Post Editorial

অস্থায়ী উপাচার্য নিয়োগের স্থায়ী বন্দোবস্তে এগিয়ে বাংলা!

রাজ্য উত্তর সম্পাদকীয়​

নিলয়কুমার সাহা
 

১৯৯৩ সালে অর্থাৎ আজ থেকে দুশো তিরিশ বছর আগে বড়লাট লর্ড কর্নওয়ালিস জমির খাজনা নির্দিষ্ট করার উদ্দেশ্যে প্রবর্তন ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং জমিদারদের মধ্যে সম্পাদিত ওই চুক্তি অনুসারে কৃষক সম্প্রদায় তাঁদের উৎপাদনের এক-তৃতীয়াংশ ফসল খাজনা হিসেবে বাধ্য হতেন জমিদারের গোলায় তুলে দিতে। জমিদাররাও তাঁদের মোট অর্জিত খাজনার এক-তৃতীয়াংশ জমা করতেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কোষাগারে। প্রচলিত আইনানুসারে জমির খাজনা আদায়ের যাবতীয় অনিশ্চয়তা দূর করে সরকারি কোষাগারের উন্নতিকল্পে তদানীন্তন বড়লাটের জনস্বার্থ বিরোধী ওই পদক্ষেপে উত্তাল হয়েছিল সমগ্র দেশ। দীর্ঘ দুই শতাব্দী পর পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান বড়লাট অর্থাৎ রাজ্যপাল তাঁর উত্তরসূরির বিপরীত পদাঙ্ক অনুসরণ করে, স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগের স্বীকৃত পদ্ধতি বর্জন করে, অস্থায়ী উপাচার্য নিয়োগের যে রীতি প্রবর্তন করলেন তা অবশ্যই ব্যতিক্রমী এবং বিতর্কিত। অর্থাৎ প্রায় আড়া‍‌ইশো বছরের ব্যবধানে রাজ্যের দুই সাংবিধানিক প্রধান প্রচলিত রীতি উপেক্ষা করে দুটি ভিন্ন ক্ষেত্রে যে আইন প্রণয়ন এবং পদ্ধতি প্রয়োগ করেছেন, তা সর্বতোভাবে দেশের আর্থ-সামাজিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি রাজ্যের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় সৃষ্টি করেছে চরম নৈরাজ্য। 


