STORY — SOURAV DUTTA | VENISH — NATUNPATA | 24 JUNE 2024

গল্প — সৌরভ দত্ত | ভ্যানিশ — মুক্তধারা | ২৪ জুন ২০২৪

সাহিত্যের পাতা

STORY  SOURAV DUTTA  VENISH  NATUNPATA  24 JUNE 2024

গল্প

ভ্যানিশ

সৌরভ দত্ত

মুক্তধারা

 

জমি‌জমা,ঘর-বাড়ি জবরদখল করা‌ এখন একপ্রকার প্যাশন হয়ে গিয়েছে। নদীর স্রোত আর আগের মতো নেই নদীর বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে কংক্রিটের পিলার। নদীর পাড় ভেঙে গেছে।।তবু নদীটা কিন্তু বয়েই চলেছে। ওপারে নীল কুঠির বাঁধ।জ্বাল ঘরের ভাঙা অংশটা নদাইদের ডাঙা থেকে এখনো কিছুটা দেখা যায়।পাশে‌ই বেলডুবির মাঠ। রাস্তার ধারে বড় তেঁতুল গাছটার বয়স নয় নয় করে দেড়শো বছর‌ হবে। গাছের তলায় দাঁড়ালে দূরে তেপান্তরের মাঠ।এককালে গ্রামের তালপাতার পাঠশালায় পড়াতেন জীবনহরি ঘোষাল,কালি ভট্টাচার্য,মিছরি পণ্ডিতরা। সকালের আলো ফুটলে বাচ্চারা‌ পড়তে‌ যেত।ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলের প্রথম সংস্করণ ছিল মিছরি বাবুর সংগ্রহে সাথে আরও অনেক অনেক‌ মূল্যবান বই। যেগুলো তার মৃত্যুর পর উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের‌ অভাবে নষ্ট হয়ে গেছে।গত দশ-পনেরো বছরে গ্রামের ইস্কুলগুলো উইনশনের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। ছেলেপুলেরা ইস্কুলে আসতেই চায় না।দিনে রাতে দল বেঁধে মোবাইলে পাবজি খেলে।হাজিরা খাতায় দেখানো হয় পড়ুয়াদের ভুতুড়ে উপস্থিতি।মাস্টাররাও ছেলেপুলেদের সাথে তৃপ্তিতে ডিম্ভাত খায়।বাড়ি যায়। গরমের ঠেলায়‌ আবার মর্নিং স্কুল।কেউ কেউ‌ আবার আশঙ্কায় থাকে–’এই‌,এই আমার চাকরিটা‌ চলে যাবে নাতো!’এখন বাংলার ইউটোপিয়ায়‌ ভরসা‌ বলতে টিউটোপিয়া।পড়াশোনার জন্য অ্যাপ এসেছে। অনেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ের কায়দায় ইলেভেনে সেমিস্টার সিস্টেম চালু হয়েছে।স্কুলের স্টাফরুমে– অযোধ্যায় রামমন্দির,কাঞ্চন-কামিনী, জামাইষষ্ঠীর খাওয়া দাওয়া এইসব নিয়ে আলোচনা করে।টেক্সট বই‌য়ের আগে বাজারে চলে আসছে সহায়িকা।ছুটির ঘন্টা পড়ার আগেই কেউ বাইকে স্টার্ট দেয়।জীবেশবাবুর মাসুমগঞ্জের হাটে কাপড়ের গুমটি নেওয়া প্রতি শুক্রবার তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যান।সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হেডমাস্টারদের পোর্টালের ঠেলায় জেরবার। আপলোড চলছে তো চলছেই‌।মিড-ডে মিলে তছরুপ।এভাবেই চলছে নীলসাদা‌ স্কুলগুলো।চাপড়ায় মাঠে এক সময় ভালো বাদাম চাষ হত।গত ক’বছর বুনো শুয়োরের উৎপাতে তা বন্ধ।রাত্রিরে দলকে দল এসে গাছের গোড়া উপড়ে মুড়িয়ে খেয়ে যায়। বিশেষত কন্দ জাতীয় গাছ বেশি খায়।ফলত চাষবাস শিকেয় উঠেছে।দামুর চালকলে আর অপুদের মুদিখানার দোকানে এখন আর সেরকম ভিড় নেই।পঞ্চাদার বৌ অনলাইনে চা,চিনি অর্ডার করে। বৌদির কসমেটিকস থেকে অন্তর্বাস পর্যন্ত সব চলে আসে।পঞ্চাদার সুগার আছে‌ বলে‌ মিশো -তে স্টিভিয়া পাতা আসে।জন্মদিনে সুইগিতে আর্ডার করে হান্ডি চিকেন আর মাটন বিরিয়ানি আনায় তাপসবাবুর মেয়ে।মাঝে মাঝে লোকজন না থাকলেও মদন তাঁতির মতো দামু মেশিনটা এমনিই চালিয়ে দেয়।কাঠের টুলে বসে সে জিরেন করে।মেশিনের বেল্টটা ঘুরতে থাকে।মাস ছয়েক আগে হঠাৎ স্ট্রোক হওয়ায় দামুর বাঁ-হাতটা পড়ে গেছে।চালকলের ভিতরে দামুর বাপের আমলের অব্যবহৃত ঢেঁকিটা পড়ে আছে।তাতে জাল বুনেছে কিছু মাকড়শা।

