Year ending

গণসংগ্রামের বর্ষ

জাতীয় রাজ্য আন্তর্জাতিক

১) গণসংগ্রামে মুখরিত বর্ষ
মোদী সরকার অপ্রতিরোধ্য নয়। শ্রমিক-কৃষক-খেতমজুরদের ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী লড়াই মোদী সরকারকে ক্ষমতা থেকে হটানোর পূর্ণ শক্তি রাখে। নভেম্বর মাসে গোটা দেশের সঙ্গে এরাজ্যেও কেন্দ্রীয় সরকারের কৃষক বিরোধী, শ্রমিক বিরোধী, জনবিরোধী ও জাতীয় স্বার্থ বিরোধী নীতির প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশ ও রাজভবন অভিযানে শামিল হয় কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন ও ফেডারেশনসমূহের যৌথ মঞ্চ ও সংযুক্ত কিষান মোর্চা। সমাবেশে হাওড়া, শিয়ালদহ সহ বিভিন্ন দিক থেকে শ্রমিক, কৃষক, খেতমজুর, কর্মচারীদের বিশাল মিছিল এসে পৌঁছায় সমাবেশ স্থলে। রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ের তিনটি রাস্তাই কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে লাল পতাকায়। এই বছরেই নয়া শিক্ষানীতির প্রতিবাদে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে আন্দোলন করেছে ছাত্ররা, কলকাতায় রাতভর অবস্থান কর্মসূচি করেছে এসএফআই। 
এই নভেম্বরের শুরুতেই বাংলার যৌবনের ইনসাফ যাত্রা শুরু হয়েছে। ৩ নভেম্বর কোচবিহার শহর থেকে যাত্রা শুরু করে ডিওয়াইএফআই’র ডাকা ইনসাফ যাত্রা ২২ ডিসেম্বর কলকাতায় যাদবপুরে এসে শেষ হয়েছে। শুধু যুবরাই নয়, শ্রমিক কৃষক খেতমজুর শিক্ষক কর্মচারী মহিলা সহ সমাজের সব অংশের মানুষ ইনসাফ যাত্রায় মিলে গিয়েছেন, রসদ জুগিয়েছেন। যাত্রাপথের অভিজ্ঞতা, মানুষের জীবন যন্ত্রণার কথা শুনিয়ে যুবনেতৃবৃন্দ জানিয়েছেন, প্রতিটি অশ্রুবিন্দুর ইনসাফ চাই। তার জন্য ৭ জানুয়ারি যৌবনের ডাকে ব্রিগেড সমাবেশ হবে।

