Water crisis

৩টি হেলিপ্যাড, ৫টি মন্দির, ১টি শিবলিঙ্গ দিয়েছে রাজ্য সরকার, দিতে পারেনি জল

রাজ্য

বাড়ি বাড়ি পানীয় জল পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল তৃণমূল সরকারের। বাড়ি তো দূরের কথা, অনেক গ্রামেই সেই জল পৌঁছায়নি। তীব্র জলকষ্ট রাজ্যের প্রতিটি জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে। সেই দুর্দশাই তুলে ধরতে ধারাবাহিক প্রতিবেদন।
 

 

প্রতীম দে: ডায়মন্ডহারবার
 

সাড়ে ৬ কোটি টাকা দিয়ে এখানে ৩টি হেলিপ্যাড বানিয়েছে রাজ্য সরকার। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি তা উদ্বোধন করেছেন গত ৪জানুয়ারি। সেদিনই সাধু, মহন্তদের জন্য ‘ভিভিআইপি’ চারটি ঘরেরও উদ্বোধন করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। শুধু কি তা-ই? গঙ্গাসাগরে পাঁচটি নতুন মন্দির এবং একটি শিবলিঙ্গও বানিয়েছে রাজ্য সরকার।
গঙ্গাসাগর এগুলি পেয়েছে। কিন্তু পানীয় জলের কল পায়নি। দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যাচ্ছে, সাগর ব্লকের এই ভারত বিখ্যাত পঞ্চায়েতে পানীয় জলের উৎস এখনও টিউবওয়েল। ঘরে ঘরে পানীয় জলের ‘জলস্বপ্ন’-র অগ্রগতি কতটা? ১৫,০০৭টি পরিবারের বসবাস এই পঞ্চায়েতে। ‘শূণ্য শতাংশ’ ঘরে পানীয় জল পৌঁছেছে। 
পঞ্চায়েতের উপপ্রধান হরিপদ মণ্ডল। তৃণমূলের নেতা। তাঁর দাবি, ‘‘পানীয় জলের কষ্ট কিছু এলাকায় আছে। টিউওয়েল কিছু নষ্ট। জলস্তর নামছে। এটিই প্রধান সমস্যা। জলের অসুবিধা হলে আমরা পিএইচই-কে বলে জলের ট্যাঙ্কের ব্যবস্থা করি।’’ কিন্তু বাড়ি বাড়ি পানীয় জল পৌঁছানোর প্রতিশ্রুতি ছিল। তার কী হলো? উপপ্রধানের গলার স্বর খাদে নেমে এল। বললেন, ‘‘সে কাজ শুরু হয়েছে।’’ তবে অগ্রগতি শূন্য।


যে এলাকায় তিনটি হেলিপ্যাড, পাঁচটি মন্দির, একটি শিবলিঙ্গ হতে পারে সরকারি টাকায় এক মাসের মধ্যে, সেখানে একটি বাড়িতেও নলবাহিত পানীয় জল পৌঁছে দিতে পারেনি সরকার তিন বছরে। ‘জলস্বপ্ন’-র ঘোষণা মমতা ব্যানার্জি ২০২০-র জুলাইয়ে করেছিলেন। গঙ্গাসাগরের মানুষের এই জলকষ্ট নিয়ে বিজেপি’রও কোনও হেলদোল নেই। পানীয় জলের সুরাহা চাই— এই দাবিতে আন্দোলন করছে বামপন্থীরা।
শুধু গঙ্গাসাগরেরই এই হাল, তা নয়। 
বারুইপুর লোকালে অন্য সমস্যা তুলে ধরলেন নিমাই দাস। তখন সবে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। বারুইপুর লোকালে পেয়ারা কিনতে গিয়ে প্রথম চোখে পড়ল। যে জলে ফলটা ধুইয়ে দিচ্ছেন বিক্রেতা, তা প্রায় হলুদ। নিমাই দাস, ১২ বছর ধরে ট্রেনে ফল বিক্রি করেন। জলের অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলে উঠলেন, ‘‘শহরের মানুষ হয়ে বুঝবে না কেন এই রং। আর্সেনিক আর্সেনিক।’’ পেয়ারা কেটে হাতে দিয়ে বলতে শুরু করলেন, ‘‘জলের খুব সমস্যা। খাবার জল নেই বললেই চলে। গ্রামে টিউবওয়েল থাকলেও তা খারাপ। আর যা আছে, সেখান থেকে এই হলুদ জল পড়ে।’’ 


