Olympics

অলিম্পিক মঞ্চে রাজনীতির ছায়া

ফিচার পাতা খেলা

রিদ্ধি রিত 
অলিম্পিক গেমস বললেই প্রথম মনে আসে পৃথিবীর সব থেকে প্রাচীন ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। সেখানে রাজনীতি শব্দটা ঠিক মানানসই নয়। বহু শতাব্দীর ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, গ্রিসের অলিম্পিয়াতে অলিম্পিক গেমসের সূত্রপাত ৭৭৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। তখনও প্রতি চার বছর অন্তর এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতা চলত। যা প্রায় ৩৯৪  খ্রিস্টাব্দে শেষ হয়। সেই সময় অলিম্পিক ছিল মানবতার চিরন্তন অনুসন্ধানে শ্রেষ্ঠত্বের উদ্‌যাপন। প্রাচীন গ্রিকসংস্কৃতি, সমাজের মূল্যবোধ, বিশ্বাস এবং ঐতিহ্যের প্রতিফলন ধরা পড়ত। রোমান সাম্রাজ্য গ্রিস দখল করলে প্রাচীন অলিম্পিকের পরিসমাপ্তি ঘটে। সেই সময় থেকেই অলিম্পিকে রাজনীতি যোগ।  
এর বহুদিন বাদে ১৮৯৪ সালে আধুনিক সময়ের অলিম্পিক গ্রীষ্মকালীন গেমসের জন্ম। যার পুরোধা ফরাসি শিক্ষাবিদ ব্যারন পিয়ের দ্য কুবেরত্যাঁ। তাঁর প্রস্তাবেই পুনরুজ্জীবন ঘটেপ্রাচীন ঐতিহ্য বহনকারী এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতার। যদিও অলিম্পিকের পুনর্জীবিত করার চিন্তাভাবনা শুরু উনবিংশ শতাব্দীরই শুরুর দিকে। অটোমান সাম্রাজ্যের থেকে মুক্তির জন্য ১৮২১ সালে গ্রিসে মুক্তিযুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে জয়লাভ করার পর থেকেই গ্রিকরা এই অলিম্পিক গেমসকে পুনর্জীবিত করার চিন্তাভাবনা করে আসছিল। অলিম্পিকের এই পুনর্জাগরণের স্বপ্নদ্রষ্টা হলেন প্যানাজিওটিস সটসস, যিনি ছিলেন একাধারে কবি ও সংবাদপত্রের সম্পাদক। ১৮৩৩ সালে ডায়ালগ অব দি ডেড নামে একটি কবিতায় তাঁর এই চিন্তা তুলে ধরেন। পরবর্তীতে ইভাঞ্জেলোস জ্যাপ্পাস নামের এক বিত্তশালী এবং লোকহিতৈষী ব্যক্তি গ্রিসের রাজা অট্টোকে একটি চিঠির মাধ্যমে অলিম্পিক গেমস পুনরায় স্থায়ী ভাবে চালু করার জন্য একটি তহবিল গঠনে সহায়তা করতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ১৮৫৯ সালে জ্যাপ্পাসের পৃষ্ঠপোষকতাতেই এথেন্সের সিটি স্কোয়ারে অলিম্পিক গেমস অনুষ্ঠিত হয় যেখানে অটোমান সাম্রাজ্য এবং গ্রিসের ক্রীড়াবিদেরা অংশগ্রহণ করেছিল। জ্যাপ্পাস সেই সময় একটি স্টেডিয়ামও সংস্কার করান যাতে করে ভবিষ্যতে অলিম্পিক আসরগুলো নির্বিঘ্নে অনুষ্ঠিত হতে পারে। 