উপাচার্য নিয়োগ বিধি


স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষে দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালন এবং নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ১৯৫৩ সালে গঠিত হয় উচ্চশিক্ষার নিয়ামক সংস্থা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি আয়োগ (ইউজিসি)। স্বশাসিত এই সংস্থাটি প্রথম থেকেই দেশের সমস্ত কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকার পোষিত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সহ শিক্ষক নিয়োগের নির্দেশিকা প্রকাশ করে চলেছে। আলোচনার শুরুতে আমরা ফিরে যাব ১৯৬৪ সালে ডা. ডিএস কোঠারির একটি মন্তব্যে। ওই সময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালন ব্যবস্থা সম্পর্কে বলেন, ‘‘একটি বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণ মুক্ত গণতান্ত্রিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা নির্ভর হবে এবং দুই, বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতি ও কার্যক্রম চূড়ান্ত হবে শিক্ষার সাথে যুক্ত সকল‍‌ শ্রেণির কার্যকরী অংশগ্রহণে। ড. কোঠারির এই বক্তব্য থেকে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ কত সহস্র যোজন দূরে পিছিয়ে পড়েছে তা দেশের একটি রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে অতি সম্প্রতি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগে নজিরবিহীন ঘটনা প্রবাহেই প্রতিভাত। যদিও ১৯৪৮ সাল থেকেই উপাচার্য নিয়োগ সংক্রান্ত বিভিন্ন কমিশনের সুপারিশ দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে সমৃদ্ধ করে আসছে। স্বাধীন ভারতবর্ষে ১৯৪৮ সালে ‘দ্য রাধাকৃষ্ণণ কমিশন’ উপাচার্য নিয়োগের সুপারিশে বলে, ‘‘আচার্য কর্মসমিতির একটি নামের সদর্থক সুপারিশের প্রেক্ষিতে উপাচার্য নিয়োগ করবেন। সুপারিশকৃত নামটি যথার্থ বিবেচিত না হলে আচার্য কর্মসমিতির কাছে অপর একটি নাম চাইতে পারেন।’’ ১৯৬৪ সালে ‘দ্য কোঠারি কমিশন’ উপাচার্য নিয়োগের বিষয়ে রাধাকৃষ্ণণ মিশনের সুপারিশের সাথে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের পছন্দের বিষয়টিকে যুক্ত করে। কোঠারি কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী রাজ্য পোষিত এবং কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ প্রসঙ্গে বলা হয়, ‘‘রাজ্য সরকার পোষিত বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাক্ট অথবা স্ট্যাটুট অনুযায়ী গঠিত সার্চ কমিটির সুপারিশকৃত তিনটি নাম থেকে একটি নাম চূড়ান্ত করবেন যথাক্রমে আচার্য তথা রাজ্যপাল এবং পরিদর্শক।’’ পরবর্তী সময়ে উপাচার্য নিয়োগের বিষয়টিকে স্বচ্ছতম করার লক্ষ্যে ‘গভর্নেন্স অফ দ্য ইউনিভার্সিটি অ্যান্ড কলেজেস’ (ইউজিসি, ১৯৭১) সার্চ কমিটি গঠন সংক্রান্ত যে তিনটি বিকল্প ঘোষণা করে — বিকল্প (১) পরিদর্শক অথবা আচার্যের প্রতিনিধি, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসমিতি অথবা সিন্ডিকেটের দু’জন মনোনীত সদস্য। বিকল্প (২) পরিদর্শক অথবা আচার্যের প্রতিনিধি, ইউজিসি’র সভাপতির প্রতিনিধি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসমিতি অথবা সিন্ডিকেটের একজন মনোনীত সদস্য। বিকল্প (৩) পরিদর্শক অথবা আচার্যের প্রতিনিধি, ইউজিসি’র সভাপতির প্রতিনিধি এবং সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন প্রতিনিধি, যাঁদের মধ্যে একজনকে মনোনীত করবে বিশ্ববিদ্যালয়ের আকাডেমিক কাউন্সিল এবং একজনকে মনোনীত করবে কর্মসমিতি অথবা ‍‌সিন্ডিকেট। প্রসঙ্গত, উল্লেখ, ‘সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটিস অ্যাক্ট, ২০০৯’ অনুযায়ী ভারতবর্ষের রাষ্ট্রপতি হলেন কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির পরিদর্শক। যদিও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি পরিদর্শক এবং রাজ্যপাল হলেন রেক্টর। ১৯৯০ সালে ‘জ্ঞানম কমিটি’ সার্চ কমি‍‌টি সম্পর্কে যে সুপারিশ করে— ইউজিসি’র সভাপতি অথবা তাঁর প্রতিনিধি অথবা সংশ্লিষ্ট রাজ্যের উচ্চশিক্ষা সংসদের সভাপতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসমিতি অথবা সিন্ডিকেটের একজন প্রতিনিধি, আচার্য/পরিদর্শকের প্রতিনিধি। সার্চ কমিটির আহ্বায়ক হবেন আচার্য/পরিদর্শকের প্রতিনিধি। এই কমিটি আরও যে বিষয়টি উল্লেখ করে তা হলো, বর্তমান উপাচার্যের কার্যকালেই পরবর্তী উপাচার্য নিয়োগের জন্য সার্চ কমিটি গঠন করতে হবে এবং নতুন উপাচার্য দায়িত্ব গ্রহণের সময় পর্যন্ত বর্তমান উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করে যাবেন। অর্থাৎ কোনো অবস্থাতেই বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যহীন হবে না।


