যদি কেউ প্রশ্ন করেন গত ১২ বছরে মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে রাজ্যের তৃণমূল সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্য কি? তবে তার এক কথায় উত্তর হবে রাজ্য প্রশাসনের সর্বস্তরে সংগঠিত দুর্নীতি ও লুটতরাজের এক পরিপূর্ণ ইকোসিস্টেম তৈরি করা যে ইকোসিস্টেমের মধ্যে অবাধে, নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারছে দুর্নীতির সিন্ডিকেট। আর এই সিন্ডিকেটের কুশীলবদের মধ্যে আছে রাজ্যের মন্ত্রী, সাংসদ, বিধায়ক থেকে শুরু করে পৌর-পঞ্চায়েতে নির্বাচিত শাসকদলের প্রতিনিধিরা। আছে শীর্ষ আমলা থেকে শুরু করে সব বিভাগের বাছাই করা আধিকারিকরা। আছে আইপিএস অফিসার থেকে থানার আইসি-ওসি পর্যন্ত বেশিরভাগ। এই গোটা সিন্ডিকেট ব্যবস্থার মাধ্যমে ১২ বছর ধরে চলছে লুটের রাজত্ব। রেশন দুর্নীতির তদন্তে নেমে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা এখন পর্যন্ত যে রহস্যের হদিশ পেয়েছে সেটা এই সংগঠিত দুর্নীতির পূর্ণাঙ্গ ইকোসিস্টেমেরই অংশ।
রাজ্যের যে রেশন ব্যবস্থা তার মাধ্যমে প্রায় সকল নাগরিকের জন্যই সস্তায় খাদ্যশস্য পাবার সুযোগ আছে। কেন্দ্রীয় সরকার এবং অংশত রাজ্য সরকারের অর্থে চলে এই রেশন ব্যবস্থা। রেশনে বণ্টনের জন্য চাল-গম সংগৃহীত হয় কৃষকের কাছ থেকে। ফসল ওঠার মরসুমে খোলা বাজারে ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে ফসলের দাম এতটাই পড়ে যায় যে কৃষক ফসল বেচে চাষের খরচও তুলতে পারে না। তাই কৃষকরা যাতে ন্যূনতম লাভজনক মূল্য পান সেজন্য সরকার ন্যায্য দামে কৃষকদের কাছ থেকে ফসল কিনে সেই ফসলই রেশনের মাধ্যমে স্বল্পমূল্যে বা বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়। অর্থাৎ এই রেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে গরিব ও সাধারণ মানুষের পাশাপাশি কৃষকের স্বার্থে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করে সরকার। তৃণমূল সরকারের টানা দশ বছরের খাদ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা দুর্নীতি চক্র এই রেশন ব্যবস্থায় চলা সরকারি অর্থের একটা অংশ নানা বিচিত্র কৌশলে লোপাট করে দিয়েছে। তদন্তে নেমে এখনও পর্যন্ত এই চুরির ১৮.২৯ কোটি টাকার হদিশ পেয়েছে ইডি। তদন্তের গতিপ্রকৃতি যেভাবে এগচ্ছে এবং যেসব নথিপত্র উদ্ধার হচ্ছে তাতে রেশন দুর্নীতির বহর কত শত কোটি ছাড়ায় এখনও স্পষ্ট নয়। ভাবা যায় গরিব মানুষের খাবারের বরাদ্দ সরকারই চুরি করে সাফ করে দিচ্ছে খোদ মন্ত্রীর নেতৃত্বে বাহিনী। এই মন্ত্রীই আবার মুখ্যমন্ত্রী অতি প্রিয় বালু। দশ বছর ধরে টানা চুরি হয়ে চলেছে মুখ্যমন্ত্রী কিছুই জানেন না। উলটে তিনি জোরগলায় দাবি করছেন তাঁর আমলে নাকি চুরি হয় না। অথচ চুরি যে হয়েছে অস্বীকার করতে পারছেন। তাই পিঠ বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছেন সেই ৩৪ বছরে। এটাও বলতে বাধ্য হয়েছেন বিষয়টা নাকি ব্যক্তিগত। তার মন্ত্রী চুরির দায়ে জেলে। প্রতিদিনই প্রায় ধরা পড়ছে চুরির সিন্ডিকেটের নতুন নতুন সদস্য।
আসলে তৃণমূল নামক দলটার নেতা-কর্মীরা চুরিটাকে এমনভাবে অভ্যাসে পরিণত করেছে এবং নির্বিঘ্নে চুরি করার জন্য সরকারি-বেসরকারি উভয় পরিসরে শক্তিশালী পরিকাঠামো গড়ে তুলেছে যে চুরিকেই তারা তাদের ‘ন্যায়সঙ্গত’ পেশা হিসেবে ভাবতে শুরু করেছে। তৃণমূলে থাকা মানেই এই ইকোসিস্টেমের মধ্যে দু’হাতে কামানোর সুযোগ। তাই লক্ষ্য করলে দেখা যাবে পাড়ার একেবারে নিচুতলার তৃণমূলী ফুটোমাস্তান রাতারাতি বড়লোক। যে যেভাবে পারো লুটে খাও। সরকার, দল ও পুলিশ পূর্ণ নিরাপত্তা দেবে।
Editorial
দুর্নীতির ইকোসিস্টেম

×
মন্তব্যসমূহ :0