ছিল বাবরি মসজিদের নাম। এখন নেই। বদলে লেখা হয়েছে ‘তিন গম্বুজের কাঠামো’। ছিল রাম জন্মভূমি আন্দোলনে জনসমর্থন সংগঠিত করতে এল কে আদবানির নেতৃত্বাধীন বিজেপি’র রথযাত্রা, বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলায় করসেবকদের প্রধান ভূমিকা, ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, সেই পর্বে বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি এবং অযোধ্যার ঘটনা নিয়ে বিজেপি’র দুঃখ প্রকাশের কথাও। এখন সেই সব কিছুই নেই, সবই বাদ দেওয়া হয়েছে এনসিইঅআরটি’র দ্বাদশ শ্রেণির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তকের সংশোধিত সংস্করণে। গত সপ্তাহেই এই সংশোধিত সংস্করণটি প্রকাশ করা হয়েছে।
১৯৮৬ সালের পরবর্তী সময়ের অযোধ্যা-কেন্দ্রিক রাজনৈতিক ইতিহাসের ভাষ্যকে তাৎপর্যপূর্ণভাবে বদলে ফেলা হয়েছে আগের সংস্করণ থেকে এই নতুন সংস্করণে। ফলাও করে লেখা হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের ৫ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চের সেই রায়ের কথা, যে রায়ে রাম মন্দির নির্মাণের দরজা খুলে দেওয়া হয়েছিল মূলত হিন্দুদের বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে। স্পষ্টতই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংশোধিত সংস্করণের ভাষ্যের অভিমুখ ঠিক করা হয়েছে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে গৌরবান্বিত করার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই। এনসিইআরটি’র ডিরেক্টর দীনেশ প্রসাদ সাকলানি অবশ্য বিদ্যালয় স্তরের পাঠ্যসূচিকে হিন্দুত্ববাদী অভিমুখ দেওয়ার বা তাকে গৈরিক বসন পরানোর কথা মানতে চাননি। তাঁর বক্তব্য, এই পরিবর্তন নিয়ে হইচই করা অপ্রাসঙ্গিক। ইতিবাচক মনোভাবের নাগরিক তৈরি করার লক্ষ্যেই এই পরিবর্তন আনা হয়েছে। সাম্প্রদায়িক হিংসার কথা জেনে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বড় হওয়ার দরকার নেই। উল্লেখ্য, এনসিইআরটি বা ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং হলো কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষা মন্ত্রক পরিচালিত একটি স্বশাসিত সংস্থা, যেটি দেশের বিদ্যালয় স্তরের বিষয়ভিত্তিক পাঠ্যসূচি বা সিলেবাস ঠিক করে বিভিন্ন শ্রেণির জন্য। সিবিএসই এই পাঠ্যসূচিই অনুসরণ করে, কোনও কোনও বিষয়ে তা অনুসরণ করে সিআইএসসিই-ও।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকের এই সংশোধিত সংস্করণে অযোধ্যার ঘটনাবলির অংশটিকে আগের সংস্করণের চার পৃষ্ঠা থেকে কমিয়ে আনা হয়েছে দুই পৃষ্ঠায়। এই বইয়ে অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রসঙ্গটিকে পুরোপুরি মুছেই ফেলা হয়েছে। তার জায়গায় নিয়ে আসা হয়েছে অযোধ্যার নবনির্মিত রাম মন্দিরের কথাকে। ১৯৮৬ সালে বাবরি মসজিদের তালা খুলে তার একটি অংশে হিন্দুদের ‘রামলালা’র পুজো করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। সংশোধিত সংস্করণে তা উল্লেখ করে বাবরি মসজিদ ধ্বংস ও তার পরবর্তী সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনাবলিকে বাতিলের তালিকায় ফেলে দিয়ে অযোধ্যার রাজনৈতিক ইতিহাসের ভাষ্যকে সোজা নিয়ে যাওয়া হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর্বে এবং এই গোটা ভাষ্যে ‘বাবরি মসজিদ’ নামটাই আর নেই। তার বদলে লেখা হয়েছে, ‘শ্রী রামের জন্মভূমি’র জায়গায় ১৫২৮ সালে নির্মাণ করা হয়েছিল ‘তিন গম্বুজের কাঠামো’। সেই কাঠামোর ভিতরের ও বাইরের অংশ জুড়ে ছিল হিন্দু ধর্ম ও হিন্দু পুরানের চোখে পড়ার মতো নিদর্শন। তারপরেই রাম জন্মভূমি নিয়ে হিন্দুদের আবেগের কথা লিখে সেই সংক্রান্ত বিতর্কের নিষ্পত্তিতে সুপ্রিম কোর্টের রায়কে বিশদে তুলে ধরা হয়েছে। এই সংস্করণের বই পড়ে জানাই যাবে না যে, ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর লালকৃষ্ণ আদবানি, মুরলি