আকাশমণি গাছের দিকে তাকিয়ে দামু দেখছিল আকাশটা একটু একটু কালো হচ্ছে। সন্ধ্যে ঘনাচ্ছে।সে ঘরে ফেরার জন্য গোচগাছ করছিল যখন হঠাৎ মণ্ডলের দলবল এসে হাজির।ওরা দামুর চালকলটা‌ নিয়ে নিতে চায় ।ওখানে নিকেল প্লেটিং এর ওয়ার্কশপ হবে।কিছুদিন আগে একটা পরিবেশ সংগঠনের তরফে গ্রামের নদীর জলের সংগৃহীত নমুনা পরীক্ষার রিপোর্টে দেখা গেছে এখানকার নদী দূষণের প্রধান কারণ নিকেল-ক্রোমিয়ামজাত যৌগের মিশ্রণ।অনেকদিন ধরেই দামু কানাঘুষো শুনছিল–সাধের চালকলটাও না একদিন দুর্বৃত্তদের হাতে চলে যায়।আর ওরা সদ্য লোকসভা ভোটে জিতেছে।জিততে না জিততেই হাত পড়ল চালকলটায়।ওদের দলে থাকা রাণা হঠাৎ বন্দুকটা উঁচিয়ে ধরে দামুর বুকের কাছে।অযথা ভাঙচুর চালায়।জোর করে দশ টাকার স্ট্যাম্প পেপারে চুক্তিনামা লিখে রামুকে দিয়ে জোর করে সই সাবুদ করিয়ে নেয়।একটা গুলি তার চোখের ভিতর দিয়ে ঢুকে যায়।ওরা বাইকে স্টার্ট দিয়ে চলে যায় মহিশামুড়ির দিকে।আকাশ জুড়ে রক্তাভ মেঘ ছড়িয়ে দিচ্ছে বৃষ্টি। আলোহীন অন্ধকার চারিদিকে।নিথর পড়ে আছে রামুর দেহটা।চালকলের কুলুঙ্গিতে যত্নে তুলে রাখা মিছরি পণ্ডিতের খড়মটা বৃষ্টির জলে  উদ্দেশ্যহীন ভেসে চলেছে…গ্রাম থেকে… গ্রামান্তরে…

কিছুটা দূরে দামুদের খামারবাড়িতে হ্যারিকেন জ্বলছে।পাতকুয়োর পাশে‌ ধানের মারাই। ঘরের দেওয়ালে তার মায়ের শরীরের ছায়া পড়ছে।আর কিছু পরেই হয়ত দামুর বাড়িশুদ্ধ চালকলটা‌ একেবারে ভ্যানিশ হয়ে যাবে!

 

Comments :0

Login to leave a comment