Nandakumar attack

আবাস যোজনার বিক্ষোভে বেপরোয়া পুলিশি হামলা

জেলা

আবাস দুর্নীতিতে জেরবার সরকার, শাসক দল এবার উন্মত্ত পুলিশকেই নামালো রাস্তায়। আবাস যোজনার ঘর চাইতে গিয়ে পুলিশের হিংস্র আক্রমণে, লাঠি চালানোয় আহত হলেন শতাধিক মানুষ। বিডিও, তৃণমূলী পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি ব্লক অফিসে উপস্থিত থেকেই পুলিশকে লেলিয়ে দিল বিক্ষোভকারীদের ওপরে। নিজের ঘর চাওয়ার অপরাধে গৃহবধূকে রাস্তায় ফেলে লাঠি দিয়ে নির্বিচারে পেটালো পুলিশ, মাথা ফাটলো একাধিকজনের। সিপিআই(এম) কার্যালয়ে ঢুকে সেখান থেকে মারতে মারতে বের করে রাস্তা দিয়ে টানতে টানতে পুলিশের গাড়িতে তোলা হলো সিপিআই(এম) পূর্ব মেদিনীপুর নজেলা সম্পাদক নিরঞ্জন সিহিকে। শুধু তাই নয়, নন্দকুমারে সিপিআই(এম) কার্যালয়ে ঢুকে তৃণমূলী দুষ্কৃতীদের মতোই চেয়ার, টেবিল ভাঙচুর করে তাণ্ডব চালায় খোদ নন্দকুমার থানার ওসি মনোজ কুমার ঝাঁ।

 
বর্ষশেষের আগের রাতে মমতা ব্যানার্জির সরকারের পুলিশ বাহিনীর এই নৃশংস আক্রমণ, বর্বরতার সাক্ষী থাকল নন্দকুমার। এই আক্রমণের তীব্র নিন্দা করেছেন সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। এদিন এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, নন্দকুমারে আবাস যোজনায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিডিও অফিসে বিক্ষোভ চলাকালীন পুলিশের নির্মম লাঠি চালানোয় আহত হয়েছেন আমাদের বহু কর্মী। পরবর্তীতে পার্টি অফিস থেকে জেলা সম্পাদক ও সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যসহ বেশ কয়কজন নেতাকর্মীকে ধরপাকড় করা হয়েছে। রাজ্যজুড়ে এর প্রতিবাদ হওয়া প্রয়োজন অবিলম্বে। প্রতিটি ক্ষেত্রে আবাস যোজনার দুর্নীতি নিয়ে সোচ্চার হওয়া মানুষের ওপর পুলিশি অত্যাচার নামিয়ে আনছে বর্বর তৃণমূল সরকার। দুর্নীতিবিরোধী চলমান আন্দোলনের ওপর পুলিশের এই নির্মম আচরণ জনগণের সামনে আবারও স্পষ্ট করে তুলে ধরা প্রয়োজন।   
এদিন একেবারে বিনা প্ররোচনায় পরিকল্পিতভাবে এই নৃশংস হামলা চালানোর অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। আবাস যোজনার দুর্নীতির প্রতিবাদে, প্রকৃত গরিব প্রাপকদের নাম অন্তর্ভুক্ত করার দাবিতে নন্দকুমার বিডিও অফিসে ডেপুটেশনের কর্মসূচি ছিল। ব্লক অফিসে হাজির বিডিও নিজে। তবুও সিপিআই(এম)’র ডেপুটেশন তিনি গ্রহণ করবেন না, তাই ডেপুটেশনে শামিল হওয়া সিপিআই(এম) কর্মী, সমর্থক সহ সাধারণ গ্রামবাসীদের ওপর নির্বিচারে চলল লাঠি। 
দুয়ারে সরকার থেকে বিডিও অফিস বারেবারে হত্যে দিয়ে ঘর না পাওয়া আরজুনা বিবি হাতজোড় করে দাবি জানাচ্ছিলেন বিডিও অফিসের সামনে। সেই মধ্যবয়সি মহিলাকে পুরুষ পুলিশ রাতে হাঁটুতে, পায়ে নির্বিচারে লাঠি দিয়ে মারতে শুরু করে। হাউহাউ করে কাঁদছেন, আমি তো ঘর চাইতে এসেছি! তারপরেও পুলিশি বর্বরতা থেকে রেহাই পাননি, শরীরে পড়েছে একের পর এক লাঠির আঘাত।

