মুক্তধারা : গল্প
‘আগুন জ্বালো… ’
সৌরভ দত্ত
ফোনটা রেখে দিয়ে অনিমেষ বলে–জানিস সৈকত আর একদম নেওয়া যাচ্ছে না…অন্ধকারের রাজত্ব। চারিদিকে রক্ত।অনিমেষ কথাগুলো বলে একটু থামল।হাতে গণশক্তির ভিতরের পাতাটা ।রোজ কত কত প্রতিবাদ মিছিলের ছবি ।হাতে মোমবাতি,পথ নাটকে রক্তাক্ত সময়কে তুলে ধরা।শিশুরা হাঁটছে,টানা রিক্সাওয়ালারা হাঁটছে।তার আক্ষেপ এর মাঝে কিছু বাজারি সংবাদপত্র , নিউজ চ্যানেলে একটা ধর্মীয় বিষয়কে নিয়ে ভাইব তুলতে ব্যস্ত। নিজের মনে একাধিক প্রশ্নচিহ্ন উঁকি দেয়।সুপরিকল্পিতভাবে তিলোত্তমা মৃত্যুর আবহেও দেশজুড়ে ধুমধাম করে গণেশ চতুর্থী পালনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতে এই পুজোর হার অনেক বেশি হলেও মহারাষ্ট্রের মানুষের কাছে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য এই গণেশ চতুর্থীর আয়োজন। ইতিমধ্যেই বাপ্পাকে নিয়ে হোয়াটস অ্যাপ, ইনস্টাগ্রামে স্ট্যাটাস দেওয়া বা রিলস বানানোর ধূম পড়ে গেছে। অনেকে একে বলছেন সিদ্ধি বিনায়ক উৎসব।এই কদিনে গ্রাম-শহরে ডি.জে বক্সের তাণ্ডব বৃদ্ধি পাবে অনেক গুণ ফলত শব্দদূষণ বাড়বে। উৎসবের নামে জাঁকজমকপূর্ণভাবে গণপতি বাপ্পা মোরিয়ার জগঝম্প মুখরিত পরিস্থিতিতে তিলোত্তমা হত্যার এক মাস পূর্তি বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে গণজাগরণ এর মূল বিষয়টা আমরা ভুলে না যাই । বারবার কথাগুলো অনিমেষের স্বপ্নে-জাগরণে ঘুরে ফিরে আসছে।এই কদিনে রাজ্যজুড়ে বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদী গণ আন্দোলনের কর্মসূচি রয়েছে। সেই আন্দোলনকে বাঞ্চাল করতেই স্যোশাল মিডিয়ায় ও পুজো-প্যাণ্ডেলে গণপতি বাপ্পাকে নিয়ে চলছে মাতামাতি।সকল মানুষের আবেগকে সম্মান জানিয়ে বলি– সকলে মানবধর্মের সাধনা করুন,সত্যাসত্যের সাধনা করুন, ন্যায় ধর্মের সাধনা করুন। কবীর, লালন, চৈতন্য, বিবেকানন্দ যেমনটা করেছেন। ক্রমশ বিক্রিত বিচারব্যবস্থা যেন প্রহসনে না পরিণত হয়। লক্ষ-কোটি বাঙালির কাঙ্খিত—‘জাস্টিস’ যেন আসে।আমরা ভুলছি না আর.জি করে ঘটে যাওয়া এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের রেশ। কদিনের টানা কর্মসূচিতে রণক্লান্ত,বিধ্বস্ত অনি প্রচণ্ড ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুমের চমকটা ভাঙতেই চোখ কচলে আয়নার সামনে উঠে দাঁড়ালো। বন্ধু সৈকত এসেছে তাকে ডাকতে– কি রে আজকে বাজারের মিছিলে যাবি না!তিলোত্তমা হত্যার সাথে যুক্ত অন্যায়কারীদের শাস্তি চাই।চল আগামী রাত দখলের মিছিলে আমরাও পা মেলাই। অরাজনৈতিক মিছিল।সকলে সমস্বরে গলা ফাটিয়ে বলি–তিলোত্তমার রক্ত হবে নাকো ব্যর্থ…অনিচ্ছা সত্ত্বেও বন্ধুর অনুরোধে অনি মিছিলে যায়।বাজারের আট চালায় একটা দলের বেশ কিছু পতাকা ঝুলছে । সাথে কিছু জাতীয় পতাকা।মুকাভিনয় হচ্ছে। তিলোত্তমার বিচার চাই বলতে বলতে হঠাৎ কয়েকজন চিৎকার করে ওঠে–ভারতমাতার বিচার চাই, ভারতমাতার জয়,দফা এক দাবি এক… ।অনির চোখেমুখে বিমর্ষতার ছাপ।এটার জন্য সে আদৌ প্রস্তুত ছিল না। সৈকতকে সে কিছু বলতে পারে না।এরপর পাশের মণ্ডপ থেকে গণেশ পুজো কমিটির সদস্যরা পনির,পোলাও এর অগুনতি পার্সেল নিয়ে এসে হাজির হয়। হুল্লোড় এর মধ্যে বেশকিছুজন অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায়। তাদের মাথায় গেরুয়া ফেট্টি।স্লোগান ওঠে– গণপতি বাপ্পা মোরিয়া। এতক্ষণ রাস্তা দখল করে রাত দখলের কর্মসূচি চলছিল। টায়ার পোড়ানো হচ্ছিল।নাচ-গান হচ্ছিল।তা অচিরেই থেমে যায়।পারফর্মার থেকে আম পাবলিক সবাই পার্সেল নিতে ও খেতে ব্যস্ত হয়ে যায়। তিলোত্তমার স্লোগান হারিয়ে যায় কর্কশ ধ্বনির মাঝে। অনির বুঝতে বাকি থাকে না পাড়ার মেয়েদের আন্দোলনটা হাইজ্যাক হয়ে যাচ্ছে।মহিলা সমিতির পিছনে আসলে কারা ফান্ডিং করছে। মেহেদীপুরের আকাশের দিকে তাকিয়ে আর একটা সন্দেশখালি দেখতে পায় অনি।তার স্মৃতিপটে বহুদূরে নাগরিক সমাজের আহ্বানে অন্য একটা মিছিলে জেগে ওঠার গান বেজে ওঠে –“ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো।।”
Comments :0