MUKTADHARA : ANAYAKATHA : SHARATCHANDRA : PALLAV MUKHOPADHAYA : 15 SEPTEMBER 2024, SUNDAY

মুক্তধারা : অন্যকথা : অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় : পল্লব মুখোপাধ্যায় : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, রবিবার

সাহিত্যের পাতা

MUKTADHARA  ANAYAKATHA  SHARATCHANDRA  PALLAV MUKHOPADHAYA  15 SEPTEMBER 2024 SUNDAY
মুক্তধারা : অন্যকথা
 
অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
পল্লব মুখোপাধ্যায়
 
বাংলার সাহিত্য গগনে অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর আবির্ভাব সেইসময় যখন বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিম যুগ প্রায় অস্তমিত আর রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রতিভা দীপ্তিতে ভাস্বর ।

১৮৭৬ সালে শরৎচন্দ্র হুগলী জেলার দেবানন্দপুর-এ জন্ম গ্রহণ করেন। বাবা মতিলাল চট্টোপাধ্যায় ও মা ভুবনমোহিনী দেবী। শরৎচন্দ্রের শৈশব ও কৈশােরকাল অতিবাহিত হয় বিহারের ভাগলপুরে মামার বাড়িতে। সেখানেই তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলেজে ভর্তি হন কিন্তু এফ. এ. পরীক্ষার ফি দিতে অপারগ হওয়ায় এখানেই তাঁর পড়ার ইতি পড়ে। শরৎসাহিত্য জগৎ আমাদের পরিচিত মৃত্তিকার জগৎ। এ জগতের প্রতিটি মানুষই আমাদের মতাে সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, পতন, প্রেম, অশ্রু tanke হাহাকার আলােড়নে উচ্ছ্বসিত। তারা সমাজে অবহেলিত, বঞ্চিত, শােষিত, অত্যাচারিত-যাদের 'বুক ফাটে তবুও মুখ ফোটে না'। শরৎচন্দ্র তাদের কথাই বলে গেছেন। তাইতাে শরৎচন্দ্র বাংলার সবচেয়ে দরদী ও জীবনরস পরিবেশনের রসিক লেখক/সাহিত্যিক/ঔপন্যাসিক ।

মাত্র চোদ্দ বছর বয়সেই শরৎচন্দ্র ‘কাশীনাথ’ নামে একটি উপন্যাস রচনা করেন। ১৯০৪ সালে তিনি 'মন্দির' নামে গল্প লিখে কুন্তলীন পুরস্কার লাভ করেন। এরপর ১৯০৭ সালে 'ভারতী' পত্রিকায় শরৎচন্দ্র 'অনিলা দেবী' ছদ্মনামে 'বড়দিদি' উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করে সাহিত্য ক্ষেত্রে পূর্ণ প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। তাঁর রচিত ‘বিন্দুর ছেলে’, ‘রামের সুমতি’ পরিণত গল্প ও ‘দেবদাস’, ‘বিপ্রদাস’, ‘দেনা পাওনা’, পথের দাবী’, ‘দত্তা’, ‘গৃহদাহ’, ‘মেজদিদি’ প্রভৃতি উপন্যাস মানুষের স্নেহ-প্রীতি, কোমল হৃদয় বৃত্তি এবং চিরন্তন মানবিক দুর্বলতার বিষয় নিয়ে রচিত। সে জন্য এ যাবতীয় রচনা সহজেই পাঠকের হৃদয় জয় করতে সক্ষম হয়েছে। তাঁর সাহিত্যে আছে অসহায়, বঞ্চিত, নির্যাতিত মানুষের প্রতি সমবেদনা। সমাজ জীবনে ঘাত-প্রতিঘাত উত্থান পতনের মধ্যে বিচিত্র নর-নারীর বৈচিত্র্যময় রূপের কত বিপুল পরিচয় যে শরৎসাহিত্যে ছড়িয়ে আছে তার ইয়ত্তা নেই।

