বিজয় প্রসাদ
৩ অক্টোবর দিল্লি পুলিশের পাঁচশোর বেশি অফিসার ও কর্মী ভারতের পাঁচ শহরে প্রায় ১০০ সাংবাদিক ও গবেষককে নিজেদের স্পেশাল সেলে আটক করে বা বাড়িতেই আটকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। দিনভর— গড়ে প্রায় ৮ ঘণ্টা ধরে— তাঁদের আটকে রেখে জেরা করা হয় তাঁরা ২০২০-২১’র কৃষক আন্দোলন, ২০২০-র ফেব্রুয়ারিতে পূর্ব দিল্লির সংখ্যালঘু-বিরোধী দাঙ্গা, কোভিড মহামারীতে সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রতিবেদন লিখেছেন কি না। আমাদের সময়ে এই তিন ঘটনাই এত বড় মাপের যে তার প্রতিবেদন না করাই সাংবাদিক বা গবেষকের পক্ষে কর্তব্যে অবহেলা। সরকারের জালে প্রধানত এসেছেন ২০০৯ থেকে চালু হওয়া ওয়েব ভিত্তিক নিউজ সাইট ‘নিউজক্লিক’-এর সাংবাদিকরা। যে গবেষকদের জেরা করা হয়েছে তাঁরা ট্রাইকন্টিনেন্টাল রিসার্চ সার্ভিসেসের যারা ‘ট্রাইকন্টিনেন্টাল: ইন্সটিটিউট ফর সোশাল রিসার্চ’-এর জন্য উপাদান জোগান দেয়। দিনভর হেনস্তা ও হুমকির পরে দিল্লি পুলিশ নিউজক্লিকের মুখ্য সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থ এবং পোর্টালের মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান অমিত চক্রবর্তীকে গ্রেপ্তার করেছে।
প্রবীর ও অমিত বহু বছর ধরে আমার বন্ধু। প্রায় তিরিশ বছর আগে প্রবীরের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ। তখন আমি দিল্লিতে তরুণ সাংবাদিক ও গবেষক, প্রবীর দিল্লি সায়েন্স ফোরামের অন্যতম প্রধান সংগঠক। সাকেতে ডিএসএফ’র ছোট্ট ঘরে প্রয়াত ডাঃ অমিত সেনগুপ্ত, প্রবীরের সঙ্গে কথা হয়। অমিত সরকারি জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার অগ্রণী সওয়ালকারী ছিল। ইঞ্জিনিয়ার প্রবীর এমন সরকারি শক্তি ব্যবস্থার পক্ষে লড়াই করছিল যা মুনাফার বদলে মানুষকেই প্রাধান্য দেবে। আমরা ১৯৮৬সালের গ্যাট চুক্তি নিয়ে কথা বলছিলাম। ওদের বুদ্ধির দীপ্তি, মানুষের প্রতি ভালোবাসা এবং রসবোধে আমি চমৎকৃত হয়ে গিয়েছিলাম।
প্রবীর ১৯৮৮ সালে অল ইন্ডিয়া পিপলস সায়েন্স কংগ্রেস আয়োজনে ভূমিকা নিয়েছিল। সেখান থেকে সারা ভারত জনবিজ্ঞান নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে। পরে ফ্রি সফটওয়ার মুভমেন্টের অগ্রণী সংগঠক ছিল। ২০০২-এ প্রবীর ও আমি এনরন কেলেঙ্কারি নিয়ে এক বই লিখি। কয়েক বছর পরে মুম্বাই সোশাল ফোরামে হাজার হাজার মানুষের সামনে এ ধরনের কেলেঙ্কারির কথা আমরা তুলে ধরতে সক্ষম হই। পেশাদার ইঞ্জিনিয়ার প্রবীর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গণতন্ত্রীকরণের পক্ষে তীব্রভাবে সওয়াল চালিয়ে গেছে। তাঁর নতুন বই ‘নলেজ এজ কমনস: টুওয়ার্ডস ইনক্লুসিভ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’ ( লেফটওয়ার্ড, ২০২৩) বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে মুষ্টিমেয়ের দখলে রাখার বিরুদ্ধে কথা বলেছে।