২) তামাশা নয় শাস্তি চাই, দাবি গণসমাবেশে 
তদন্তের নামে তামাশা বন্ধ করে ইডি সিবিআই যাতে এরাজ্যের দুর্নীতির মাথাদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে শাস্তির ব্যবস্থা করে তার জন্য বিধাননগর সিজিও কমপ্লেক্স ঘেরাও করে গণসমাবেশ করেছে সিপিআই(এম)। ৫ অক্টোবর হাজার হাজার মানুষের সমাবেশ থেকে এই দাবিতে প্রস্তাব পাশ করার পরে সিপিআই(এম) নেতৃবৃন্দ সিজিও কমপ্লেক্সে গিয়ে কেন্দ্রীয় এজেন্সির অফিসারদের হাতে তা তুলে দিয়েছেন। ‘চোর ধরো, জেলে ভরো’ স্লোগান তুলে উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, কলকাতা, নদীয়া, হাওড়া, হুগলীর বিভিন্ন এলাকা থেকে বহু মানুষ অংশ নিয়েছিলেন এই অভিযানে। সিপিআই(এম) নেতৃবৃন্দ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, লড়াই আদালতে হবে, লড়াই রাস্তাতেও হবে। ইডি সিবিআই যদি দুর্নীতিগ্রস্তদের শাস্তি দিতে না পারে তাহলে মানুষ সড়কে নেমে লড়াই করে ন্যায়বিচার আদায় করে ছাড়বে। 
৩) চুরির ধারাবাহিকতা
দুর্নীতির সিরিয়াল কিছুতেই শেষ হচ্ছে না। নিয়োগ দুর্নীতির পরে ২০২৩ সাল জুড়েও রাজ্যে একের পর দুর্নীতির ঘটনা প্রকাশ পেয়েছে। নতুন করে সামনে এসে গেছে রেশন দুর্নীতি এবং পৌরসভায় নিয়োগ দুর্নীতির ঘটনা। রেশনে রাজ্যবাসীকে কম আটা, চাল দেওয়া হয়েছে। ভুয়ো রেশন কার্ড বানানো হয়েছে দেদার। সেই ভুয়ো কার্ডের বরাদ্দ চাল, আটা বাজারে বিক্রি করে কয়েক হাজার কোটি টাকা চুরি হয়েছে রাজ্যে। এই রেশন দুর্নীতিতে জেলে গেছেন তৃণমূলের মন্ত্রীসভার অন্যতম সদস্য ও প্রাক্তন খাদ্য মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। এছাড়াও দুর্নীতি মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন যুব তৃণমূলের নেতা কুন্তল ঘোষ, তল্লাশির সময় বাড়ির পাঁচিল টপকাতে গিয়েও ধরা পড়েছেন তৃণমূল বিধায়ক জীবনকৃষ্ণ সাহা। মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো তৃণমূল সাংসদ অভিষেক ব্যানার্জির সংস্থার কর্মী সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র ওরফে কালীঘাটের ‘কাকু’র মুখ বন্ধ করতে সরকারি তৎপরতা বিস্ময়কর পর্যায়ে পৌঁছেছে। অভিযোগ এসএসকেএম হাসপাতালে টানা ভর্তি করে রেখে তাঁর কন্ঠস্বর পরিবর্তনের চেষ্টা হয়েছে যাতে মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারকে রক্ষা করা যায় তদন্তের হাত থেকে। দুর্নীতির দাগ গোটা বছর জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে তৃণমূলে এবং প্রশাসনে। কিন্তু ইডি সিবিআই’র তদন্তের অগ্রগতি এতটাই শ্লথ যে আদালতের বিচারপতি বলেছেন, ‘আর কত সময় লাগবে? দুর্নীতি তদন্তের পরিণতি যেন সারদার মতো না হয়।’