কথাশিল্পী বা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র সকলের প্রতি সত্যের দৃষ্টিতে চেয়েছেন । তবে সামাজিক মানুষ হিসেবে বিশেষ বিশেষ করুণ চিত্রের প্রতি তাঁর সহানুভূতি বিশেষভাবে প্রকট। এ জন্য তাঁর গল্প বা উপন্যাসে দরিদ্রের প্রতি অসীম মমত্ব ছিল। সেকালে ম্যালেরিয়াপীড়িত, কলেরা-আক্রান্ত অনাহারে, অর্ধাহারে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দেশে উপনীত হওয়া মানুষগুলিকেই তিনি গভীর ভাবে ভালােবেসে ছিলেন। তাই শহরের তুলনায় গ্রামের মানুষের প্রতি তাঁর সহানুভূতি ছিল অতি প্রবল।

শরৎ সাহিত্যে নারীকে উচ্চস্থানে বসানাে হয়েছে। পুরুষ-প্রধান সমাজে নারীর ওপর যে অত্যাচার চলছে সে বিষয়ে তিনি যে সচেতন ছিলেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। নারী শুধু যে স্বামীর ভােগ্য বস্তু বা পণ্য নয় এর বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার হয়েছেন। পুরুষের মতো নারীও যে রক্ত মাংসে গড়া মানুষ এ কথা শরৎচন্দ্রের মতাে জোরের সঙ্গে তখনও পর্যন্ত আর কেউ বলেননি।

পৃথিবীর সকল অধিকারের উৎস যে প্রেম এ কথাটি শরৎচন্দ্র একবারও আমাদের ভুলতে দেননি।  শরৎসাহিত্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুরুষ এবং নারীকে শুধু ভালোবাসার মধ্যেই স্বাভাবিক অবস্থায় দেখা গিয়েছে। আর যেখানে তাদের দুঃখ, যন্ত্রণা, বিরহ প্রবল হয়ে উঠেছে সেখানেই দেখা গেছে যে তারা পারস্পরিক ভালোবাসা হতে বিচ্যুত।

শরৎচন্দ্র বালক ও কিশোরদের মনের গহনে অবলীলাক্রমে ডুব দিতে পেরেছিলেন। ‘মেজদিদি’ উপন্যাসের অসহায়, দরিদ্র, সম্বলহীন নিরুপায় বিধবার একমাত্র সন্তান চোদ্দ-র কেষ্টর সাথে ‘বিন্দুর ছেলে’ গল্পের ‘অরণ্য’ অথবা অকাল পক্ক নরেন একই জীবন্ত সত্তা নিয়ে উপস্থিত । কলমের দু-একটি আঁচড়ে এই বালক ও কিশােরগুলির মান-অভিমান অথবা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যক্তিতুগুলি যেভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা দেখলে অবাক লাগে । ‘রামের সুমতি'র রামের ছেলেমানুষী, ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের কিশাের শ্রীকান্ত, চন্দ্রনাথ, সতীশ এবং অন্যান্য বেপরােয়া কিশোর-তরুণদের কথা খুব সহজে ভোলা যায় না। কিশাের 'ইন্দ্রনাথ' চরিত্রটি তাঁর এক অনবদ্য সৃষ্টি।

বস্তুত শরৎচন্দ্রের হাতে সহজ-সরল লােকচলিত ভাষার সঙ্গে আবেগ যুক্ত হয়ে এমন হৃদয়গ্রাহী হয়ে উঠেছে যে পড়ামাত্র মরমের ভিতরে গিয়ে সাড়া জাগায়। শরৎচন্দ্রের জনহৃদয় জয়ের অন্যতম কারণ এই সহজ, সরল, অনাড়ম্বর ভাষা। এসব কারণেই বাংলা সাহিত্যের কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের জন্য নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছে শ্রেষ্ঠত্বের আসন।।

বাস্তবতা, নারীচরিত্র, পুরুষ-চরিত্র, বালক ও কিশাের চরিত্র বর্ণনা ইত্যাদি সমস্ত দিক দিয়ে বিচার করলে শরৎসাহিত্যের মােহময় জনপ্রিয়তার সর্বজনবিদিত । এখনও যদি পল্লী-বাংলার অর্ধ শিক্ষিত গৃহবধূ বলেন যে তিনি জীবনে মাত্র একখানি উপন্যাস কিংবা গল্প পড়েছেন তা হলে আমরা তাঁকে জিজ্ঞাসা না করে নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে উপন্যাস বা গল্পখানি শরৎচন্দ্রের লেখা।  


 

Comments :0

Login to leave a comment