিৎসক-পড়ুয়ার খুনের ঘটনার প্রতিবাদে রাজ্য সরকারের দেওয়া শম্ভু মিত্র পুরস্কার ফিরিয়ে দিতে চেয়ে তথ্য ও সংস্কৃতি সচিবকে চিঠি দিয়েছেন বিশিষ্ট সুরকার শুভদীপ গুহ। বাবান নামে অধিক পরিচিত এই শিল্পী নাটকের নেপথ্য সঙ্গীতের সঙ্গে যুক্ত। তাঁর সুরে ও সঙ্গীত পরিচালনায় বহু নাটক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। তিনি বলেছেন, সরকার যদি মনে করেন পুরস্কার দিয়ে শিল্পীদের কণ্ঠরোধ করবেন তাহলে মিথ্যের স্বর্গে বাস করছে।
নাটক ও চলচ্চিত্রে সমান জনপ্রিয় অভিনেতা সুপ্রিয় দত্ত ২০২১ সালে নাট্য আকাদেমির বিশিষ্ট চরিত্রাভিনেতার সম্মান অর্জন করেন। সুপ্রিয় দত্ত তাঁর পুরস্কার ও অর্থমূল্য ফেরত দিতে চেয়ে নাট্য আকাদেমির সচিবকে চিঠি দিয়েছেন। এই পুরস্কার ফেরত দিয়ে তিনি গ্লানিমুক্ত হতে চান। কারণ আর জি কর হাসপাতালের নারকীয় ঘটনার পর শাসকের ভূমিকা শিল্পীকে স্তম্ভিত করেছে। শাসক ও তার পদলেহনকারী পুলিশ প্রশাসনের প্রতিটি পদক্ষেপ প্রমাণ করেছে সত্যকে আড়াল করতে তারা কতটা মরিয়া। একজন কন্যা সন্তানের পিতা হিসাবে তিনি ভীত, সন্ত্রস্ত। তিনি আরও বলেন, পাশাপাশি শাসকের প্রতিনিধি কাঞ্চন মল্লিকের কথায় বুঝলাম শাসক আসলে পুরস্কার এবং সম্মানের বিনিময়ে মোসাহেব খরিদ করে। শাসক চায় একদল অমেরুদণ্ডী চাটুকারের ব্যাটেলিয়ন। কাঞ্চনের কথা আসলে সরকারেরই ঘোষিত বা অঘোষিত আদেশনামা, সত্য নয় এই সম্মান। এই অবস্থায় অভিনেতা সুপ্রিয় দত্ত সত্যের পথকেই বেছে নিয়েছেন।
এদিকে আর জি করের ঘটনায় প্রতিবাদ জানিয়ে আগামী ৭ সেপ্টেম্বর ‘ইচ্ছেমতো’ নাট্যদল আকাদেমিতে সারারাত্রিব্যাপী নাটকের আয়োজন করেছে। সেখানে সীমা মুখোপাধ্যায় পরিচালিত রঙরূপের ‘স্পেয়ার পার্টস্’, তূর্ণা দাশ নির্দেশিত ইচ্ছেমতোর ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’, সবার পথের ‘শীতলপাটি’, পরিচালনা সঞ্জিতা, শ্রাবন্তী ভট্টাচার্য পরিচালিত ‘মুজাহেমাৎ’, ন্যান্সি ও প্রান্তিক চৌধুরি পরিচালিত ‘অপরাজিতা আজও’ এবং পৌলমী চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত ‘টাইপিস্ট’ মঞ্চস্থ হবে। তপন থিয়েটার সৃজকের আয়োজনে ৮ সেপ্টেম্বর দুপুর তিনটে থেকে আর জি করের ঘটনার প্রতিবাদে চারটি নাটক যথাক্রমে শ্রীরামপুর সফরের ‘আরশিযাপন’, ভানের ‘মগজে কার্ফু’, সৃজকের ‘গুপীবাঘা’ এবং চাকদহ নাট্যজনের ‘জগাখিচুড়ি’ নাটক মঞ্চস্থ হবে।
Comments :0