৪) ৫০ সাংবাদিকের বাড়িতে হানা
ভোর থেকে বেনজির এক অভিযানে দিল্লি পুলিশ প্রায় ৫০ জন সাংবাদিক ও লেখকের বাড়িতে হানা দিয়েছে অক্টোবর মাসে।  ‘নিউজক্লিক’ ওয়েবসাইটের সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থ ও ওই সংবাদমাধ্যমের প্রশাসনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত অমিত চক্রবর্তীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের দু’জনের বিরুদ্ধেই ইউএপিএ ধারা যুক্ত করা হয়েছে। একের পর এক সাংবাদিক, লেখকের বাড়িতে পুলিশ হানা দিয়ে তাঁদের ল্যাপটপ, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়া হয়েছে। শুধু রাজধানী দিল্লি নয়, ৫টি শহরের প্রায় পঞ্চাশটি জায়গায় পুলিশ একযোগে হানা দিয়েছে। এডিটর্স গিল্ড সহ বহু সাংবাদিক সংগঠনের পক্ষ থেকে এই অভিযানকে গণতন্ত্র ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপরে আক্রমণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
৫) সিঙ্গুরের জন্য টাটাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে রাজ্যকে 
সিঙ্গুরের নির্মীয়মাণ কারখানা একতরফাভাবে বন্ধ করে দেওয়ায় টাটা মোটরসকে ৭৬৬ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে। অক্টোবর মাসের শেষে এই নির্দেশ দিয়েছে সালিশি ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনালের রায় অনুযায়ী ২০১৬-র সেপ্টেম্বর থেকে বার্ষিক ১১ শতাংশ হারে সুদও পাবে টাটারা। যতদিন ক্ষতিপূরণ মিটিয়ে দেওয়া না হয় ততদিন এই সুদ গণনা চলবে। প্রায় ৮০ শতাংশ নির্মাণ হয়ে যাবার পরে সিঙ্গুরে তৃণমূলের নেতৃত্বে হিংসাশ্রয়ী আন্দোলন তুঙ্গে উঠলে ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে টাটারা গুজরাটের সানন্দে এই কারখানা স্থানান্তরিত করেছিল।
৬) উদ্ধার টানেলবন্দি শ্রমিকরা
উত্তরাখণ্ডে সিলকিয়ারা টানেলে ১৭ দিন আটকে থাকার পর ৪১ জন শ্রমিককে উদ্ধার করলেন শ্রমিকরাই। অত্যাধুনিক যন্ত্র অগার মেশিন যা পারেনি, বিশেষজ্ঞ প্রযুক্তবিদরা যা করতে গিয়ে দিনের পর দিন ধরে হিমশিম খেয়ে গেছেন, তা-ই করে দিয়ে শ্রমিক ভাইদের উদ্ধার করে আনলেন খনিতে কাজ করা নির্ভীক শ্রমিকরাই। সারা দেশ উদ্বিগ্ন হয়ে তাকিয়ে ছিল, ধর্ম, ভাষা, জাতির ব্যবধান মুছে দিয়ে উদ্ধারকারীরা একে একে বের করে আনলেন টানেলের ভিতর থেকে। মুক্তির স্বাদ পেয়ে গলা জড়িয়ে আনন্দের অশ্রু ঝরিয়েছেন অপরিচিত কিন্তু একই শ্রেণির মানুষ।
৭) আইফোনে আড়িপাতা!
বিরোধীদের আইফোনে আড়িপাতার ব্যবস্থা মোদীর! ফাঁস অ্যাপেলের সতর্কবার্তায়। সীতারাম ইয়েচুরি, রাহুল গান্ধী, শশী থারুর সহ বিরোধী নেতানেত্রীরা অভিযোগ তুলেছেন, তাঁদের ফোন হ্যাক করা হচ্ছে বলে আইফোন নির্মাতা সংস্থা অ্যাপল’এর থেকে তাঁরা সতর্কবার্তা পেয়েছেন। সতর্কবার্তায় বলা হয়েছিল, রাষ্ট্র পরিচালিত হ্যাকারেরাই এই কাজ করছে এবং কে, কী করেন, তা দেখেই ফোন হ্যাক করার চেষ্টা হচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। এর আগে পেগাসাস ব্যবহার নিয়ে অভিযোগের নিষ্পত্তি হয়নি। এবার আই ফোন হ্যাকের অভিযোগ উঠে এল মোদী সরকারের বিরুদ্ধে। 
৮) কৃত্রিম মেধা
