অপর্ণা ব্যানার্জি
মহিলাদের নিয়ে আবার মাথাব্যথা শুরু হয়েছে অনেকের। বিহার বিধানসভা নির্বাচনের পরে আলোচনার জোর বেড়েছে। কারণ, বিহারে জেডিইউ-বিজেপি জোট জিতেছে। আসন সংখ্যার বিচারে বিপুল জয়ই তারা পেয়েছে। এই নির্বাচনে মহিলারা ৭১ শতাংশের বেশি ভোট দিয়েছেন। অনেক বিশেষজ্ঞ, গবেষক, ভোট কুশলীরা বলতে শুরু করেছেন যে মহিলাদের বিপুল সমর্থনেই বিহারে এনডিএ জিতেছে। আর সেই সূত্রেই আলোচনার সামনের সারিতে এসে পড়েছেন মহিলারা।
আসলে আলোচনায় যতটা মহিলারা এসেছেন, তার চেয়ে বেশি এসেছে তাঁদের দেওয়া সরকারের ভাতা। বিহারে বিধানসভা নির্বাচনের আগে মহিলাদের অ্যাকউন্টে দশ হাজার টাকা দিয়ে নতুন প্রকল্প চালু করেছে জেডিইউ-বিজেপি। তার কোনও প্রভাব নেই, এই কথা যেমন বলা যাবে না, তেমনই এই কথা বোঝানোর চেষ্টাও অন্যায় হবে যে, শুধু সেই কারণেই বিহারে বিজেপি আর তার শরিক জিতেছে। অন্য আরও অনেক কারণ আছে। যেমন বিহারে মদ বিক্রির উপর নিষেধাজ্ঞার কী প্রভাব আছে সমাজে তা বিচার করা জরুরি। বিচারের প্রয়োজন আছে দলিত, পিছড়ে বর্গের পরিবারগুলি কী চোখে বিজেপি’কে দেখছে, তা বিচার করা। নয়া ফ্যাসিবাদের বিপদ সবাইকে, বিশেষত সমাজের পিছিয়ে থাকা অংশের মানুষকে বোঝানোর জন্য আরও কী কী উদ্যোগ নেওয়া উচিত বিরোধীদের ভুমিকাই বা কী ছিল— এসব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন। সেই আলোচনায়, চর্চায় অবধারিতভাবে মহিলাদের অবস্থা, পরিবেশের প্রসঙ্গও আসবে।
কিন্তু শুধু ভাতার মধ্যে মহিলাদের প্রসঙ্গ সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। কারণ, শুধু মাসে মাসে ভাতা পেলেই মহিলারা যাকে তাকে সমর্থন করতে পারেন, এই ধারণা সমাজে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। খুব সচেতনভাবেই সবাই করছেন তা নয়। কিন্তু নানাভাবে তা করা হচ্ছে।
দেশের ১২টি রাজ্যে মহিলাদের জন্য ভাতা চালু আছে। দেশের বিভিন্ন রাজ্যের বাজেটগুলির পর্যালোচনা করে ‘পিআরএস’ যে রিপোর্ট তার বিস্তারিত বিবরণ আছে। যে রাজ্যগুলিতে মহিলাদের জন্য ভাতা চালু আছে তার মধ্যে অন্যতম পশ্চিমবঙ্গ। পশ্চিমবঙ্গে চালু প্রকল্পটির নাম ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’। মাসে ১০০০ টাকা দেওয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে। তফসিলি জাতির এবং আদিবাসী মহিলারা পান ১২০০ টাকা করে। অর্থাৎ দৈনিক তারা ৩৩ টাকা থেকে ৪০ টাকা পান সরকারের থেকে। রাজ্যের ২ কোটি ১৫ লক্ষ মহিলা ওই ভাতা পান বলে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দাবি। সরকারের তথ্যেই আমাদের নির্ভর করতে হয়, ভরসা না থাকলেও। কারণ, তৃণমূলই সরকার গঠনের পর চালু করেছিল ‘যুবশ্রী’ নামে একটি প্রকল্প। এপ্লয়মেন্ট ব্যাঙ্কে নাম লিখিয়েও কাজ না পাওয়া যুবকদের ওই প্রকল্প থেকে মাসে মাসে এক হাজার টাকা করে দেওয়ার কথা। কিন্তু কারা পাচ্ছেন, আদৌ পাচ্ছেন কিনা, এখনও পর্যন্ত কতজন পেয়েছেন, যারা পাচ্ছেন তারা কী শুধু তৃণমূল কর্মী, নাকি সাধারণ যুবক-যুবতীরাও আছেন— এ’সব কিছুই সরকার কখনও জানায়নি। ফলে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার রাজ্যের ২ কোটি ১৫ লক্ষ মহিলা পাচ্ছেন, সেই বিষয়ে ভরসা না থাকলেও আমাদের সরকারের তথ্যকেই সঠিক ধরে নিতে হবে।
