Ayan Sil

রাজ্যের এক প্রভাবশালীকে ২৬ কোটি দিতে হয়েছিল

রাজ্য

রাজ্যের এক প্রভাবশালীর কাছে দফায় দফায় ২৬ কোটি টাকা নগদে পাঠিয়েছিলেন নিয়োগ কাণ্ডে ধৃত অয়ন শীল। চাঞ্চল্যকর এমন তথ্য শনিবার আদালতে জানালেন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি’র আইনজীবী।
ইডি’র দাবি, হেপাজতে থাকাকালীন অয়ন শীলের জেরায় উঠে এসেছে একের পর এক বিস্ফোরক সব তথ্য। নিয়োগ দুর্নীতির শিকড় কতদূর পর্যন্ত তা জানলে শিউরে উঠতে হবে। এদিন আদালতে ইডি’র তরফে জানানো হয়, জেরাতেই অয়ন শীল স্বীকার করেছেন যে এজেন্টের মাধ্যমে এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাকে নগদ ২৬ কোটি টাকা পাঠিয়েছিলেন তিনি। শুধু পৌরসভায় নিয়োগ দুর্নীতি থেকে অয়ন শীল ৩৪ কোটি টাকা তুলেছিলেন। এছাড়া এসএসসি নিয়োগ দুর্নীতিতে ৪৫ কোটি টাকা তুলেছিলেন। এর মধ্য থেকেই কোটি টাকা কেবলমাত্র একজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে দিতে হয়েছিল!
তাহলে কে সেই রাজ্যের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব যাঁকে এই ধৃত প্রোমোটার শিক্ষক নিয়োগ ও পৌরসভা দুর্নীতি থেকে তোলা ২৬ কোটি টাকা নগদ দিতে হয়েছে? সরকারি চাকরি বিক্রির এই অপারেশন নির্বিঘ্নে এবং মসৃণভাবে করতেই দিতে হয়েছিল ওই প্রভাবশালী নেতাকে টাকার ভাগ দিতে হয়েছিল বলে ধারণা।
ওই প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার নাম তদন্তকারী সংস্থার আইনজীবী এদিন প্রকাশ্য শুনানিতে জানাতে চাননি। ইডি’র আইনজীবী বিচারককে বলেন, ওই প্রভাবশালীর নাম এখানে জানাচ্ছি না, কেস ডায়েরিতে লেখা আছে।
লাগাতার ৩৭ ঘণ্টা জেরার পরে গত ২০ মার্চ অভিষেক ব্যানার্জির ঘনিষ্ঠ ধৃত শান্তনু ব্যানার্জির পরিচিত চুঁচুড়ার বাসিন্দা প্রোমোটার অয়ন শীলকে গ্রেপ্তার করে ইডি। তাঁর সল্টলেকের বাড়ি, অফিস থেকে যা নথি উদ্ধার হয়েছে তাতেই চক্ষু চড়কগাছ ইডি’র তদন্তকারী আধিকারিকদের। যে পরিমাণ নথি এই তৃণমূল ঘনিষ্ঠ প্রোমোটারের কাছ থেকে মিলেছে তা রীতিমত ট্রলিতে চাপিয়ে নগর দায়রা আদালতে নিয়ে যেতে হয়েছিল তদন্তকারী আধিকারিকদের। এসএসসি’র পাশাপাশি রাজ্যজুড়ে একাধিক পৌরসভায় নিয়োগ দুর্নীতির সঙ্গেও যুক্ত ধৃত প্রোমোটার অয়ন শীল। এই প্রোমোটারের বাড়ি থেকে শুধু ২০১২’র টেটের নথি, অ্যাডমিট কার্ডই নয়, মিলেছে রাজ্যের প্রায় ৬০টি পৌরসভায় বেআইনিভাবে টাকার বিনিময়ে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার তালিকা, ওএমআর শিট, চাকরি বিক্রি রেটের তালিকাও।
এর আগে অভিষেক ব্যানার্জির ঘনিষ্ঠ, নিয়োগ ধৃত তৃণমূলের হুগলী জেলা পরিষদ সদস্য শান্তনু ব্যানার্জিকে জেরা করে দুটি অ্যাপেল ফোন উদ্ধার করে। তারপরেই আদালতে ইডি’র আইনজীবী ফিরোজ এডুলজি বলেছিলেন, ‘ওই দুটি মোবাইল হলো সোনার খনি। যা তথ্য আছে তা জানলে চমকে উঠবেন। যার নাম রয়েছে, মোবাইলে যে সব চ্যাট রয়েছে তা এরকম প্রকাশ্য এজলাসে আমরা জানাতে পারবো না। কেস ডায়েরিতে উল্লেখ করা আছে। কেস ডায়েরিতে এমন এমন নাম রয়েছে, যা জানলে আপনি চমকে উঠবেন’। 
শান্তনু ব্যানার্জির মোবাইল থেকেও মিলেছিল প্রভাবশালীর সঙ্গে চ্যাট।
এদিন ধৃত অয়ন শীলের ক্ষেত্রেও ইডি’র দাবি, জানা গিয়েছে এক প্রভাবশালীকে ২৬ কোটি টাকা পাঠানো হয়েছিল।
এদিন নগদ দায়রা আদালতে ইডি জানায়, অয়ন শীলের ৪০টি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের হদিশ পাওয়া গিয়েছে আপাতত। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টগুলিতে এখনও পর্যন্ত ৮ কোটি টাকা পাওয়া পাওয়া গিয়েছে। এছাড়াও  নামে, বেনামে  ৮টি ফ্ল্যাট, ৫টি গাড়ি, পেট্রোল পাম্প, হোটেল— বিপুল সম্পত্তির মালিক এই অয়ন শীল। ১০০ কোটি টাকার বেশি তুলেছিলেন অয়ন শীল। পৌরসভার নিয়োগ দুর্নীতি থেকে তুলেছিলেন ৩৪ কোটি টাকার মতো। এসএসসি দুর্নীতিতে তুলেছিলেন ৪৫ কোটির বেশি!