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই’র প্রয়োগ নতুন সম্ভাবনা ও আশঙ্কা দুই’ই জাগিয়েছে। ভারতে প্রথম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পরিচালিত সংবাদ পাঠিকা দেখা গেল টেলিভিশন চ্যানেলে। কিন্তু এমনিতেই অর্থনীতির বেহাল দশায় কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত হচ্ছে, তার মধ্যে এআই’র ব্যাপক ব্যবহারে নির্দিষ্ট বেশ কিছু ক্ষেত্রে ছাঁটাইয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। 
৯) ট্রেন দুর্ঘটনা
ওডিশার বালেশ্বরে ট্রেন দুর্ঘটনায় তিনশো’র বেশি যাত্রীর প্রাণহানি ঘটেছে জুন মাসে। চেন্নাইগামী করমণ্ডল এক্সপ্রেস, হাওড়ামুখী যশবন্তপুর এক্সপ্রেস এবং একটি মালগাড়ি পরস্পরকে ধাক্কা মারায় এই দুর্ঘটনা। কয়েক মিনিটের ব্যবধানে পরপর এই তিন ট্রেন একই লাইনে দুর্ঘটনায় পড়ায় রেল চলাচলের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বালেশ্বরের পরে বাহানাগা বাজার স্টেশনের একটু আগে করমণ্ডল লুপ লাইনে ঢুকে পড়েছিল। সেই লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা মালগাড়িকে ধাক্কা মেরে উলটে যায় করমণ্ডলের অধিকাংশ কামরা। এবার তীব্র গতিতে ছুটে আশা যশবন্তপুর এক্সপ্রেস ওই কামরাগুলিতে এসে ধাক্কা মারায় উলটে যায় সেই ট্রেনেরও বেশ কয়েকটি কামরা। 
১০) নজিরবিহীন খাঁড়া সংসদে
একে একে ১৪৬ জন সাংসদকে লোকসভা ও রাজ্যসভা থেকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। প্রশ্ন তোলায় এবং ন্যায্য দাবি জানানোয় বিরোধী সাংসদদের গায়ে ‘অসংসদীয় আচরণের’ তকমা সেঁটে উলটে শীতকালীন অধিবেশনের শেষ লগ্নে সাফাই অভিযানে মত্ত হয়ে পড়ে সরকারপক্ষ। একগুচ্ছ বিতর্কিত বিল পাশের লক্ষ্যে বিরুদ্ধ স্বর রুখে দিতেই এমন কৌশল নিয়েছে শাসকগোষ্ঠী বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। বিরোধীদের যৌথ মঞ্চ ইন্ডিয়া প্রতিবাদে সরব হয়েছে, সারা দেশে তারা প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছে। তবে নিজেদের সাংসদ সাসপেন্ড হলেও প্রতিবাদ কর্মসূচিতে নামেনি তৃণমূল। 
১১) আক্রমণ সংসদেও 
ভারতের সংসদে ভয়াল সন্ত্রাসবাদী হামলার ২২ বছর পূর্তির দিনেই লোকসভার দর্শক গ্যালারি থেকে আচমকা সাংসদদের বসার জায়গায় ঝাঁপিয়ে পড়েন দুই যুবক। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ক্যান থেকে হলুদ রঙের গ্যাস ছুঁড়তে শুরু করে তারা। প্রাণভয়ে ছোটাছুটি শুরু করে দেন সাংসদ এবং কর্মীরা। তবে দুই যুবককেই পাকড়াও করে ফেলা হয়। জানা গিয়েছে, সাগর শর্মা এবং মনোরঞ্জন নামে এই দুই হামলাকারী বিজেপি সাংসদ প্রতাপ সিমহার ‘পাশ’ নিয়ে লোকসভার দর্শকাসনে এসেছিলেন। এই ঘটনা নতুন সংসদ ভবনে নিরাপত্তার গাফিলতিকে স্পষ্ট করে দিয়েছে। 
১২) গাজায় হামলা ইজরায়েলের
৭ অক্টোবর ইজরায়েলে হামাস হানার পর থেকে একটানা গাজায় হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইজরায়েল। গাজাকে অবরুদ্ধ করে রেখে দিনের একটানা বোমা বর্ষণে নিরীহ প্যালেস্তিনীয় মানুষদের মৃত্যু ঘটে চলেছে। মৃত্যু ঘটেছে বহু শিশুর। হাসপাতালেও বোমা বর্ষণ করেছে ইজরায়েল। বিশ্ব জনমতকে উপেক্ষা করে আমেরিকা ও ব্রিটেনের মদতে মানবতার নিধন ঘটিয়ে চলেছে। ভারত সরকার তাদের বরাবরের বিদেশনীতি উপেক্ষা করে ইজরায়েলের পাশে দাঁড়ানোয় ভারতেও বিক্ষোভ দেখা দিয়েছে। কলকাতা সহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্যালেস্তাইনের মুক্তিকামী মানুষের প্রতি সংহতি প্রদর্শন করা হয়েছে, গাজায় হামলা বন্ধের দাবি জানানো হয়েছে।
 

Comments :0

Login to leave a comment