Abhishek Banarjee

‘রক্ষাকবচ’ নিয়ে ইডি’র জেরায় গিয়ে শেষে আস্ফালন অভিষেকের

রাজ্য

আদালতে ইডি’র রক্ষাকবচের মৌখিক প্রতিশ্রুতি সঙ্গে নিয়েই নিয়োগ দুর্নীতি কাণ্ডে জেরায় বুধবার হাজিরা দেন মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো সাংসদ অভিষেক ব্যানার্জি।
প্রায় নয় ঘণ্টার বেশি ‘নিশ্চিন্ত’ জেরা শেষে বাইরে বেরিয়ে বললেন, ‘‘এর আগে সিবিআই জেরার শেষে বলেছিলাম নির্যাস শূন্য, এবার বলছি নির্যাস শূন্য নয়, মাইনাস!’’ সিজিও কমপ্লেক্সের গেটের সামনে পুলিশি নিরাপত্তায় হাতে মাইক নিয়ে পৌনে এক ঘণ্টা ধরে সাংবাদিক বৈঠকও সারলেন অভিষেক ব্যানার্জি। আগে থেকেই ‘গ্রেপ্তার করা হবে না’ প্রতিশ্রুতি পাওয়ার পরে দুপুর বারোটা থেকে জেরার পরে রাত নটা নাগাদ অভিষেক ব্যানার্জি সাংবাদিকদের সামনে বললেন, ‘‘আমার কিছু লুকানোর নেই, ধামাচাপা দেওয়ার নেই। আমার উত্তর সব রেডি আছে। আমাকে যা যা প্রশ্ন করেছে, যতটুকু আমার বলার কথা, ততটুকু আমি উত্তর দিয়েছি।’’
শুধু তাই নয় ইডি-কে চ্যালেঞ্জ করে তাঁর দাবি, ‘‘আজকে জেরায় যে বয়ান আমি দিয়েছি, তা পারলে ইডি আগামীকাল আদালতে জমা দিক বিচারপতির কাছে।’’ 
যোগ্যদের বঞ্চিত করে চাকরি বিক্রির নিয়োগ কেলেঙ্কারিতে ম্যারাথন জেরার মুখে পড়ে অভিষেক ব্যানার্জি নিয়োগ দুর্নীতিকাণ্ডে ধৃত পার্থ চ্যাটার্জির প্রসঙ্গও টেনে এনে বললেন, ‘‘১৪ মাস উনি জেলে আছেন, তাতে কী সুরাহা হলো!’’
সল্টলেকের এই সিজিও কমপ্লেক্সে এই ইডি’ দপ্তরেই গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা জেরার মুখে পড়তে হয়েছিল অভিষেক ব্যানার্জিকে। তবে নিয়োগ দুর্নীতি নয়, কয়লা পাচারের তদন্তে সেদিন সিজিও কমপ্লেক্সে জেরার মুখে পড়তে হয়েছিল তাঁকে। এরপর গত মে মাসেও সিবিআই দপ্তরে প্রায় নয় ঘণ্টার জেরার মুখে পড়েন অভিষেক ব্যানার্জি। তবে তাঁর বিরুদ্ধে কোনও কড়া পদক্ষেপ নেওয়া হবে না, বিচারপতির তীর্থঙ্কর ঘোষের এজলাসে ইডি’র মৌখিক রক্ষাকবচের প্রতিশ্রুতি নিয়েই এসেছিলেন তৃণমূল সাংসদ। 
এদিনই ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চের সমন্বয় কমিটির বৈঠকে তাঁর হাজিরা দেওয়ার কথা ছিল। ইডি’ সেইদিনই তাঁকে তলব করেছে এই অভিযোগ তুলে রবিবার রাতেই অভিষেক ব্যানার্জির নিজের এক্স হ্যান্ডেলে লিখেছিলেন, ‘‘১৩ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে ‘ইন্ডিয়া’ কো-অর্ডিনেশন কমিটির প্রথম বৈঠক। আমি ওই কমিটির একজন সদস্য। অথচ এখনই আমাকে ইডি’র তরফে ওই দিনই হাজিরা দেওয়ার জন্য নোটিস পাঠানো হলো।’’ এদিনও জেরা শেষে বারে বারে ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চের প্রসঙ্গ টেনে আনেন তিনি। ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চের সমন্বয় কমিটিতে যে ১৪টি দলের সদস্য রয়েছেন তাঁদের মধ্যে একমাত্র তৃণমূল কংগ্রেস এবং তাঁকেই ‘নিশানা’ করা হচ্ছে বলেও দাবি করেন তিনি।