কিন্তু দৈনিক ভাতা সেই ৩৩ থেকে ৪০ টাকা। এটাই কী মহিলাদের প্রাপ্য? মহিলারা কী শুধুই ভাতায় খুশি? যারা রাজকোষ থেকে টাকা চলে যাচ্ছে মহিলাদের ভাতা দিতে গিয়ে বলে কপাল চাপড়াচ্ছেন, একশো দিনের কাজের আইন (মনরেগা) অনুসারে মহিলাদের যে কাজ এবং মজুরি পাওয়ার কথা, সেই কথা তো তারা বলছে না? রাজ্যে দু’বছরের বেশি সময় মনরেগা-এর কাজ বন্ধ। এটি কোনও প্রকল্প নয়, আইন। প্রথম ইউপিএ সরকার এই আইন চালু করেছিল। বামপন্থীদের সংসদে মূল এই দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল তৎকালীন সরকার, যেহেতু সরকারের অস্তিত্ব ছিল বামপন্থীদের উপর নির্ভরশীল। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারও ছিল সেই সময়ে। পশ্চিমবঙ্গ দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অগ্রবর্তী ঘাঁটি ছিল। তৃণমূল তখন রাজ্যে ‘অনুপ্রবেশ’ খুঁজছিল, আর বিজেপি কী করে ক্ষমতায় আসবে তা নিয়ে ‘চিন্তন শিবির’ করছিল। বামপন্থীদের দাবিতে শুরু হওয়া এই আইন অনুসারে যাঁরা কাজ চাইবেন, সেই গ্রামবাসীদের কাজ দিতে বাধ্য থাকবে সরকার। খেয়াল করলেই দেখা যাবে রাজ্যে (মনরেগা) আইন অনুসারে কাজ চালু করার দাবিতে আন্দোলনরত জনতার সামনের সারিতে রয়েছেন মহিলারাই।
রাজ্যে ২০২১-২২-এ মনরেগায় কাজ করেছিলেন ৫১ লক্ষ ১৩ হাজারের বেশি মহিলা। সেই বছর তারা গড়ে প্রায় ৪৮ দিন কাজ পেয়েছিলেন। গড়ে দৈনিক মজুরি পেয়েছিলেন ২০১ টাকা। অর্থাৎ সেই বছরই, প্রত্যেক মহিলা মনরেগা শ্রমিক গড়ে ৯৬৪৮ টাকা করে উপার্জন করেছিলেন। চলতি আর্থিক বছরে রাজ্যের জন্য নির্ধারিত মনরেগার দৈনিক মজুরি ২৬০ টাকা। মহিলারা যদি বছরে গড়ে ৫০ দিনও কাজ পান মনরেগায়, তাহলে তাঁদের উপার্জন হবে গড়ে ১৩ হাজার টাকা, আইন অনুযায়ী পুরো ১০০ দিন কাজ হলে পাবেন ২৬ হাজার টাকা। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, যা কোনও আইন নয়, একটি প্রকল্প মাত্র, তাতে একজন মহিলা গড়ে বছরে ১০-১২ হাজার টাকা পাচ্ছেন।
খুব স্বাভাবিক, অনেকেই এই প্রশ্ন সঠিকভাবেই তুলেছেন, রাজ্যে মনরেগার টাকা লুট হয়। দেদার চুরি হয়। ফলে পরিসংখ্যান মহিলাদের যে উপার্জন বলছে, কার্যক্ষেত্রে তা হয় না। কারণ, তৃণমূলের পঞ্চায়েত সদস্য, প্রধানদের সিংহভাগ কাটমানি যায় মহিলাদের উপার্জনের থেকে। রেগার মজুরির থেকেও কাটমানি নিয়েছে তৃণমূলের নেতারা। শুধু তাই নয়, ভুয়ো মাস্টার রোল দেখিয়ে, খাতায় কলমে কাজ দেখিয়ে দেদার টাকা তোলা হয়েছে মনরেগায়, এমন অভিযোগ অনেক। দক্ষিণ ২৪ পরগনার সুন্দরবন এলাকায় এমনও উদাহরণ আছে যে, দুর্গাপুজোর অষ্টমীর দিন কিংবা প্রবল ঝড়ের মধ্যেও গাছ লাগানোর কাজ হয়েছে দেখানো হয়েছে। তার মজুরি, উপকরণের খরচ নেওয়া হয়েছে। রাজ্যের প্রতিটি জেলায় এমন ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত আছে। কিন্তু তারপরও মহিলাদের একাংশ উপার্জন করেছেন টাকা— তাঁর হকের টাকা। দেশের আইন মোতাবেক এটা তাঁদের প্রাপ্য।