 
লাঠির আঘাতে, পুলিশি হামলায় আহত হয়েছেন শতাধিক বিক্ষোভকারী। তাঁদের মধ্যে রাত পর্যন্ত জখম অবস্থায় নন্দকুমার খেজুরবেড়িয়া হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে ২৫জনকে। পুলিশের লাঠিতে একাধিকজনের মাথা ফাটে। হাসপাতালে ভর্তি ২৫জনের মধ্যে ৫জনের আঘাত অত্যন্ত গুরুতর। রাত পর্যন্ত নিখোঁজ রয়েছেন ৪ জন। পার্টির জেলা সম্পাদক সহ মোট ১৮ জনকে থানায় আটক করে রাখে পুলিশ। রাত সাড়ে নটা নাগাদ নিরঞ্জন সিহি, পরিতোষ পট্টনায়েক, শান্তুনু দাস সহ ৮জনকে ছাড়া হয়। বাকি দশজন সিপিআই(এম) কর্মী, সংগঠককে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।  
বিকাল থেকে শুরু হয় বিক্ষোভ। কিন্তু অপরাধীদের মতোই পুলিশও যেন অপেক্ষা করেছিল কখন দিনের আলো কমে অন্ধকার নামে। শীতের বিকাল। সন্ধ্যা ছটাতেই অন্ধকার নামে। সেই অপেক্ষাতেই যেন ছিল পুলিশ। অন্ধকার হতেই শুরু হয় পুলিশি বর্বরতা।
শুক্রবার বিকাল চারেট নাগাদ আবাস যোজনায় প্রকৃতদের নাম অন্তর্ভুক্ত করার দাবিতে নন্দকুমারে সিপিআই(এম) কার্যালয়ের সামনে থেকে মিছিল শুরু হয়। সিপিআই(এম) কর্মী, সমর্থক ছাড়াও কয়েকশো গ্রামবাসী মিছিলে শামিল হন। নন্দকুমার বাজার ঘুরে সাড়ে চারটে নাগাদ নন্দকুমার বিডিও অফিসে মিছিল করে পৌঁছান আবাস যোজনায় ঘর না পাওয়া কয়েকশো মানুষ। মিছিলের নেতৃত্ব দেন নিরঞ্জন সিহি, পরিতোষ পট্টনায়েক, শান্তনু দাস, রীতা দত্ত, করুণাশঙ্কর ভৌমিক, চন্দন মাইতি সহ অন্যান্য সিপিআই(এম) নেতৃবৃন্দ। বিডিও ব্লক অফিসে থাকা সত্ত্বেও সিপিআই(এম)’র ডেপুটেশন নিতে অস্বীকার করেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায় ব্লক অফিসের দোতালায় বিডিও শানু বকশী, সহকারী বিডিও সহ প্রশাসনিক আধিকারিকরা রয়েছেন। এমনকি তৃণমূলের পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি দীননাথ দাসও ব্লক অফিসে হাজির। এই ঘটনা জানতে পেরে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে জনতা। গেটে তালা লাগিয়ে বিডিও অফিসের সামনে রাস্তায় অবস্থানে বসেন তাঁরা।
তিনবার ঘর না পাওয়া আরজুনা বিবি অঝোরে কাঁদতে থাকেন বিডিও অফিসের গেটে। তাঁর একটাই কথা ত্রিপল চাপা দিয়ে আর কতদিন থাকব, বিডিও একটু দয়া করুন। দুবার গেছেন দুয়ারে সরকার, তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারপর বিডিও অফিসে এসেছিলেন। ঘর বলতে কিছু নেই তাঁর, ত্রিপল টাঙিয়ে থাকতে হচ্ছে শীতের রাতে। অথচ তখনও ব্লক অফিসের ভিতরে বসে মজা দেখছেন বিডিও, তৃণমূলী পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি। 
প্রথম থেকেই পুলিশের অতি সক্রিয়তা লক্ষ্য করা গেছে। কয়েকশো পুলিশ কর্মী জমায়েত ছিল বিডিও অফিসে। বিডিও তৃণমূলের পরামর্শে ডেপুটেশন নিতে অস্বীকার করার পরেই ক্ষুব্ধ মানুষজন তমলুক হলদিয়া রাজ্য সড়ক অবরোধ শুরু করেন। কিছুক্ষণ পরে পার্টি নেতৃত্ব ঘোষণা করেন রাস্তা অবরোধ তুলে নেওয়া হচ্ছে, তবে ডেপুটেশন না দেওয়া পর্যন্ত আমরা ব্লক অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকব।