এর আগে গত ১৩ জুন শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে ইডি’র তলব এড়িয়েছেন অভিষেক ব্যানার্জি। ‘বাঘের বাচ্চার মতো সামনে থেকে মাথা উঁচু করে লড়াই করব’, ‘যতবার ডাকবে ততবার আসব’ বলার পরেও দুর্নীতিকাণ্ডে তদন্তকারী সংস্থার জেরা এড়িয়েছেন। সুপ্রিম কোর্ট থেকে হাইকোর্ট, লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে মামলা করছেন জেরা এড়াতে, রক্ষাকবচ কিনতে। ৮জুন কয়লা পাচারকাণ্ডে তাঁর স্ত্রী রুজিরা নারুলা ব্যানার্জিকে জেরার পরে অভিষেক ব্যানার্জিকে নিয়োগ দুর্নীতিতে তলবের পরেই তৃণমূলের এই দ্বিতীয় ক্ষমতাশালী নেতা সাংবাদিকদের সামনে বলেন, ‘‘আমি কি কেন্দ্রীয় এজেন্সির চাকরবাকর নাকি, যে ডাকলেই হাজিরা দিতে হবে।’’ 
এর আগে গত ২০ মে নিয়োগ দুর্নীতি কাণ্ডের তদন্তেই সাড়ে নয় ঘণ্টা সিবিআই দপ্তরে জেরার মুখে পড়তে হয়েছিল অভিষেক ব্যানার্জি। জেরার পরে বাইরে বেরিয়ে এসে বলেছিলেন, ‘তদন্তকারী সংস্থার সময় নষ্ট, আমারও সময় নষ্ট।’ এদিন এক ধাপ এগিয়ে বললেন, ‘জেরার নির্যাস মাইনাস টু!’ 
গত মে’ মাসে যখন অভিষেক ব্যানার্জি সিবিআই জেরার মুখে পড়েন সেই সময় তাঁরই ঘনিষ্ঠ সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র ওরফে ‘কালীঘাটে কাকু’ গ্রেপ্তার হয়নি। তাঁর জেরার দশদিনের মাথায় গ্রেপ্তার হন ‘কালীঘাটের কাকু’। এরপরেই নিয়োগ দুর্নীতিতে আরও সামনে আসতে শুরু করে অভিষেক ব্যানার্জির প্রসঙ্গ। 
ইতিমধ্যে নিয়োগ দুর্নীতি কাণ্ডের চার্জশিটেও এসেছে অভিষেক ব্যানার্জির প্রসঙ্গ! গত ২৮ জুলাই নিয়োগ কাণ্ডেই ধৃত অভিষেক ব্যানার্জির ঘনিষ্ঠ সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র ওরফে ‘কালীঘাটের কাকু’র বিরুদ্ধে এই চার্জশিট দায়ের করা হয়। এই অতিরিক্ত চার্জশিটেই রয়েছে ভাইপো সাংসদ অভিষেক ব্যানার্জির প্রসঙ্গ। চার্জশিটের ৭৫ নম্বর পাতায় রয়েছে অভিষেক ব্যানার্জির নাম। চার্জশিটে ইডি জানায় সুজয় ভদ্র ‘সেই সময় অভিষেক ব্যানার্জির আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি দেখভাল করতেন। সেই সময় অভিষেক ব্যানার্জি যুব তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন। সুজয় ভদ্র তৎকালীন প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি মানিক ভট্টাচার্যের অফিসেও নিয়মিত