Brinda Karat

‘আমরা ওদের বিচার করবো’, সন্দেশখালি শোনালো মহিলা নেত্রীদের

জাতীয় রাজ্য

প্রবীর দাস: সন্দেশখালি
 

‘হাথরসের ছায়া সন্দেশখালিতে।’ 
তৃণমূলের পাশবিকতার বিরুদ্ধে সন্দেশখালির রুখে দাঁড়ানো মহিলাদের সঙ্গে কথা এমনই প্রতিক্রিয়া মহিলা নেত্রী বৃন্দা কারাতের।
কী শুনলেন তিনি? তাপসী সর্দার বলেছেন কারাতকে,‘ডাঙায় বাঘ, জলে কুমির আর বিষাক্ত সাপের সঙ্গে লড়াই করে এখানে বাস করছি আমরা। তৃণমূলের অনেক অত্যাচার সয়েছি। পুলিশ, আইন আদালত কী করবে আমরা জানি না। আমরা ওদের বিচার করবো।’ 
মহিলাদের এ হেন প্রতিরোধকে সেলাম জানিয়ে বৃন্দা কারাত বলেন,‘তোমরা ন্যায় পাবেই পাবে। আমরা সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি। আমরা তোমাদের পাশে আছি।’
মঙ্গলবার সন্দেশখালিতে গেছিলেন কারাত। সঙ্গে ছিলেন কনীনিকা ঘোষ সহ রাজ্যের মহিলা আন্দোলনের নেত্রীরা। তবে যাওয়া মসৃণ হয়নি। পুলিশ বাধা দিয়েছে। তাঁদের আটকে রাখতে চেয়েছে ধামাখালিতে। কিন্তু নাছোড় তাঁদের সামনে থেকে প্রায় ঘণ্টাদুয়েক পরে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছে মমতা ব্যানার্জি সরকারের পুলিশ।
সন্দেশখালির তিন-চারটি গ্রাম ঘুরে, গ্রামবাসী মহিলাদের সঙ্গে কথা বলে তৃণমূলের অত্যাচারের নানা বিবরণ পেয়েছেন মহিলা আন্দোলনের নেত্রীরা। এই প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের বৃন্দা কারাত বলেন,‘‘এখানে এসে আমার হাথরসের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। হাথরসে যোগী আদিত্যনাথের সরকার যা করেছিল, সেই একই জিনিস মমতা ব্যানার্জির সরকারকে করতে দেখছি। আসলে যোগী আদিত্যনাথের মতো মমতা ব্যানার্জিও কিছু লুকোতে চাইছেন।’’
এদিন সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির নেত্রীবৃন্দকে কাছে পেয়ে নতুনপাড়া, পাত্রপাড়া, মাইতিপাড়া, নস্করপাড়ার মহিলারা জানিয়ে দিলেন,‘‘শেখ শাহজাহানের গ্রেপ্তার এবং শেখ শাহজাহান সহ শিবপ্রসাদ হাজরা, উত্তম সর্দারের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড যতদিন না হচ্ছে, ততদিন সন্দেশখালিতে শান্তি ফিরবে না। আমাদের আন্দোলনও থামবে না।’’
অনেক অভিযোগ করেন নির্যাতিতা মহিলারা। তাঁদের সাহস এবং আন্দোলনকে কুর্নিশ জানিয়ে পাশে থাকার আশ্বাস দেন বৃন্দা কারাত রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী রেখা গোস্বামী।
এদিন বৃন্দা কারাত সহ মহিলা নেত্রীবৃন্দ যান দাড়িরজঙ্গল মৌজার ছোট কলাগাছিয়া নদীর পাড়ে নতুনপাড়ায়। আদিবাসী নিবিড় নতুন পাড়ার প্রতিটি ঘর উঠানের ক্যানভাসে আঁকা অত্যাচার, বঞ্চনা, হা হুতাশের নিদারুণ ছবি। অপর্ণা দাস জানান, তাঁর মেয়েকে কীভাবে নারী পাচার চক্রের এজেন্ট তৃণমূলকর্মী বিক্রি করে দিয়েছে, সেই কাহিনি। তিনি বলেন,‘‘৬ বছর হয়ে গেল আমার মেয়ে প্রিয়াঙ্কা দাস ঘরে ফেরেনি।’ নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরের আরবলদা গ্রামের তৃণমূল কর্মী বাপ্পা দাস অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী প্রিয়াঙ্কাকে নিয়ে চলে যায় এই শিবু- উত্তমদের সাহায্য নিয়ে। পরে খবর আসে বাপ্পা প্রিয়াঙ্কাকে বিক্রি করে দিয়েছে। মহিলা জানান,‘থানার বড়বাবুর হাতেপায়ে কত ধরেছি। থানা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। বলেছিল, উত্তম-শিবুর কাছে যাও। তা না হলে ১০, ২০হাজার খরচ করো। দেখছি বিষয়টি। সেদিন টাকা দিতে পারিনি বলে আদালতে মামলা করার পরেও মেয়েকে আজও খুঁজে পেলাম না।’ প্রিয়াঙ্কাকে তার মা অপর্ণা দাস, বাবা ঝন্টু দাসের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার সবরকমের চেষ্টার আশ্বাস দেন বৃন্দা কারাত।