ইরাকে মার্কিনী যুদ্ধের পরে প্রবীর, আইজাজ আহমেদ, ডি রঘুনন্দন, আমি এবং অন্য কয়েকজন ভারতে একটি মিডিয়া খোলার কথা বিবেচনা করি যারা বিশ্বের এইসব পরিস্থিতিকে সামনে আনবে। একটি বাড়ির বেসমেন্টে, পিছনে আইজাজের বইয়ের সারি, প্রবীরের কেনা একটি ক্যামেরা এবং আইজাজের কেনা আরেকটি ক্যামেরা নিয়ে নিউজক্লিকের জন্ম হয়। ওখানে নিজের নিজের কাজের শেষে সন্ধ্যায় আমরা জড়ো হতাম এবং পশ্চিম এশিয়া থেকে বিজ্ঞান নিয়ে পরস্পরের সাক্ষাৎকার নিতাম। ‘ হ্যালো, নিউজক্লিকে স্বাগত, আজ আমাদের সঙ্গে আছেন অধ্যাপক আইজাজ আহমেদ’, এখন যখন প্রবীরকে জেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এই শব্দগুলি কানে ভাসছে, চোখে জলও আসছে। পশ্চিম এশিয়া, উত্তর আফ্রিকা বিশেষত ইরাক ও ইরান নিয়ে নিউজক্লিক গুরুত্বের সঙ্গে কভার করেছে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষকে কেন্দ্রে রেখে সংবাদ পরিবেশনায় নিউজক্লিক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠ হয়ে উঠেছে। এটি সুবিদিত যে নিউজক্লিকের সঙ্গে যুক্ত প্রধান ব্যক্তিরা বামপন্থী মহল থেকে এসেছেন এবং জনগণের আন্দোলন ও জনগণের জীবন গুরুত্বের সঙ্গে কভার করা হয় এতে। ক্রমশ নিউজক্লিক শ্রমিক, কৃষক, মহিলা, দলিত, আদিবাসীদের সংগ্রাম, যারা দেশকে আরও উন্নততর করার লড়াই চালাচ্ছেন তাদের সংগ্রামে বেশি বেশি মনোনিবেশ করেছে। গত তিন বছরের বেশি সময়ে মূলস্রোতে কর্মরত সাংবাদিকরা নিউজক্লিক পড়েছেন শ্রমিক-কৃষকের সংগ্রামের খবর জানার জন্য। কৃষকদের প্রতিবাদ, দলিত আদিবাসীদের আন্দোলন, মুসলিমদের বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ, বিশেষ করে কাশ্মীরের সংবাদের জন্য নিউজক্লিক উৎসের কাজ করেছে।
২০২১-এর ফেব্রুয়ারিতে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট নিউজক্লিকের সঙ্গে সম্পর্কিত ৮টি জায়গায় হানা দেয়। প্রবীরের বাড়িতে ১১৩ ঘণ্টার তল্লাশি চলে। সরকারের এজেন্সি দেখতে চায় নিউজক্লিক কোথা থেকে টাকা পেয়েছে, অভিযোগ করে বিদেশিরা ভারতের স্বার্থ খর্ব করতে নিউজক্লিককে টাকা দিচ্ছে। ভারতের কৃষক ও শ্রমিকদের আন্দোলনের রিপোর্ট লেখা যদি ভারতের স্বার্থের বিরোধী হয় তার অর্থ দাঁড়ায় শ্রমিক-কৃষকরা ভারতের মানুষ নন। এই তল্লাশির পরপরই এক সাক্ষাৎকারে প্রবীর প্রশ্নের উত্তরে বলে, ‘‘ যে অর্থ বিনিয়োগ হয়েছে তা প্রকাশ্য, ব্যালান্স শিটে রয়েছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মাধ্যমে এসেছে। এখন ভারতে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ২৬ শতাংশ পর্যন্ত বিদেশি বিনিয়োগ হতে পারে, আমাদের ক্ষেত্রে তা ৯ শতাংশ। কোনও ঘটনাই বেআইনি না। তাহলে ইস্যুটা কী, সেটাই তো আমি বুঝতে পারছি না।’’