 এই ঘোষণার কিছু পরেই সন্ধ্যা নামতেই অতর্কিতে পুলিশ ব্যাপকভাবে লাঠি চালানো শুরু করে। মিছিলে নেতৃত্ব দেওয়া পরিতোষ পট্টনায়েকের বুকে, পেটে লাথি মারতে মারতে ভ্যানে তোলে পুলিশ। এমনকি হুমকিও দেওয়া হয় থানায় নিয়ে গিয়ে প্রাণে মেরে ফেলা হবে। অবস্থান বিক্ষোভ তখন ছত্রভঙ্গ, পুলিশ যাকে যেখানে পেরেছে মারতে মারতে পুলিশ গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। মহিলা, বয়স্ক বলে কাউকে রেহাই দেওয়া হচ্ছে না। সাধারণ একটা বিক্ষোভ কর্মসূচিতে পুলিশের এমন উন্মত্ত হামলায় স্তম্ভিত হয়ে যান রাস্তার সাধারণ মানুষজনও। মাটিতে পড়ে থাকা অবস্থায় পেটাতে শুরু করে সিপিআই(এম) কর্মী, সমর্থকদের। মারধর করা হয় পার্টির জেলা সম্পাদক নিরঞ্জন সিহিকেও। মহিলাদের চুলের মুঠি ধরে লাঠি দিয়ে মারধর শুরু করে পুলিশ। সিপিআই(এম)’র পতাকা কেড়ে নিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়ে পা দিয়ে মাড়ায় কার্যত তৃণমূলী দুষ্কৃতীদের ভূমিকায় থাকা পুলিশ বাহিনী। রক্তপতাকা ছিঁড়েও দেওয়া হয়।
কিছুক্ষণ পরে নিরঞ্জন সিহি সহ পার্টি নেতৃত্বকে কোনমতে নন্দকুমার পার্টি অফিসে নিয়ে আসা হয়। ততক্ষণে পুলিশি হামলাও থেমে গেছে। কিন্তু এর আধঘণ্টা পরে এবার খোদ নন্দকুমার থানার ওসি’র নেতৃত্বে বিরাট পুলিশ বাহিনী আসে পার্টি অফিসে। খোদ ওসি লাথি মেরে পার্টি অফিসের চেয়ার, টেবিলে উলটে দেন। জানালা, দরজাও ভাঙচুর শুরু করে পুলিশ। এরপর পার্টি অফিসের ভিতর থেকেই নিরঞ্জন সিহি, শান্তনু দাস, চন্দন মাইতি সহ সিপিআই(এম) নেতা-কর্মীদের বের করে ওসি মনোজ ঝা’র নেতৃত্বে পুলিশ বাহিনী ব্যাপকভাবে মারধর করতে করতেই পুলিশের গাড়িতে তোলে। নিরঞ্জন সিহিকে গাড়ির একেবারে পিছনের সিটে ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়া হয়। পুলিশের লাঠির আঘাতে লৌহজংগ্রামে বাসিন্দা শেখ হাকিম, সামিদ আনসারির মাথা ফেটে যায়। 
পুলিশি বর্বরতার বিরুদ্ধে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার প্রতিটি ব্লক এলাকায় শুক্রবার রাত থেকেই বিক্ষোভে নামেন সিপিআই(এম) কর্মী, সমর্থকরা।

Comments :0

Login to leave a comment