Post Editorial

বেদের যুগে গণতন্ত্র কাঁঠালের আমসত্ত্ব

সম্পাদকীয় বিভাগ

Post Editorial

‘বেদে সব আছে’ নামক সম্ভাবনার এক নতুন ভ্রুণ প্রতিস্থাপন করতে চাইছে আরএসএস-বিজেপি। গত আট বছরের শাসন কালে দেশের গণতন্ত্রকে প্রতি পদে পদদলিত করেছে যারা, তারা আজ উৎসাহ দেখাচ্ছে বেদের যুগের গণতন্ত্র নিয়ে। এর চাইতে বড় প্রহসন আর কী হতে পারে! রাষ্ট্র ক্ষমতা ব্যবহার করে সনাতন ধর্মের মাহাত্ম্য প্রচারে উৎসর্গীকৃত সংগঠন আরএসএস-বিজেপি, বহুদিন ধরেই গণেশের হাতির মাথায় ‘প্লাস্টিক সার্জারি’, স্বেচ্ছাকৃত গর্ভপাতের ফলে নির্গত অবয়বহীন মাংসপিণ্ডকে শতখণ্ডে বিভক্ত করে ঘৃতপূর্ণে কলসে সংরক্ষণ করে গান্ধারীর শত পুত্র জন্ম দেওয়ার ঘটনায় ‘স্টেমসেল’ এবং রাবণের পুষ্পক রথে ‘উড়োজাহাজ’ আবিষ্কারের তত্ত্ব প্রচার করে আসছেন। তাদের সাম্প্রতিকতম আবিষ্কার— বেদের যুগেও গণতন্ত্র ছিল। আসলে, ঈশ্বরের মহিমা প্রচারের এক মস্ত সুবিধে হলো, এর জন্য কোনও প্রামাণ্য নথির প্রয়োজন হয় না। উপরন্তু মানুষের বিশ্বাসবোধকে পুঁজি করে যেহেতু এ ধরনের প্রচার সংগঠিত করা হয়। তাই ধর্মভীরু মানুষদের একটা বড় অংশ অতি সহজেই এ ধরনের প্রচারে প্রভাবিত হয়ে যান। এবং সেটাকে হাতিয়ার করেই প্রতিক্রিয়ার শক্তি দেশে দেশে যুক্তিহীনতা এবং অপবিজ্ঞানের সাধনা করে থাকে। বলাবাহুল্য, আমাদের দেশে সেই চর্চার সমস্ত মৌরসিপাট্টা আজ আরএসএস-বিজেপি'র দখলে। 


       বেদের যুগে গণতন্ত্র ছিল কি ছিল না— সেই বিতর্কে যাওয়ার আগে একটা কথা বলে রাখা ভালো, বেদ কিংবা উপনিষদের মতো প্রাচীন সাহিত্যগুলিতে গণতন্ত্র শব্দটির কোনও অস্তিত্ব নেই। শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয় প্রাচীন গ্রিসে। গ্রিক শব্দ ‘ডেমোস’ এবং ‘ক্র্যাতোস’-এর সমন্বয়ে ‘ডেমোক্র্যাসি’ বা গণতন্ত্র শব্দটির জন্ম দিয়েছিলেন তারা। ডেমোস-এর বাংলা হলো জনগণ এবং ক্র্যাতোস-এর অর্থ শাসন। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে গণতন্ত্র শব্দের অর্থ হলো- জনগণের শাসন। আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে, ইতিহাসের জনক হিসাবে যাকে অভিহিত করা হয়, সেই হিরোডোটাস বলেছিলেন— গণতন্ত্র এমন এক প্রকার শাসন ব্যবস্থা, যেখানে শাসন ক্ষমতা কোনও শ্রেণি বা শ্রেণি সমূহের উপর ন্যস্ত থাকে না, বরং সমাজের সদস্যগণের উপর ন্যস্ত হয় ব্যাপকভাবে। বেদের যুগে শাসন কার্যের নেতৃত্ব দিত রাজতন্ত্র। কিন্তু কর্তৃত্ব থাকত রাজা, মহারাজাদের হাতে। সেই রাজা মহারাজাদের পরিবর্তে সমাজ যদি শাসন ব্যবস্থার কর্তা হয়ে ওঠে, তবে রাজতন্ত্রের সাথে নতুন সেই ব্যবস্থার গুণগত কিছু পার্থক্য হতে বাধ্য। সেই পার্থক্যগুলিকে চিহ্নিত করে গণতন্ত্রের কয়েকটি সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য এবং মানদণ্ড নির্দিষ্ট করেছেন সমাজ বিজ্ঞানীরা। 