সেই মনরেগার কাজ বন্ধ। উল্লেখ্য, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয় সরকার লাগাতার মনরেগায় বরাদ্দ কমিয়েছে। কারণ আমাদের স্বয়ংসেবক প্রধানমন্ত্রী এই প্রকল্পকে ‘গর্ত খোঁড়া’র প্রকল্প বলে মনে করেন। বিজেপি মনে করে মনরেগায় টাকা নষ্ট হয়। রাজ্যে মনরেগায় দুর্নীতির অভিযোগে তারা টাকা দেওয়া বন্ধ করেছে। কিন্তু কতজন তৃণমূলের পঞ্চায়েত প্রধান কিংবা সদস্যর শাস্তি হয়েছে? একজনেরও নয়। আদালতে মনরেগার কাজ চালুর জন্য মামলা লড়েছেন বামপন্থী সাংসদ, আইনজীবী বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য। কাজ চালুর দাবিতে ব্লকে আন্দোলন করেছে বামপন্থীরাই। তৃণমূল চুপ করে বসে থেকেছে, মাঝেমাঝে আন্দোলন ঘোষণা করেছে, কিন্তু ময়দানে নামেনি। কারণ, তৃণমূলের নীতি মোদীর নীতির থেকে পৃথক নয়। তারাও চায় না এই আইন অনুসারে কাজ চালু করতে। সরাসরি অ্যাকউন্টে টাকা পাঠিয়ে তারা শস্তায় বাজিমাত করতে চায়। অর্থাৎ ভোটের জন্য মানুষকে প্রভাবিত করতে চায়।
কিন্তু সরকারের দেওয়া ভাতা কোনও ‘ডোল’ নয়। যেমন মনরেগায় কাজ মানুষের অধিকার, তেমনই কাজের সুযোগ, উপার্জনের সুযোগ, স্বনির্ভরতার সুযোগ তৈরিতে ব্যর্থ সরকারকে সামাজিক প্রকল্প চালু করতেই হবে। বামফ্রন্ট সরকার ভূমিসংস্কার করেছিল। শিল্পের উদ্যোগ নিয়েছিল। সেই সবই কাজের সুযোগ তৈরি করেছিল। আবার সেই সরকারই নয়া আর্থিক নীতিতে বিপর্যস্ত মানুষের বিভিন্ন অংশের জন্য সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প চালু করেছিল। তফসিলি, আদিবাসী, সংখ্যালঘু, বৃদ্ধ, শ্রমিক, ছাত্র-ছাত্রী সহ সমাজের নানা অংশের মানুষদের জন্য বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালেই চালু হয়েছিল। বাফ্রন্ট সরকারের সময়ে চালু বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পগুলিরই নতুন নতুন নামকরণ করেছেন আজকের মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু নামকরণ করলেই সন্তানের লালন পালনের সাফল্য অর্জন করা যায় না।
বামফ্রন্ট সরকারের সময় এক কোটির বেশি মহিলা প্রায় ১২ লক্ষ স্বনির্ভর গোষ্ঠীতে সংগঠিত হয়েছিল। আজ? কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্প দীনদয়াল উপাধ্যায় ন্যাশনাল রুরাল লাইভলিহুড মিশন, যার মাধ্যমে মহিলাদের স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরি হয়। কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের দাবি যে, প্রায় ১২ লক্ষ স্বনির্ভর গোষ্ঠী আছে রাজ্যে। কিন্তু কী উৎপাদন হয়? ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ দেওয়া হচ্ছে বলে সরকার দাবি করে। কোন কাজে সেই ঋণ ব্যবহার হচ্ছে? অনুসন্ধান করে দেখার দরকার। সেই সূত্রেই আমাদের ভাবতে হবে, যদি এত স্বনির্ভর গোষ্ঠীই থাকে, তাহলে মাইক্রোফিনান্সের ব্যবসা বাড়ছে কী করে রাজ্যে? রাজ্যের প্রায় ২৪ লক্ষ পরিবার মাইক্রোফিনান্সের চড়া সুদের জালে জড়িয়ে পড়েছে। যাঁরা সেই সুদখোর সংস্থাগুলির জালে জড়িয়ে পড়েছেন, তাঁদের সিংহভাগই মহিলা। অনেক মহিলা সেই সংস্থাগুলির ঋণ, সুদ মেটাতে না পেরে আত্মঘাতী হচ্ছেন।
অপরদিকে, বিগত ১০ বছরে শুধুমাত্র অতি ধনী ব্যবসায়ীদের ৯ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি ব্যাঙ্ক ঋণ সরকার মকুব করে দিয়েছে (সংসদে পেশ করা তথ্য এপ্রিল, ২০২৫)। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া এক আরটিআই’র উত্তরে জানিয়েছিল, ২০১৪ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে সরকারি-বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলোর মোট ঋণ মকুবের পরিমাণ ছিল ১৬.৬১ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি, যার সিংহভাগই ছিল অতি ধনীদের। এর সামান্য অংশও যদি দরিদ্র মহিলাদের স্বাবলম্বী করার জন্য দেওয়া হতো, তাহলে দারিদ্র সীমার নিচে অথবা তার আশপাশে থাকা ২০ কোটি মহিলা এবং তাঁদের পরিবারের আর্থ-সামজিক চিত্র সম্পূর্ণ পালটে দেওয়া যেত। কেন ১০০০ জন অতি ধনীদেরই ঋণ দেওয়া এবং মকুব করা হয়, আর সরকারি ব্যাঙ্কের ঋণ না পেয়ে, মাইক্রোফিন্যান্স কোম্পানির নামে আসলে অধুনা সুদখোর মহাজনদের কাছে ঋণ নিতে যেতে বাধ্য হচ্ছেন দরিদ্র মহিলারা এবং সর্বস্বান্ত হচ্ছেন, সেই প্রশ্ন তো তোলে না কোনও কর্পোরেট পোষিত সংবাদ মাধ্যম! কেন? এদের গায়ে জ্বালা ধরে শুধু হতদরিদ্র, তায় আবার মহিলাদের জন্য সরকারি অর্থ ব্যয় হলে!
প্রশ্ন এটা নয় যে, সরকার কেন রাজকোষ থেকে মহিলাদের ভাতা দেবে। প্রশ্ন এটাই যে, মহিলাদের তীব্র ক্ষোভ প্রশমিত করতে ভাতা চালু করতে বাধ্য হওয়া সরকার কেন মহিলাদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য, আর্থিক সামাজিকভাবে স্বাবলম্বী করার নীতি গ্রহণ করছে না। জামাই ষষ্ঠী, নীলের পার্বনে ছুটি দিলে শ্রম দিবস নষ্ট হয় না, কিন্তু নিজেদের অধিকারের দাবিতে ধর্মঘট করলেই শুধু শ্রমদিবস নষ্ট হয়! ধর্মঘটের প্রশ্নে বরাবর এই বৈরি মনোভাব নিয়েছে কর্পোরেট সংবাদমাধ্যম, নিজেদের শ্রেণির স্বার্থেই।
২০২৫-২৬ অর্থবর্ষে কর্পোরেটদের জন্য ভারত সরকার ১ লক্ষ কোটি টাকার (Tax Concessions) কর ছাড় দিয়েছে। এছাড়াও সরাসরি শিল্প ও বাণিজ্য সংক্রান্ত প্রকল্পগুলির জন্য নির্দিষ্ট বাজেট বরাদ্দ প্রায় ৬৫,৫৩৩ কোটি টাকা। অতি ধনীদেরদের জন্য এই অর্থ বাজেটে বরাদ্দ করা হলে, তখন তো রাজকোষে চাপের গল্প-কাহিনি পরিবেশিত হয় না বাজারি সংবাদ মাধ্যমে!