জ্যাপ্পাসের সংস্কারকৃত স্টেডিয়ামে ১৮৭০ এবং ১৮৭৫ সালের অলিম্পিক গেমস অনুষ্ঠিত হয়। ১৮৭০ সালের অলিম্পিকে প্রায় তিরিশ হাজার দর্শক উপস্থিত হয় তবে ১৮৭৫ সালে কত দর্শক হয়েছিল তার প্রামাণ্য তথ্য পাওয়া যায়নি। ১৮৯০ সালের ওয়েনলক অলিম্পিয়ান সোসাইটির অলিম্পিয়ান গেমস দেখে ব্যারন পিয়ের আন্তর্জাতিক অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠার কথা ভাবেন। যে কমিটির পরিকল্পনা ছিল প্রতি চার বছর অন্তর বিভিন্ন দেশে অলিম্পিক গেমসের আয়োজন। এর ফলে সারা বিশ্বে আরও প্রসারিত হতে শুরু করে অলিম্পিক গেমস। এর উদ্যেশ্য ছিল এক সঙ্গে বহু জাতির অ্যাথলেটিকিজম এবং মানসিক শক্তি উদ্‌যাপনকে একত্রিত করা। ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটির লক্ষ্য ছিল বৈষম্য মুক্ত, বন্ধুত্ব, সংহতি। এমনকি আইওসি তার সনদে অলিম্পিক যুদ্ধবিরতির ধারণাকে প্রচার করে। তারপরও রাজনীতির ছায়া অলিম্পিক গেমসকে প্রকট হয়েছে প্রমাণও ইতিহাস জুড়ে।  
১৯৩৬ বার্লিন অলিম্পিক 
সেই সময় জার্মানিতে অ্যাডলফ হিটলারের নাৎসি শাসন চলছে। জার্মানির বর্ণবাদী নীতি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে বার্লিন অলিম্পিক বয়কট করার সিদ্ধান্ত নেয় বেশ কিছু দেশ। তবুও, ৪৯টি দেশ বার্লিনে গেমসে অংশ নিয়েছিল। সেই অলিম্পিকের সব থেকে বড় ঘটনা আমেরিকান স্প্রিন্টার এবং লং জাম্পার জেসি ওয়েনস রেকর্ড গড়ে চারটি স্বর্ণপদক জেতেন।তবে তিনি একজন কৃষ্ণাঙ্গহওয়ায় হিটলার তাঁর খেলা বয়কট করেন। 
১৯৪৮ লন্ডন অলিম্পিক 
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথম অলিম্পিক গেমসে অনুষ্ঠিত হয় লন্ডনে। মিত্র পক্ষে থাকা গ্রেট ব্রিটেন নিজেদের শহরে আমন্ত্রণ জানায়নি জার্মানি এবং জাপানকে। মিত্র পক্ষের সোভিয়েত ইউনিয়নকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও তাঁরা বয়কট করার সিদ্ধান্ত নেন। তার কারণ হিসাবে সোভিয়েত তুলে ধরে চাঞ্চল্যকর এক তথ্য। জানা যায় গ্রেট ব্রিটেনে রাখা জার্মান যুদ্ধ বন্দিদের দিয়ে ওয়েম্বলি ওয়ে নির্মাণ করানোর ঘটনা। ওয়েম্বলি ওয়ে ছিল লন্ডনের আন্ডারগ্রাউন্ড রাস্তা, যা ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামকে যুক্ত করে। অলিম্পিকের প্রস্তুতির জন্য সীমিত সময় থাকায় শেষ পর্যন্ত লন্ডন শহরে প্রতিযোগিতার ক্রীড়ঙ্গন এবং আবাসন সুবিধাগুলি সম্পূর্ণ হয়নি। তাই ওয়েম্বলি স্টেডিয়াম ব্যবহার করা হয়েছিল। সেখানেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, অ্যাথলেটিক্স ইভেন্ট সহ বেশ কিছু ইভেন্ট আয়োজন করা হয়।  
১৯৫৬ মেলবোর্ন অলিম্পিক 
দুটি বিক্ষোভের ফলে ৬৭টিরও কম দেশ মেলবোর্ন অলিম্পিক গেমসে অংশগ্রহণ করে। ১৯৫৬ সালের অক্টোবরে ইজরায়েলী ব্রিগেডসিনাই উপদ্বীপে আক্রমণ করলে মধ্যপ্রাচ্যে সুয়েজ সঙ্কট দেখা দেয়। মিশর, লেবানন এবং ইরাক, ইজরায়েলের আক্রমণ এবং তার মিত্রদের সমর্থনের প্রতিবাদে গেমস বয়কট করে। অনুষ্ঠান শুরুর কয়েক সপ্তাহ আগে সোভিয়েত সেনাবাহিনী হাঙ্গেরির বুদাপেস্ট আক্রমণ করে। এই আক্রমণের প্রতিবাদে নেদারল্যান্ডস, স্পেন এবং সুইজারল্যান্ড গেমস থেকে প্রত্যাহার করে নেয়।