 


      সেই মানদণ্ডগুলি যদি কোনও ব্যবস্থায় যথাযথভাবে রক্ষিত হয়, তাহলে সেই ব্যবস্থাকে গণতন্ত্র বলা যেতেই পারে। এখন দেখার বিষয় হলো, বৈদিক যুগে গণতন্ত্রের সেই পরিসর আদৌ ছিল কি না। গণতন্ত্রের প্রাথমিক শর্ত হলো, প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সরকার গঠন। 
বেদ এবং উপনিষদে যে সমস্ত আর্য এবং অনার্য রাজাদের উল্লেখ রয়েছে, তারা কেউই জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হতেন না। এমনকি, বৈদিক যুগের বহু পরে পুরাণ যুগে লিখিত মহাকাব্যগুলিতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। রামায়ণের রঘু বংশ থেকে শুরু করে মহাভারতের কুরু বংশ, রাজ- রাজাদের কাউকেই জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হতে হয়নি। উলটে বংশ পরম্পরায় তারা রাজত্ব চালিয়ে গেছেন। রাজতন্ত্রে অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। সেখানে জনগণের ইচ্ছা- অনিচ্ছার কোনও স্থান নেই, মূল্যও নেই। কাজেই, প্রথম বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী শাসক নির্বাচন কিংবা দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সরকারের পরিবর্তন করার অধিকার, রাজতন্ত্রে অলীক কল্পনা। কিন্তু, আরএসএস-বিজেপি যেহেতু বেদের যুগে গণতন্ত্র খুঁজে পেয়েছেন, সুতরাং আপনাকেও বিশ্বাস করতে হবে, রঘু বংশের অন্যান্য রাজারা মতো রামচন্দ্রও অযোধ্যাবাসীর বিপুল জনমত নিয়ে সিংহাসনে আসীন হয়েছিলেন। 

 

 


      গণতন্ত্রের তৃতীয় শর্ত— দল গঠন, মত প্রকাশ ও সমালোচনার অধিকারের স্বীকৃতি। রাজতন্ত্রে রাজকার্য পরিচালনার প্রধান মুখ হলো রাজা। বহু ক্ষেত্রে দেখা গেছে, সেই রাজারা আবার ছিলেন ঈশ্বরের স্বঘোষিত প্রতিনিধি। সুতরাং রাজার বিরোধিতা করা মানে ঈশ্বরের বিরুদ্ধাচরণ করা। কার ঘাড়ে ক'টা মাথা রয়েছে যে, সে ঈশ্বরের বিরুদ্ধাচরণ করে! এতদসত্ত্বেও যদি কেউই সাহস করে বিরুদ্ধাচরণ করতেন, তাকে রাজরোষে পড়তে হতো। আর রাজরোষ যে কত ভয়ঙ্কর, সেটাই নিশ্চয় বলার অপেক্ষা রাখে না। সেদিনের শম্বুক, একলব্য থেকে শুরু করে কোপার্নিকাস-গ্যালিলিও হয়ে আজকের দিনের স্ট্যান স্বামী-ভারভারা রাও এবং তিস্তা শীতলাবাদদের পরিণতি তার জ্বলন্ত উদাহরণ। সেদিনের রাজতন্ত্র হোক কিংবা হাল আমলের একনায়কতন্ত্র, সমালোচনা শোনবার মতো ধৈর্য কেউই অনুমোদন করে না।

 