মিউজিক্যাল চেয়ারে রাজ্যের উপাচার্যগণ


উপাচার্য নিয়োগে অপরিহার্য সার্চ কমিটি গঠন সম্পূর্ণভাবে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাক্ট অথবা স্ট্যাটুট নির্ভর একটি বিষয়। কাজেই এই বিষয়ে রাজ্য সরকারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। পশ্চিমবঙ্গে বিগত ছয় দশকে ইউজিসি’র নির্দেশিকা মেনেই রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপাচার্য নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। যদিও পশ্চিমবঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য পদে রাজ্যপালের পরিবর্তে রাজ্যের বিশিষ্ট কোনো শিক্ষাবিদকে স্থালভিষিক্ত করার দাবি অনেক দিন আগেই উত্থাপিত হয়েছে এবং এই দাবি ক্রমেই জোরদার হচ্ছে। ইতিমধ্যে কেরল সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য পদে রাজ্যপালের পরিবর্তে বিশিষ্ট কোনো শিক্ষাবিদকে স্থলাভিষিক্ত সংক্রান্ত বিল বিধানসভায় উত্থাপন করেছে এবং সেই বিল রাজ্যপালের অনুমোদনের জন্য রাজভবনে ফাইলবন্দি হ‍‌য়ে পড়ে আছে। আমাদের রাজ্যে ২০২২ সালের ১৩ জুন বিধানসভায় ‘দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল ইউনিভার্সিটি লজ (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল ২০২২’ পেশের পর থেকেই সমস্যার সূত্রপাত। এই বিলে রাজ্য পোষিত  ক‍‌মিটির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে স্থায়ীভাবে উপাচার্য নিয়োগ করবে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে‌ শিক্ষাক্ষেত্রে এমন নজিরবিহীন ঘটনার প্রভাব কতোটা সুদূরপ্রসারী হতে পারে তা সে দিন অনুমান করা যায়নি।
অনৈতিক এই সমঝোতা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। এই ঘটনার অব্যবহিত পরে মাননীয় রাজ্যপাল আকস্মিক ভাবেই বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন শুরু করেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০’ কার্যকর করতে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিভূ রাজ্যপালের মহতী এই উদ্যোগে রাজভবন এবং নবান্নের অনৈতিক  বোঝাপড়ায় সাময়িক ছেদ পড়ে। কালবিলম্ব না করে রাজ্যপালের  সাথে পাঞ্জা লড়তে ময়দানে নেমে পড়ে রাজ্য প্রশাসন এবং পশ্চিমবঙ্গ  সরকার পুনরায় রাজভবনে ফাইল বন্দি  ‘দ্যা ওয়েস্ট বেঙ্গল ইউনির্ভাসিটি লজ (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল ২০২২’ কার্যকর করতে উদ্যত   হওয়ার পাশাপাশি  রাজ্য পোষিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপাচার্য নিয়োগের জন্য পাঁচ সদস্যদের সার্চ কমিটি  গঠনের প্রস্তাব গ্রহণ করে। প্রস্তাবিত পাঁচ সদস্যের সার্চ কমিটির সদস্যরা হলেন (১) ইউজিসি   মনোনীত প্রতিনিধি, (২) রাজ্যপালের  মনোনীত প্রতিনিধি, (৩) রাজ্যের  উচ্চশিক্ষা সংসদের মনোনীত প্রতিনিধি,  (৪) বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্ট  বা সেনেটের মনোনীত প্রতিনিধি, (৫) রাজ্যের উচ্চশিক্ষা বিভাগের  মনোনীত প্রতিনিধি। এরপর রাজ্য সরকার  ২০২৩ সালের ১৬ মে পাঁচ সদস্যের সার্চ কমিটি  গঠনের লক্ষ্যে ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ইউনির্ভাসিটি লজ (অ্যামেন্ডমেন্ট) অর্ডিনান্স, ২০২৩’ জারি করে। এই অর্ডিনান্সে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্ট  বা সেনেটের মনোনীত প্রতিনিধির পরিবর্তে মুখ্যমন্ত্রীর  (অবশ্যই রাজ্যের) প্রতিনিধির অন্তর্ভুক্তি ঘটে,  প্রস্তাবিত বাকি চার সদস্য অপরিবর্তিত ছিল।  