ষাটোর্ধ্ব ঊর্মিলা সর্দার। এখনও মাথায় তাঁর গভীর ক্ষতের চিহ্ন। সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়নের সদস্য সংগ্রহ করেছিলেন সুভাষ সর্দার সহ অন্যান্যরা। শাহজাহান, শিবু-উত্তমের বাহিনী লাঠিসোঁটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে খেতমজুর ইউনিয়নের নেতাকর্মীদের উপর। ঊর্মিলা সর্দার তাঁদের বাঁচাতে ছূটে যান। তাঁকেও সেদিন ছাড়েনি শেখ শাহজাহানের বাহিনী। সেই কাহিনিও শুনেছেন মহিলা আন্দোলনের নেত্রীরা। 
অঝোর ধারায় কাঁদছেন কাঞ্চনা সর্দার সহ আরও কয়েকজন। তাঁরা বলেছেন,‘বামফ্রন্ট সরকারের সময় পাট্টা জমি পেয়েছিলাম। ওই শিবু-উত্তমরা জোর করে লোনাজল ঢুকিয়ে মেছোঘেরি তৈরি করেছে। নদীর পাড়ে আমাদের বাস। বাঁধ সারাইয়ে ১০০দিনের কাজ করলাম। টাকা পেলাম। সেই টাকা দিয়ে চাল কিনে আসছি। উত্তম ধরে বললো, টাকা দাও। কোন টাকা? শুধালাম। বললো, ১০০দিনের কাজের যে টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তুলেছো, সেই টাকা আমাদের। আমি বললাম, চাল কিনে ফেলেছি। ঘরে একদানাও চাল ছিল না। শুনলো না। বললো, জমি বেচে টাকা দাও। না হলে তোমার স্বামীকে তুলে নিয়ে যাবো। কোদালের বাঁট দেখিয়ে বলে। শেষে ১০টাকা সুদে টাকা ধার করে এনে দিতে হলো। পঞ্চায়েতে ছাগল, মুরগি, হাঁস, মাছের পোনা আসে। সরকার দেয়। আমরা পাই না। আমরা আদিবাসী। করম পুজো উৎসব আমরা করি। সব বন্ধ করে দিয়েছে।’ 
এদিন সকালে ধামাখালিতে পুলিশ মহিলা নেত্রীদের আটকায়। সেখানে বৃন্দা কারাত বলেন,‘‘এখানে পুলিশ তৃণমূলের জামা না পরে থাকলেও তারা আসলে তৃণমূলের হয়েই কাজ করছে। সন্দেশখালির নির্যাতিতা একটি মহিলা আমাকে ফোন করে তাঁদের কাছে যেতে বলছে। সে কী ভালো আছে? তৃণমূলের গুন্ডারা ভালো আছে, আমি জানি। কিন্তু গ্রামের মহিলারা কী ভালো আছে? যারা ভালো নেই, আমি তাদের কাছে যেতে চাই। ব্যঙ্গাত্মক সুরে পুলিশের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘‘পুলিশ দারুণ কাজ করছে। তৃণমূলের গুন্ডাদের যাতে কোনও অসুবিধা না হয়, সেটা পুলিশ ভালোভাবে দেখছে। মহিলাদের জন্য ন্যায়ের রাস্তা বন্ধ। এটা ভীষণ, ভীষণ অমানবিক। সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির পক্ষ থেকে আমরা সেখানে যেতে চাই। অত্যাচারিতদের সঙ্গে কথা বলতে চাই। পুলিশ বাধা দিচ্ছে।’’ তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘‘বাংলায় আদৌ কী গণতন্ত্র আছে? পুলিশ বলছে ১৪৪ ধারা জারির কথা। আমরা তো চারজন সেখানে যেতে চাই।’’
সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদিকা কনীনিকা ঘোষ, মহিলা নেত্রী সোমা দাশ আইপিএস অফিসার পাপিয়া সুলতানাকে হাইকোর্টের নির্দেশনামা দেখিয়ে বারবার বলতে থাকেন, আদালত আমাদের ৪-৫জনকে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে। আপনি কোন অধিকারে আমাদের যেতে দিচ্ছেন না? নিরুত্তর থাকেন পাপিয়া সুলতানা।
প্রায় দু’ঘণ্টা পরে বৃন্দা কারাত, কনীনিকা ঘোষ, রাজ্যের প্রাক্তন দুই মন্ত্রী রেখা গোস্বামী, অঞ্জু কর, আত্রেয়ী গুহ, উত্তর ২৪পরগনা জেলা পরিষদের প্রাক্তন সভাধিপতি অপর্ণা গুপ্ত, মহিলানেত্রী স্বপ্না ভট্টাচার্য, সোমা দাশ, রুনু ব্যানার্জি, যশোধরা বাগচী, পূরবী সরকার, বেলপতি মুন্ডা, সোনালি দাস, পূর্ণিমা চক্রবর্তী, পঞ্চায়েত সদস্যা শাশ্বতী ব্যানার্জি সহ অন্যান্য নেত্রীবৃন্দ যান সন্দেশখালিতে।

 

Comments :0

Login to leave a comment