মনোহর যোশী, উমা ভারতী, অশোক সিঙ্ঘল, বিনয় কাটিয়ারের মতো উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের নেতৃত্বে করসেবকরা উত্তর প্রদেশের অযোধ্যায় ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছিল ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মিত একটি মসজিদকে। বর্তমান প্রজন্ম জানতেই পারবে না যে, সেই সময়ে উত্তর প্রদেশে ক্ষমতায় ছিল কল্যাণ সিংয়ের নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার এবং সেই সরকারের পুলিশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছিল এই ধ্বংসকাণ্ড। জানাই যাবে না যে, ওই ঘটনার পরে কেন্দ্রীয় সরকার উত্তর প্রদেশ সহ অন্যান্য রাজ্যের বিজেপি সরকারগুলিকে বরখাস্ত করে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করেছিল এবং বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরিণতিতে দেশের নানা অংশে ছড়িয়ে পড়েছিল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা।
আরও আছে। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের জন্য সুপ্রিম কোর্ট উত্তর প্রদেশের তৎকালীন বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিংয়ের সরকারকে ভর্ৎসনা করেছিল এবং আদালতের নির্দেশ অনুসারে বাবরি মসজিদের কাঠামো রক্ষায় ব্যর্থতার জন্য কল্যাণ সিংকে আদালত অবমাননার দায়ে এক দিন কারাবাসের সাজা দিয়েছিল। তা লেখা ছিল আগের সংস্করণে, যা উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সংশোধিত সংস্করণে। বাদ দেওয়া হয়েছে দু’টি সংবাদপত্রে সেই সময়ে প্রকাশিত দু’টি সংবাদ প্রতিবেদনের ছবিও। তার একটির শিরোনামে লেখা ছিল ‘ধ্বংস করা হলো বাবরি মসজিদ, কেন্দ্র বরখাস্ত করল কল্যাণ সরকারকে’। অন্যটির শিরোনামে ছিল বাজপেয়ীর মন্তব্যের উদ্ধৃতি, যেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘অযোধ্যা বিজেপির সবচেয়ে বড় ভুল’। বাবরি মসজিদ নিয়ে বিজেপি সহ সঙ্ঘ পরিবারের বিভিন্ন সংগঠনের উগ্র হিন্দুত্ববাদী কার্যকলাপের সমস্ত তথ্যকে এভাবে মুছে দিয়ে এনসিইআরটি তাদের দ্বাদশ শ্রেণির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বইয়ের নতুন সংস্করণে লিখেছে, ‘‘১৯৮৬ সালে তিন গম্বুজের কাঠামো নিয়ে পরিস্থিতি এক তাৎপর্যপূর্ণ মোড় নেয়, যখন ফৈজাবাদ (বর্তমানে অযোধ্যা) জেলা আদালত ওই কাঠামোর তালা খোলার নির্দেশ দিয়েছিল এবং জনগণকে সেখানে পুজো করার অনুমতি দিয়েছিল। বিতর্ক অনেক দশক ধরে চলছিল। কারণ, বিশ্বাস করা হতো যে, একটি মন্দির ভেঙে শ্রী রামের জন্মভূমির জায়গায় তিন গম্বুজের কাঠামোটি নির্মাণ করা হয়েছিল। মন্দিরের শিলান্যাস করা হলেও বাকি নির্মাণকাজ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। হিন্দু সম্প্রদায়ের মনে হয়েছিল, শ্রী রামের জন্মভূমি নিয়ে তাদের উদ্বেগকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। অন্যদিকে, মুসলিম সম্প্রদায় ওই কাঠামোর উপরে তাদের অধিকারের বিষয়ে আশ্বাস চাইছিল। তার পরিণতিতে মালিকানার অধিকার নিয়ে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে গিয়েছিল, বেশ কিছু বিতর্ক ও আইনি সংঘাত তৈরি হয়েছিল। উভয় সম্প্রদায় এই দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান চেয়েছিল। ১৯৯২ সালে কাঠামোটি ভেঙে ফেলার পরে কিছু সমালোচক বলেছিলেন, এই ঘটনা ভারতীয় গণতন্ত্রের নীতিগুলির সামনে এক বড় চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে।’’ তারপরেই নতুন সংস্করণে ফলাও করে ছাপানো হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বরের রায়কে। এক কথায়, এই নতুন সংস্করণে বাবরি মসজিদ নিয়ে হিন্দুত্ববাদীদের তৈরি করা বিরোধ-বিতর্ককে মুছে দিয়ে তুলে ধরা হয়েছে ভেঙে ফেলা ‘তিন গম্বুজের কাঠামো’র জায়গায় রাম মন্দিরের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের রায়কে।
Comments :0