 

       বাকি থাকে যে দু'টি বৈশিষ্ট্য, সেই দু'টির গুরুত্ব গণতন্ত্রে অপরিসীম। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিকের স্বার্থ রক্ষার সুবন্দোবস্ত করা এবং প্রত্যেক নাগরিকের ব্যক্তিত্ব বিকাশের উপযোগী রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার সমূহ আইনগতভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা। বলাবাহুল্য, এ দু'টির কোনোটিকেই বেদের যুগ তো অনেক দূরের কথা, আজকের ভারতের শাসকেরাও যথাযথ গুরুত্ব দেন না। মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশের প্রথম শর্ত হলো শিক্ষা প্রদান। কিন্তু এদেশের বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা প্রাচীন কাল থেকে অন্ত্যজদের শিক্ষা-দীক্ষার অধিকার কেড়ে নিয়েছে। শুধু শিক্ষা দীক্ষাই নয়, খর্ব করেছে সমস্ত রকম অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার। বেদের যুগে আজকের দিনের মতো তীব্র জাতি বিদ্বেষ হয়ত ছিল না। কিন্তু যা ছিল, সেটাও কম নয়। যার প্রমাণ মেলে ঋগ্বেদে। যেখানে আর্যরা ইন্দ্রের কাছে প্রার্থনা করছে এই মর্মে- ‘হে মঘবন! নীচ বংশীয়দের ধন আমাদের প্রদান কর’ (ঋগ্বেদ ৩/৫৩/১৪)। কিন্তু বেদ পরবর্তী সমাজ বর্ণাশ্রমের মতো এমন এক কুৎসিত প্রথার জন্ম দিয়েছিল, যা আজও শিক্ষা-দীক্ষা সহ কোনোরকম অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার থেকে অন্ত্যজদের বঞ্চিত করে রেখেছে। রুদ্ধ করে রেখেছে সমাজের এক বিপুল সংখ্যক মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশের যাবতীয় পথগুলিকে। শম্বুক, একলব্য, কর্ণদের পরিণতির কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, কিছু কিছু ক্ষেত্রে জাতি বিদ্বেষ এতটাই তীব্র ছিল যে, আর্যদের এক গোষ্ঠী অপর গোষ্ঠীর উপাস্যদের অসুর বলে দাগিয়ে দিয়েছে। বেদে তার অজস্র উদাহরণ রয়েছে। 

 