সরকারি টাকায় মন্দির হলে আর্থ-সামাজিক অবস্থার কী উপকার হয়, সেই প্রশ্ন জোরের সঙ্গে উচ্চারণ করার দায় কার? শুধুই বামপন্থীদের? রাজকোষ থেকে দুর্গাপুজোয় টাকা খরচ করলে সেই টাকা অপচয় নয়? এই প্রশ্ন তোলার কী দরকার নেই? সেখানে তো নির্দিষ্টভাবে হিন্দু ভাবাবেগকে ভোটের জন্য ব্যবহার করা, হিন্দুত্বর রাস্তা প্রশস্ত করার প্রশ্নই শুধু জড়িয়ে আছে। আরএসএস’র অ্যা জেন্ডা নিয়ে চলা তৃণমূল সরকারের প্রতি এই প্রশ্ন তোলার সাহস তো নেই, শাসকের ধামাধরা সংবাদ মাধ্যমের!
আমরা এই সবের বিরোধী, আমরা ভাতার বিরোধী নয়। কারণ, ভাতা কারোর দয়ার দান নয়, অনুদান নয়। যে সরকার কাজের, উপার্জনের, স্বনির্ভরতার ব্যবস্থা করতে পারছে না, সরকারি কৌশলে ‘শূন্যপদ’ হিসাবে পড়ে থাকতে থাকতে যে পদগুলি অবলুপ্ত হওয়ার পথে, সেই পদে নিয়োগ চাই– এটাই মহিলাদের দাবি। মনে রাখতে হবে কয়েক লক্ষ শূন্যপদে নিয়োগ হলে অনেক মহিলাও চাকরি পাবেন। এই দাবি বামপন্থীরা ছাড়া আর কেউ তুলছেন না কেন?
তৃণমূল কিংবা বিজেপি, রাজ্য এবং কেন্দ্রের শাসক দলের পক্ষে সেই নীতি নেওয়া সম্ভব নয়। মহিলা সহ রাজ্যের মানুষের মূল সঙ্কট কাজ, উপার্জনের সুযোগের অভাব। সরকারকে ভাতা দিতে হবে। ভাতার পরিমাণ আরও বাড়াতে হবে। উৎসব-মোচ্ছব-মেলার নামে অপচয়মূলক ব্যয় বন্ধ করে, গঠনমূলক কাজ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার জন্য সরকারি ব্যয় বরাদ্দ বাড়াতে হবে। মুখ্যমন্ত্রী, মন্ত্রী, বিধায়কদের যে ভাতা বিপুল পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে রাজ্যে গত পনেরো বছরে, মুখ্যমন্ত্রী-মন্ত্রীদের কথায় কথায় হেলিকপ্টার ভ্রমণের বিলাসিতার জন্য সরকারি ব্যয় নিয়ে কোনও প্রশ্ন তোলা হয় না কেন বাজারি সংবাদ মাধ্যমগুলোতে?
রাজ্যের প্রায় অর্ধেক মহিলা। শুধু ভোটের সংখ্যা নন তাঁরা, তাঁরা শ্রমশক্তির মেইল শ্রমজীবী। কাজের সুযোগ বাড়লে মৃতবৎ বাজার চাঙ্গা হবে, যা অবধারিতভাবে নতুন শিল্প স্থাপনের প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরবে। ফলে মহিলাদের ভাতায় রাজকোষে চাপ পড়ছে, এটি ডোল, এইসব প্রচার ছড়িয়ে মহিলাদের নেহাত সুবিধাভোগী প্রমাণ করার কৌশল পরিত্যাগ করা জরুরি। এটা মহিলাদের বড় অংশকে তৃণমূলের পক্ষে, মমতা ব্যানার্জির পক্ষে ঠেলে দেওয়ার কৌশল, তা বোঝা খুব কঠিন নয়। কাজের দাবিতে সোচ্চার হতে হবে। কাজ, উপার্জনের পথ চাই মহিলাদের— এটিই সময়ের দাবি পশ্চিমবঙ্গের জন্য।
‘নারীর অধিকার’ নামক প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন— "নারী যেদিন আপনার সম্মান রক্ষা করিবার ভার পুরুষের হাত হইতে নিজের হাতে লইবে, সেই দিনই তাহার আত্মমর্যাদার সত্য প্রতিষ্ঠা হইবে।"
Comments :0