মুক্তধারা : প্রবন্ধ
#১৩১
কৃশানু ভট্টাচার্য
আত্মপরিচয় নিয়ে বিব্রত এদেশের মানুষের কাছে আজ সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায় আপনি কোন ধর্মের? তারপরই শুরু হয় চুলচেরা বিচার। না কোন আদালতে নয়। এ বিচার প্রকাশ্য নয়, সম্পূর্ণ গোপন একেবারে আস্তিনের ভিতরে ঢোকানো। বিচারের রায় ঠিক করে দেয় আসলামের সঙ্গে পলাশের সম্পর্ক কি রকম হবে? বিচারের রায় ঠিক করে দেয় শামসুলের বিপদে অভিনয় ঝাপিয়ে পড়বে কিনা? বিচারের রায় ঠিক করে দেয় বাড়ি ফিরে এসে একান্ত আপনজনের সঙ্গে আলাপচারিতায় মইদুল কিভাবে পরিচিত করাবে তার বন্ধু অঞ্জনকে। আর সেই সময় হয়তো সেই বাড়ির দেওয়ালে ছবি হয়ে ঝুলতে থাকেন বিবেকানন্দ।
কোন এক সময় তিনি বলেছিলেন, মানুষের জীবনে এক্সক্লিউশন শব্দটি বড় ভয়ঙ্কর। আরো গভীরে বলতে গেলে বলতে হয় বিপদজনক। তাঁর সেই উচ্চারণ সেদিন কাঁপিয়ে দিয়েছিল সারা দুনিয়াকে। একটা আন্তর্জাতিক মঞ্চে যখন পৃথিবীর প্রধান দশটি ধর্মের উদ্দেশ্যে দশটি আলাদা আলাদা ঘন্টা ধ্বনি বেজে উঠেছে, তখন তাঁর কণ্ঠস্বরে আলোড়িত সভাকক্ষে মানব ধর্মের জয় গান। সেদিন তিনি আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন এমন একটি ধর্মের যে ধর্ম জগতকে শিখিয়েছে পরমতসহিষ্ণুতা ও সর্বজনীন গহিষ্ণুতার আদর্শ। শিখিয়েছে কিভাবে আপন করতে হয় পরকে। আর সেই শিক্ষায় বলিয়ান হয়ে তিনি সেদিন উচ্চারণ করেছিলেন, " সাম্প্রদায়িকতা গোরামি এবং তার ভয়াবহ ফলশ্রুতি ধর্ম মত তা বহুদিন ধরেই সুন্দর পৃথিবীকে গ্রাস করে রেখেছে জগৎকে তারা হিংসায় পরিপূর্ণ করেছে মানুষের রক্তে পৃথিবীকে বারবার সিক্ত করেছে এবং জাতির পর জাতি এর ফলে হতাশায় নিমগ্ন হয়েছে। এই সমস্ত ভয়ংকর পিশাচ যদি না থাকতো , তাহলে মানব সমাজ অনেক বেশি উন্নত হতো।"
সময় বলছে, অভিজ্ঞতা বলছে, ১৩১ বছর আগে ১১ই সেপ্টেম্বর মার্কিন মুলুকে শিকাগোর আর্ট ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গণে সেদিন গেরুয়া বসনধারী ভারতীয় সন্ন্যাসী যে আবেদন রেখেছিলেন আজও সারা পৃথিবীতে অনেক মানুষ তাতে কর্ণপাত করেনি। আজও সারা পৃথিবীতে মানুষে মানুষে পরিচয় এর ভিত্তিভূমি হয়ে দাঁড়ায় ধর্ম। ধর্মের কারণে শতাব্দী ধরে লড়ে চলে ইজরায়েল আর প্যালেস্টাইন। ধর্মের কারণে বিভিন্ন দেশে দাঙ্গা, নাগরিক বিতাড়ন, অগ্নিসংযোগ লুঠতরাজ, হত্যালীলা খুব চেনা ব্যাপার। বাইরের পৃথিবীর এই কলুষ মলিন করে ভিতরের মানুষটাকে। নিমেষেই তিনি মনে করিয়ে দিতে চান, নিজের ধর্মের প্রতি সম্পূর্ণ অনুগত থেকেও অন্যের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়াটা কোন কঠিন কাজ নয় । ভারত প্রসঙ্গে ২০ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৩ তিনি বলেছিলেন ভারতে ধর্ম যথেষ্ট আছে। ভারতের সমস্যা হলো দারিদ্র্য।
১৩১ বছর বাদে এই দারিদ্র্য আজ কেবলমাত্র বাহ্যিক নয়, একান্তই আন্তরিক। প্রতিবাদে, প্রতিরোধে গর্জে ওঠার সময়েও পলাশ বিচার করে পাশে কে? আসলাম!
আর তখনই খবর যায় মন থেকে মনে, এক অন্ধকার গলির মধ্যে দিয়ে প্রচন্ড গতিতে ছুটে যাচ্ছে এক দিশাহারা সমাজ।
আর দেওয়াল থেকে হতাশায়, ক্রোধে চেয়ে দেখছেন স্বামী বিবেকানন্দ।
Comments :0