বাড়ি কোথায়? জবাব এল, ‘‘হরিণডাঙা গ্রাম।’’ ডায়মন্ডহারবারের গ্রামাঞ্চলের ওই এলাকায় পানীয় জলের প্রবল দুদর্শা। কিছু জায়গায় কল গিয়েছে। জল পড়ে না। যেখানে কল গিয়েছে কিংবা যেখানে কল নেই, সর্বত্রই গ্রামবাসীদের ভরসা টিউবওয়েল। শুধু ডায়মন্ডহারবার নয়। ফলতা, বিষ্ণুপুর, বুড়ুল, সাতগাছিয়া, মহেশতলা একের পর এক এলাকা পানীয় জলের সঙ্কটে। ডায়মন্ডহারবারের সাংসদ অভিষেক ব্যানার্জি। তিনি বেরিয়েছেন ‘সংযোগ যাত্রা’য়। কোচবিচার থেকে। ডায়মন্ডহারবারের পানীয় জলের সঙ্কট নিয়ে তাঁর কোনও উদ্যোগ মানুষ দেখেননি। ১৯৯৮-এ জল প্রকল্প তৈরি হয়েছিল নোদাখালিতে। এই লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে। কমরেড জ্যোতি বসু সাতগাছিয়া কেন্দ্রের বিধায়ক থাকাকালীন নোদাখালির ওই জল প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। নদীর জল পরিশোধন করে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। পরিকল্পনামাফিক কাজও হয়। কিন্তু জলের পাইপের কোনও সংস্কার হয়নি গত ১২ বছরে। আমডালি, কলসার মতো ফলতার অনেক গ্রামে তো টিউবওয়েলই নেই। দূর থেকে জল আনতে হয় গ্রামবাসীদের। সিপিআই(এম) নেতা শম্ভু কুর্মি বললেন, ‘‘জলের সঙ্কট প্রবল। টিউবওয়েল থাকলেও তার থেকে জল আসে না। অনেকসময় সরু হয়ে পড়ে। পঞ্চায়েতকে জানিয়েও কিছু লাভ হয়নি। আর পঞ্চায়েত করবেই বা কেন? ভোট লুট করে জিতেছে। আশায় আছে আবার বুথ দখল করে জিতবে। জলের সঙ্কটের খবরে তাদের কী?’’


মহেশতলা পৌর নির্বাচনের সময়ে তৃণমূলের অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল যে, তারা পুনরায় বোর্ড গঠন করতে পারলে মহেশতলা এলাকায় জলের সমস্যা মিটে যাবে। কী হয়েছে? মহেশতলা পৌরসভার ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা শেখর গাঙ্গুলি। বাড়িতে জলের লাইন থাকলেও নিয়মিত তিনি জল পান না। একেক দিন সকালে জল আসে না তাঁর বাড়িতে। তিনি বলেন, ‘‘নিয়ম মেনে বাড়িতে জলের লাইন বসিয়েও নিয়মিত জল পাই না। বিশেষ করে একেক দিন সকালে তো জল আসেই না। আবার কোনও কোনও দিন জলে এত ক্লোরিনের গন্ধ, কেমিক্যালের গন্ধ থাকে যে, সেই জল ব্যবহারের অযোগ্য।’’ পানীয় জল নিয়মিত না পাওয়ায় প্রতিদিন ৩০ টাকা দিয়ে কুড়ি লিটারের জলের বোতল কিনতে বাধ্য হচ্ছেন এই প্রৌঢ়। আর যাঁদের জল কেনার সাধ্য নেই, তাঁদের ভরসা ‘ব্যবহারের অযোগ্য’ সেই জল।

 

Comments :0

Login to leave a comment