এই প্রসঙ্গে   রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী   সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, সার্চ কমিটিতে রাজ্যপালের  প্রতিনিধি  থাকলে  মুখ্যমন্ত্রীর  প্রতিনিধিও থাকবে। এমতাবস্থায়  রাজ্যপাল মহামান্য আদালতের রায়ের উপর ভিত্তি করে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইউজিসি’র যোগ্যতা  মান সম্পর্কিত  শর্তাবলী উপেক্ষা করে রাজ্যের  বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে অস্থায়ী  উপাচার্য  নিয়োগের  মহড়া শুরু  করেন। রাজ্য প্রশাসনও  হাত গুটিয়ে বসে রইল না। রাজ্যের  শিক্ষামন্ত্রীর  অনুরোধ উপেক্ষা করে রাজ্যপালের  সুপারিশকৃত ব্যক্তিবর্গ রাজ্যের  বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী উপাচার্যের দায়িত্ব (তিন মাসের জন্য)  গ্রহণে  অব্যবহিত  পরে রাজ্যের  উচ্চশিক্ষা দপ্তর এক সরকারি  বিজ্ঞপ্তিতে নবনিযুক্ত  এই সব অস্থায়ী  উপাচার্যদের  বেতন বন্ধের  সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। যদিও  মহামান্য আদালত  এই প্রক্রিয়াকে  বৈধ ঘোষণার  পাশাপাশি  রাজ্য সরকারকে নবনিযুক্ত অস্থায়ী উপাচার্যগণকে প্রাপ্য বেতন প্রদানের নির্দেশ দেয়।  সম্প্রতি মহামান্য রাজ্যপাল  শিক্ষা জগতের  সাথে সম্পর্কহীন দুই ব্যক্তিত্বকে রাজ্যের দুটি  বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য  পদে নিয়োগ করেন। একজন প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এবং অপরজন এক প্রাক্তন  পুলিশকর্তা (আইপিএস)। উপাচার্য পদে‍‌ ভিন্ন ভিন্ন  পেশায় নিযুক্ত ব্যক্তিত্বের সংখ্যা ভবিষ্যতে আর বাড়‍‌বে কি না, সে প্রশ্নের উত্তর আমাদের অজানা। যদিও পশ্চিমবঙ্গে এই ঘটনার  বহু আগে এক আইসিএস অফিসার খুব অল্প সময়ের জন্য একটি  বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। 
স্বাধীন ভারতবর্ষের দু’দুটো সাধারণ  নির্বাচন অত্যন্ত কৃতিত্বের সা‍‌থে সম্পন্ন করার পর অবসর প্রাপ্ত দেশের প্রথম নির্বাচন কমিশনার সুকুমার সেন মহাশয়‌কে ১৯৬০ সালে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী  ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়  রাজ্যে বর্ধমান, কল্যাণী এবং উত্তরবঙ্গে  তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়  প্রতিষ্ঠা সম্পর্কিত বিল প্রস্তুতের  অনুরোধ করেন।  যথা সময়ে  সেই দায়িত্ব পালনের পর ডাঃ রায়ের অনুরোধেই  ১৯৬০ সালের ১৫  জুন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব  সুকুমার সেনের হাত ধরে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের  পথচলা শুরু হয়েছিল এবং আড়াই  মাস শ্রী সেন  বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্যের  দায়িত্বে ছিলেন। শ্রী সেনের এই অবদানের  স্বীকৃতি স্বরূপ  পশ্চিমবঙ্গ  সরকার বর্ধমান শহরে যে রাস্তাটি গ্রাঙ্কট্রাঙ্ক রোড থেকে  গোলাপবাগে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রসারিত সেই  রাস্তাটির নামকরণ  করে ‘সুকুমার সেন সরণি।’ ছয় দশক  আ‍‌‍‌গের একটি ঘটনা প্রমাণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদটির গরিমা বর্তমানে কেন্দ্র এবং রাজ্যের যৌথ উদ্যোগে কোন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে।