      সুতরাং ভারতীয় ইতিহাসের কোন পর্বেই এমন কোনও নজির ছিল না, যার উপর ভিত্তি করে আরএসএস-বিজেপি দাবি করতে পারে-বেদের যুগে গণতন্ত্র ছিল। যদিও বুদ্ধদেবের আবির্ভাবের পর লিচ্ছবি সহ কয়েকটি রাজ্য প্রধান পরিচালনা পর্ষদ গঠন করেছিল। কিন্তু সেই পর্ষদে সাধারণের প্রবেশাধিকার ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, আরএসএস-বিজেপি হঠাৎ করে বৈদিক যুগের গণতন্ত্র নিয়ে আলোচনা চাইছে কেন? এর উত্তর পেতে হলে, ভারতীয় দর্শনের স্তরগুলির উপর বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। 
       ভারতীয় দর্শনে চিন্তার যে চারটি স্তর, তার প্রথমটিতে প্রাকৃতিক শক্তিগুলিকে দেবতার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সেটি ছিল বৈদিক যুগ। উপনিষদের যুগে মানুষ ব্যবহারিক প্রয়োজন বোধকে উপেক্ষা করে জ্ঞানমার্গে বিশ্বসত্তাকে জানবার জন্য আগ্রহ দেখিয়েছে। প্রশ্নোপনিষদে আলোচনা হচ্ছে- প্রাণ কী? সেদিন দর্শন এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায়নি, কিন্তু আজকের বিজ্ঞান প্রাণের স্বরূপকে সংজ্ঞায়িত করতে সক্ষম হয়েছে। এই রকম অসংখ্য উদাহরণ দিয়ে দেখানো যায়, মানুষের নৃতাত্ত্বিক, সামাজিক এবং মানসিক আকাঙ্ক্ষাগুলিকে পূরণ করতে ধর্মকে যখন হিমশিম খেতে হয়, বিজ্ঞান তা পূরণ করতে পারে। যে কারণে ধর্মের কারবারীরা কখনোই চান না বিজ্ঞানের অগ্রগতি হোক। ভারতীয় দর্শনেও তার ব্যত্যয় হয়নি। ফলে তৃতীয় স্তর অর্থাৎ ষড় দর্শনের যুগে ব্যবহারিক প্রয়োজন বোধ ফিরিয়ে আনা হলো, তবে তা দুঃখ থেকে পরিত্রাণ কিংবা ইচ্ছা পূরণের জন্য নয়, জাগতিক বন্ধন থেকে মুক্তি লাভের জন্য। এক্ষেত্রেও জ্ঞানমার্গকে ব্যবহার করা হলো। শেষ ধাপে এল পুরাণের যুগ। বিশ্বসত্তাকে ব্যক্তিরূপী ঈশ্বর কল্পনা করে ভক্তিপ্রদর্শনই হয়ে উঠল মুক্তি সাধনার একমাত্র পথ। ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা- প্রবচন প্রচারিত হলো, সমাজ জীবনের যাবতীয় সমস্যা থেকে ব্যক্তি মানুষের মুখটাকে ঘুরিয়ে দেবার জন্য। আড়াই হাজার বছর বাদে আরএসএস- বিজেপি সেই ‘ভক্তিতেই মুক্তি’- ধারণাটি আরও একবার নতুন করে মানুষের মগজে ঢুকিয়ে দিতে চাইছে। বিশেষত কচি-কাঁচাদের মগজে। যে কারণে ওরা শিক্ষার্থীদের উপর বিভিন্ন রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে। এবং সেই জন্যেই পরিকল্পিতভাবে পাঠক্রমে একের পর এক পরিবর্তন আনা হচ্ছে। উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে যুক্তিহীনতার চর্চায়। বলাবাহুল্য, সেই লক্ষ্যেই কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ‘ভারত: গণতন্ত্রের জননী’ শীর্ষক আলোচনার আয়োজন। বামপন্থী ছাত্র সংগঠন এসএফআই-কে ধন্যবাদ, কালবিলম্ব না করে তারা শাসকের দূরাভিসন্ধি বানচাল করতে পথে নেমে প্রতিবাদ সংগঠিত করেছে। কারণ বিপদ তো শুধু বৈদিক যুগের গণতন্ত্রের মনগড়া কাহিনিতেই শেষ হবে না, আরএসএস-বিজেপি খাপ পঞ্চায়েতের উপযোগিতাও প্রচারে আনতে চাইছে। এও এক ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা। 

 

 

খাপ পঞ্চায়েতকে উৎসাহ দেবার অর্থ হচ্ছে, স্থানীয় স্তরে আধিপত্যবাদ কায়েম করা। যা দেশের বিচার ব্যবস্থাকে তছনছ করে দেবে। এখনও পর্যন্ত বিচার ব্যবস্থার কল্যাণে অসহায় বঞ্চিত মানুষ সামান্য হলেও যতটুকু সুবিচার পান, সেই সুবিচার পাওয়ার সম্ভাবনাটাও কেড়ে নিতে চাইছে আরএসএস-বিজেপি। ওরা জানে, হিন্দুত্ব রাষ্ট্র কায়েম করতে হলে গণতন্ত্রের সাথে বিচার ব্যবস্থাকেও ধ্বংস করতে হবে। ফলে, যথেষ্ট পরিকল্পনা করেই সেই পথেই হাঁটছে ওরা। বামপন্থীরা এই জন্যেই বারবার মানুষকে সতর্ক করে বলছেন— আরএসএস-বিজেপি'র প্রতিটি কার্যকলাপে ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে।

Comments :0

Login to leave a comment