১৯৬৮ মেক্সিকো সিটি অলিম্পিক 
মেক্সিকো শহরে ১৯৬৮ সালের অলিম্পিকে দুটি বড় রাজনৈতিক ঘটনা ঘটে। গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের দশ দিন আগে, মেক্সিকান শিক্ষার্থীরা মেক্সিকো সিটির তলাতেলোলকো পাড়ায় প্লাজা অব থ্রি কালচারে (প্লাজা দে লাস ট্রেস কালচারাস) বিক্ষোভ করে। তারা সামাজিক কর্মসূচির পরিবর্তে অলিম্পিক গেমসের জন্য সরকারি তহবিল ব্যবহারের বিরোধিতা করেছিল। মেক্সিকান সেনাবাহিনী প্লাজা ঘেরাও করে এবং গুলি চালায়। তাতে দুশো জনেরও বেশি বিক্ষোভকারীকে হত্যা এবং হাজারেরও বেশি বিক্ষোভকারীকে আহত করা হয়। এই নৃশংসতা যা তলাতেলোলকো গণহত্যা হিসাবে পরিচিত হয়েছিল। দ্বিতীয় ঘটনাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্প্রিন্টার টমি স্মিথ এবং জন কার্লোস পুরুষদের ২০০ মিটারের পুরস্কার অনুষ্ঠানে কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকদের সঙ্গে দেশের আচরণের প্রতিবাদ করেন। তারা তাদের প্রথম এবং তৃতীয় স্থানে থাকা পডিয়ামে খালি পায়ে ওঠেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীত বাজানোর সময়, মাথা নিচু করে একটি কালো দস্তানা তুলে ধরেন। স্মিথ এবং কার্লোসকে অবিলম্বে আইওসি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অলিম্পিক কমিটি নিষিদ্ধ করেছিল। 
১৯৭২ মিউনিখ অলিম্পিক 
এই অলিম্পিকে ইজরায়েলের দল ফিলিস্তিনি হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অলিম্পিক ভিলেজে ঢুকে ইজরায়েলী দলের দুই সদস্যকে হত্যা করে এবং২০০ ফিলিস্তিনি বন্দির মুক্তির জন্য আরও ন’জনকে বন্দি করে একদল ফিলিস্তিনি। এরপর জার্মান পুলিশের অতর্কিত আক্রমণে ইজরায়েলী নয় বন্দি, পাঁচজন ফিলিস্তিনি ও এক জার্মান পুলিশের মৃত্যু হয়। 
১৯৭৬ মন্ট্রিল অলিম্পিক  
নিউজিল্যান্ডের জাতীয় রাগবি দল দক্ষিণ আফ্রিকা সফর করার সময় বর্ণবাদ ঘটনায় জড়িয়ে পড়ায় নিউজিল্যান্ডকে গেমস থেকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানায় প্রায় ২৪টি দেশ। আন্তর্জাতিক অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন নিউজিল্যান্ডকে গেমস থেকে নিষিদ্ধ করতে অস্বীকার করায় আফ্রিকান দেশগুলি অলিম্পিক বয়কট করে। 
২০১৬ রিও ডি জেনেরো অলিম্পিক 
এই অলিম্পিক গেমসেই প্রথম উদ্বাস্তু অলিম্পিক দল দেখা যায়। ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরো অলিম্পিকের জন্য প্রথম শরণার্থী অলিম্পিক দলে দশজন শরণার্থী ক্রীড়াবিদকে নির্বাচিত করা হয়েছিল। শরণার্থী সঙ্কটকে আন্তর্জাতিকভাবে সামনে আনতে মূলত সিরিয়া, দক্ষিণ সুদান, ইথিওপিয়া এবং কঙ্গো গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের ক্রীড়াবিদদের একটি দল প্রস্তুত করা হয়। অলিম্পিকের পতাকা নিয়ে ব্রাজিলের আগে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রবেশ করেছিল এই দল।

 


২৬ জুলাই থেকে শুরু হতে চলেছে ২৯তম অলিম্পিক। টোকিও অলিম্পিকের পর ও প্যারিস অলিম্পিকের মধ্যে ঘটেছে ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধ বা প্যালেস্তাইনের ওপর ইজরায়েলের আক্রমণের মতো নৃশংস ঘটনা। এবারের অলিম্পিকওকি তবে এই আবহেই নতুন কিছু দেখতে চলেছে!

Comments :0

Login to leave a comment