সময়ের দাবি
উত্তর কোভিড পর্যায়ে রাজ্যের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা কেন্দ্র ও রাজ্যের যৌথ আক্রমণে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। একদিকে  কেন্দ্রীয় সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০’র  আগ্রাসন আর অন্যদিকে  রাজ্য সরকারের ক্রমবর্ধমান দখলদারিতে রাজ্যের স্বশাসিত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির গণতান্ত্রিক পরিচালন ব্যবস্থার অপমৃত্যু যা প্রকারান্তরে  ‘পাবলিক ফান্ডেড এডুকেশন সিস্টেম’এর ক্ষেত্রকে  প্রতিনিয়ত সংকুচিত করে চলেছে। এই যৌথ  আক্রমণের  সাথে যুক্ত  হয়েছে রাজ্যের  শিক্ষাক্ষেত্রে নজির বিহীন নিয়োগ দুর্নীতি।  রাজ্যের  উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি  এবং স্বশাসিত  শিক্ষক নিয়োগ সংস্থাগুলি  বিগত  এক দশকে  শাসক দলের  দলীয়  কার্যালয়ে পরিণত হয়েছে। ফলস্বরূপ প্রাথমিক শিক্ষক থেকে উপাচার্য নিয়োগে আর্থিক লেনদেনের  অভিযোগ  রাজ্যের  লাখো লাখো মেধাবী  পড়ুয়ার জীবনে  সৃষ্টি  করেছে চরম নৈরাজ্য।  এমতাবস্থায়  রা‍‌জ্যের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের  পদ দীর্ঘ দিন শূন্য পড়ে থাকায়  ব্যাহত হচ্ছে  উচ্চশিক্ষা  ব্যবস্থা। এমতাবস্থায়,  নিয়ম মেনে রাজ্যের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ সংক্রান্ত  যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণের  পরিবর্তে  নবান্ন  এবং রাজভবন  শিক্ষাঙ্গনকে রাজনৈতিক যুদ্ধ ক্ষেত্রে  পরিণত করেছে। বৃহত্তর রাজ‍‌নৈতিক সমঝোতাকে আড়াল করতে কেন্দ্র ও রাজ্যের দুই ‘ছায়া যুদ্ধ’-এ প্রতিদিন রক্তাক্ত  হচ্ছে রাজ্যের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা আর প্রশস্থ হচ্ছে রাজ্যে উচ্চশিক্ষায় বেসরকারি বিনিয়োগের রাস্তা। রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থাকে বাজি রেখে রাজ‍‌নৈতিক এই স্বেচ্ছাচার বন্ধ না হলে অচিরেই উচ্চশিক্ষা বিত্তবানের একছত্র সম্পদে পরিণত হবে, বঞ্চিত হবে আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া পরিবারের মেধাবী পড়ুয়ারা। সুতরাং এই  সঙ্কটের মুহূর্তে রাজ্যের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে কেন্দ্র ও রাজ্যের জোড়া আক্রমণ থেকে বাঁচাতে এগিয়ে আসতেই হবে বৃহত্তর নাগরিক সমাজকে, অন্যথায় বিপর্যস্ত হবে সরকারি আনুকূল্যে  পরিচালিত দেশের  উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা, বিপন্ন হবে অসংখ্য মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীর ভবিষ্যত।      

 

Comments :0

Login to leave a comment