আর দুর্নীতির এই ভয়াবহ চেহারা উল্লেখ করেই আদালতে ইডি’র আইনজীবী বলেছেন, ‘পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষাক্ষেত্রের এই দুর্নীতির চেহারা দেখে কবিগুরুও কাঁদছেন, তাঁর হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে!’ তদন্তকারী সংস্থার আইনজীবী রবীন্দ্রনাথ, বিশ্বভারতী, পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাক্ষেত্রের দুর্নীতির প্রসঙ্গ টেনে এনেই এরপরে বিচারকের উদ্দেশ্যে বলতে থাকেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বভারতী গড়ে তুলেছিলেন। বোলপুর এখন বিশ্বভারতীর থেকেও দুটো ‘সি’র জন্য বিখ্যাত। একটি ‘সি’ হলো, কোরাপশন, আরেকটি ‘সি’ হলো, ক্যাটেলস স্মাগলিং। দুর্নীতি যে উচ্চতায় পৌঁছেছে তা দেখে কবিগুরু কাঁদছেন। কবিগুরু কি এই পরিস্থিতি দেখে সুখী হতেন? না, নিশ্চিতভাবে নয়। তাঁর হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে।’
তদন্তে স্পষ্ট এসএসসি দুর্নীতি ও পৌরসভার দুর্নীতি, সমানতালে চলেছে। অয়ন শীলের সংস্থার মাধ্যমে ৬০টির বেশি পৌরসভায় অবৈধ নিয়োগ হয়েছে স্রেফ টাকার বিনিময়ে নেতাদের সুপারিশে। কোটি কোটি নগদ টাকার বিনিময়ে এই প্রক্রিয়ায় এখনও পর্যন্ত ৫ হাজারের বেশি ব্যক্তিকে পৌরসভার বিভিন্ন পোস্টে নিয়োগ করা হয়ছে। ধৃত অয়ন শীলের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া ডিজিটাল নথি বলছে এই নিয়োগের জন্য আলাদা করে রেট চার্টও করা হয়েছিল। পার্থ-মানিক-শান্তনু-কুন্তল বাহিনী টাকার বিনিময়ে সরকারি স্কুলে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর চাকরি বিক্রির অভিযান যখন চালাচ্ছে ঠিক একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তখন চলছে রাজ্যের একের পর এক পৌরসভায় টাকার বিনিময়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া!
তৃণমূল সরকারে আসার পরে অভিষেক ব্যানার্জির ঘনিষ্ঠ শান্তনু ব্যানার্জির ‘বন্ধু’ অয়ন শীলের সংস্থাকেই পৌরসভার নিয়োগের ক্ষেত্রে থার্ড পার্টি এজেন্সি হিসাবে চিহ্নিত করেছিল সরকার। রাজ্যের অধিকাংশ পৌরসভায় নিয়োগের বরাত পেয়েছিল ধৃত প্রোমোটার অয়ন শীলের সংস্থা এবিএস ইনফোজোন প্রাইভেট লিমিটেড। এই সংস্থার মাধ্যমেই পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতো। অয়ন শীলের নামে আরেকটি সংস্থা রয়েছে, এবিএস ইনফ্রাজোন প্রাইভেট লিমিটেড। এই সংস্থা আবার ওইসব পৌরসভাতেই নানান ঠিকাদারি কাজের বরাত পেত!
এদিন আদালতে বিচারক অয়ন শীলের কাছে তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা জানতে চান। অয়ন শীল জানান, তিনি বিকম স্নাতক। এরপরে বিচারক প্রশ্ন করেন, আপনার পেশা কী? অয়ন জানান ব্যবসা। বিচারক জানতে চান অয়নের সংস্থার কাজ কী ছিল? অয়নের আইনজীবী জানান নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল টেন্ডারে। বিচারকের প্রশ্ন, যদি এটা শুধু পরীক্ষা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার হয়ে থাকে তাহলে তো ওএমআর মূল্যায়নের দায়িত্ব থাকে না। ওএমআর শিট মূল্যায়নের দায়িত্ব ছিল ওই সংস্থার? আইনজীবীর বক্তব্য, হ্যাঁ ছিল!
শেষমেশ অয়ন শীলের জামিনের আবেদন খারিজ করে বিচারক আগামী ১১ তারিখ পর্যন্ত জেল হেপাজতের নির্দেশ দেন।

 

Comments :0

Login to leave a comment