যাতায়াত করতেন। মূলত, অভিষেক ব্যানার্জির হয়ে বার্তা মানিক ভট্টাচার্যের কাছে পৌঁছে দিতেই তিনি যেতেন’। ইডি’র চার্জশিটে শুধু কালীঘাটের কাকুর সঙ্গে অভিষেক ব্যানার্জির সম্পর্ক নয়, প্রাথমিকে নিয়োগ দুর্নীতির ক্ষেত্রে মানিক ভট্টাচার্যের সঙ্গে অভিষেক ব্যানার্জির সম্পর্কের কথাও সামনে আনা হয়। ২০১৪’র টেটে ওই ৩২৫ জনকে পাশ করিয়ে দেওয়ার জন্য ওই চাকরিপ্রার্থীদের নথি সুজয় ভদ্র মানিক ভট্টাচার্যের কাছে দিয়েছিলেন। আর ঠিক সেখানেই ইডি’র দাবি, সুজয় ভদ্র মানিক ভট্টাচার্যের অফিসে যেতেন অভিষেক ব্যানার্জির বার্তা পৌঁছে দিতে। কালীঘাটের কাকু সেই ৩২৫ জনের তালিকাই মানিক ভট্টাচার্যের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন অভিষেক ব্যানার্জির ‘বার্তাবাহক’ হয়ে!
কালীঘাটের কাকুর বিরুদ্ধে ইডি’ যে চার্জশিট জমা দেয় আদালতে তাতে সামনে চলে আসে অভিষেকের পারিবারিক সংস্থা ‘লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস’র প্রসঙ্গও! ভুয়ো সংস্থার মাধ্যমে নিয়োগ দুর্নীতির টাকা ঘুরপথে টাকা ঢুকেছে অভিষেক ব্যানার্জির এই পারিবারিক সংস্থায়, যেখানে এখনও তাঁর বাবা-মা’ই ডিরেক্টর! ঘুরপথে অভিষেক ঘনিষ্ঠ কালীঘাটের কাকুর সংস্থা এসডি কনসালটেন্সির মাধ্যমেই চাকরি বেচার টাকা ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২১’র জানুয়ারি পর্যন্ত তিন দফায় মোট ৯৫ লক্ষ টাকা ঢুকেছিল লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসে। যদিও নিয়ে কোনও মন্তব্য সাংবাদিক বৈঠকে মেলেনি। 
লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসে তল্লাশির ঘটনায় ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী একাধিকবার লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসে তল্লাশিকে তাঁর ‘বাড়িতে তল্লাশি’, ‘পরিবারের ওপর অত্যাচার’ বলে দাবি করেছেন। খোদ অভিষেক ব্যানার্জি দলীয় সভা থেকে লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস’র অফিসকে তাঁর নিজের অফিস বলেও দাবি করেছেন।
গত ২৯ আগস্ট নিয়োগ দুর্নীতির এই মামলায় কলকাতা হাইকোর্টে বিচারপতি অমৃতা সিনহা ওই লিপস অ্যান্ড বাউন্ডসে ইডি’র তল্লাশির পরিপ্রেক্ষিতেই প্রশ্ন তুলেছেন, কেন ওই সংস্থার আরেক কর্ণধারকে গ্রেপ্তার করা হলে অভিষেক ব্যানার্জিকে সমন পাঠানো হবে না, কেন তাঁকে তলব করা হচ্ছে না আর? আর তাতেই তড়িঘড়ি রক্ষাকবচের প্রতিশ্রুতি নিয়েই জেরায় যান ভাইপো সাংসদ।
ইডি’ও এত বড় দুর্নীতির তদন্তে গ্রেপ্তার করা হবে না জানিয়েই ‘ম্যারাথন’ জেরায় আয়োজন করল।

Comments :0

Login to leave a comment