ফোর্তালেজার এস্তাদিও কাস্তালাওয়ের মাটিতে পড়ে রয়েছেন নেইমার, যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। কলম্বিয়ার জুনিগার হাঁটু তীব্র হিংস্রতায় তাঁর পিঠে লেগেছে। মার্সেলো চিৎকার করছেন ডাক্তারের জন্য। স্টেডিয়াম কাঁপছে ভয়ে। স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়া হলো নেইমারকে। তার পরের শ্রুতি এইরকম: কিছু পরীক্ষার পরে চিকিৎসকরা নেইমারকে বললেন, খারাপ খবর আছে, ভালো খবরও আছে। খারাপ খবর হলো এই বিশ্বকাপ আপনার জন্য শেষ। ভালো খবর, আপনি আবার হাঁটাচলা করতে পারবেন। সেই ‘ভালো’ খবরে বাঁধ মানেনি চোখের জল। দেশের মাটিতে বিশ্বকাপ জয়ের যে স্বপ্ন আশৈশব দেখে এসেছেন, তার এ কি অবসান!
২০১৪, জুলাই ৪।
স্বভূমিতে না হলেও সেই একই স্বপ্ন নিয়ে রাশিয়ায় গিয়েছিলেন। এই স্বপ্ন ব্রাজিলের সব শিশুরাই দেখে। এই স্বপ্নের শুরু হয় ফাভেলায়, যেখানে ঘুপচি প্রায়ান্ধকার ঘরে অগুন্তি মাথা, খাবারের সন্ধানে বেরোতে হয় স্কুল ছেড়ে, জীবনের কোনও রোশনাই যেখানে পৌঁছয় না। শুধু কাঠকয়লায় আঁকা থাকে ফুটবলারদের ছবি।
রাশিয়ায় কোয়ার্টার ফাইনালে বেলজিয়ামের কাছে হার এখনও মেনে নিতে পারেননি নেইমার। ‘জীবনের সবচেয়ে দুঃখের দিন’, বারংবার বলেছেন তিনি। সঙ্গে শুনতে হয়েছে অবিশ্রান্ত সমালোচনা: তিনি মাঠে নাটক করেন, ফুটবল ছেড়ে অভিনয় করলেই ভালো হতো।
তারপরেও কেটেছে চার বছর। মেসির ৩৫, রোনাল্ডোর আরও বেশি। নেইমার তিরিশ পেরিয়েছেন সবে। কিন্তু কাতারই তাঁর ‘শেষ বিশ্বকাপ’, বলে দিয়েছেন সংবাদমাধ্যমকে। হয়তো মন নেই, হয়তো মরিয়া। নেইমার যখন সান্টোসে নাম লেখালেন তখন থেকেই ‘উত্তরাধিকারের’ এক ভার তাঁর কাঁধে। এমন একজনের, যাঁকে স্পর্শ করা দুঃসাধ্য। যদিও জাতীয় দলের হয়ে পেলের সর্বোচ্চ গোল করার নজির নেইমার হয়তো ছাড়িয়ে যাবেন কাতারেই। তিন গোল দরকার।
এই গুরুভারের তুলনায় কিছু কম কঠিন নয় বিশ্বজোড়া ব্রাজিল অনুরাগীদের প্রত্যাশার চাপ। নেইমারও পালটেছেন। অনেক বদলে নিয়েছেন নিজেকে। মার সহ্য করতে পারেন, কীভাবে পার্শ্বরেখা ধরে ছুটতে ছুটতে ঢুকে পড়তে হয় ভেতরে, কীভাবে ফলস নাইন খেলতে হয়, মিডফিল্ডার-স্ট্রাইকার ভূমিকায় খেলা সাজাতে হয়, এই সব এখন তাঁর স্মিত হাসির সঙ্গে মিশে গেছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, নেইমার কাতারে এসেছেন জীবনের সবচেয়ে ভালো ফর্মে। সবচেয়ে শান্তিতে থাকার সময়ে। ফিসফিস করে একথাও বলছেন তাঁর কাছের ফুটবলাররা, নেইমার বিশ্বকাপের সবচেয়ে কাছাকাছি।
ব্রাজিল কোচ তিতের বিন্যাস অবশ্য নেইমার-নির্ভর নয়। অন্তত তেমনই ধারণা সামনে আনেন তিনি। ৯ জন আক্রমণভাগের প্লেয়ার রেখেছেন স্কোয়াডে। নেইমার ছাড়াও ভিনিসিয়াস, রডরিগো, রিচার্লিসন, রাফিনহা, অ্যান্টনি, জেসুস, মার্তিনেল্লি, পেদ্রো। নেইমার নাকি তিতেকে হাসতে হাসতে বলেছেন, ‘ভালো মাথাব্যথা হয়েছে কোচ, কাকে ছেড়ে কাকে খেলাবেন?’ তিতে ব্রাজিলের সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ন’জনের জন্যই পরিকল্পনা তৈরি। জিকো বলেছেন, নেইমার-সর্বস্ব ব্রাজিল ছিল সহজ, কী করবে আগে থেকেই বোঝা যেত। এখন ও অসাধারণ কিছু করার জন্য আছে, একগুচ্ছ প্লেয়ার রয়েছে ব্রাজিলের।
এত ধারালো আক্রমণ সম্ভার সত্ত্বেও তিতে যে অল আউট আক্রমণেই যাবেন, মনে হয় না। বিশেষ করে সার্বিয়ার বিরুদ্ধে বৃহস্পতিবার রাতের প্রথম ম্যাচে। খাতায় কলমে দুর্বলতর দলের কাছে আর্জেন্টিনা, জার্মানির হারের পরে সাবধানী হতেই হবে তাঁকে। অধিনায়ক থিয়াগো সিলভাকে পাশে নিয়ে এদিন দোহায় সাংবাদিক সম্মেলনে তিতে বলেছেন, ‘আমাদের তিনটি মডেল আছে। বিপক্ষের চরিত্র বুঝে একেক মডেলে খেলা তৈরি হবে। প্লেয়াররা সকলেই তা জানে’।
সাবধানী মডেল যদি প্রথম ম্যাচে প্রয়োগ হয়, তাহলে বাদের তালিকায় পড়তে পারেন ভিনিসিয়াস।
এই বয়সেই ব্যালন ডি’অরের তালিকায় অষ্টমে নাম। রিয়াল মাদ্রিদে খেললেও মনে হয় মারাকানা স্টেডিয়ামে খেলছেন। প্রশ্ন এসেছিল, তিতে বলেছেন, ‘ক্লাবে সর্বোচ্চ স্তরে খেলেছে, এখন কোচ হিসাবে আমার কাজ সামগ্রিক পরিকল্পনায় ঠিক জায়গায় কাজে লাগানো’।
‘প্রত্যাশার চাপ’ নিয়ে চিন্তিত নন সেলেকাও কোচ। তিতের সোজাসাপটা উত্তর, ‘এই প্রত্যাশা স্বাভাবিক। ফুটবলের সবচেয়ে সমৃদ্ধ ইতিহাস ব্রাজিলের। এই ঐতিহ্য তো চাপ নিয়েই আসবে। এমন সব প্লেয়ার দলে রয়েছে যাদের ওপরে সারা বছর মিডিয়ার নজর থাকে। আমাদের স্বাভাবিক স্বপ্ন বিশ্বকাপ জয়।’
Comments :0