নিউজক্লিক ও প্রবীরের বিরুদ্ধে মামলা চলতে থাকে, হয়রানিও চলতে থাকে। পুলিশ ও গোয়েন্দাদের নিম্নস্তরের অফিসাররা জানান কোথাও অপরাধের কোনও প্রমাণ নেই কিন্তু তদন্ত চালিয়ে যেতে তাদের বাধ্য করা হচ্ছে। এর মধ্যেই নিউ ইয়র্ক টাইমসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় (৫ আগস্ট, ২০২৩)। ধোঁয়াশা তৈরি করা সেই প্রতিবেদনে নেভিল রায় সিংঘম বলে এক ব্যক্তির কথা বলা হয় যিনি প্রযুক্তি শিল্প থেকে অর্থবান হয়েছেন। তিনি তাঁর এই অর্থের একাংশ জনগণের পক্ষে সোচ্চার মিডিয়া এবং বামপন্থী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য দিয়ে দিচ্ছেন। কোনোটাই বেআইনি ব্যাপার নয়। নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে যে তথ্য পেশ হয়েছে তা প্রকাশ্যে জ্ঞাত তথ্য কিন্তু যেন স্কুপ দেওয়া হচ্ছে এভাবে পেশ হয়েছে। তারা চীনের সরকারের একটি নেটওয়ার্কের কথা উল্লেখ করে। জোড়াতালি মার্কা এক প্রতিবেদন।
ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পরের দিনই তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর সাংবাদিক সম্মেলন করে নিউজক্লিককে আক্রমণ করেন। অথচ টাইমসের ওই প্রতিবেদনে স্পষ্টই বলা হয়েছিল, মোদী সরকার নিউজক্লিকে তল্লাশি চালিয়েছে এবং তাদের চীনের সরকারের সঙ্গে যুক্ত বলে অভিযোগ করেছে কিন্তু ‘কোনও প্রমাণ দিতে পারেনি’। টাইমস তাদের নিজেদেরই ২০২০ সালের এক প্রতিবেদনকে যুক্ত করেছে যার শিরোনাম ‘ মোদীর রাজত্বে ভারতের সংবাদ মাধ্যম আর নিরাপদ নয়’। কিন্তু ঠাকুরের মতো লোকের হাতে নিজেদের অস্ত্র হিসাবে ব্যবহৃত হতে দিয়েছে টাইমস। শুধু নিউজক্লিকের ব্যাপার নয়, এর সঙ্গে রাহুল গান্ধীকে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। ঠাকুর টাইমসের ওই প্রতিবেদন উল্লেখ করে বলেছেন, রাহুল কোনোভাবে নিউজক্লিকের সঙ্গে জড়িত সুতরাং তিনি সিংঘমের সঙ্গে জড়িত। কোনোটাই সত্যি না, কিন্তু এই রাজনৈতিক নাটকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে নিউজক্লিক।
ঠাকুরের এই সাংবাদিক সম্মেলনের দশ দিন পরে সরকার থেকে ফাঁস হওয়া ই-মেল ভারতের মিডিয়ার একাংশে প্রকাশিত হয়। রায়ের প্রবীর ও আমাকে লেখা ই-মেল। দিল্লি পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিত মামলা করে, প্রবীর ও অমিতের বিরুদ্ধে দানবীয় ইউএপিএ ধারায় মামলা রুজু করে। ইউএপিএ আইনের পরিধিতেই বাড়ি বাড়ি তল্লাশি হয়, প্রবীর ও অমিতকে গ্রেপ্তার করা হয়। হিন্দু পত্রিকার প্রাক্তন সম্পাদক এন রাম বলেছেন, ‘ এ হলো ভারতের ম্যাকার্থি মুহূর্ত, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপরে আক্রমণ’।
প্রবীরের বয়স এখন ৭১। প্রবীর ও অমিত দু’জনেই খুব সংবেদনশীল মানুষ, যারা পৃথিবীকে আরও ভালো জায়গা হিসাবে তৈরি করার জন্য জীবনভর লড়াই করেছে। তাঁরা এখন জেলে। যখন থেকে এই মামলা শুরু হয়েছে তখন থেকেই প্রবীর হেসে বলত, সে নিজে স্টোরি হবার বদলে স্টোরি কভার করতেই উৎসাহী। সাংবাদিকরা এ কথা প্রায়ই বলে থাকেন। প্রবীর এবং আমরা চেয়েছিলাম এমন এক সংবাদ মাধ্যম তৈরি করতে যা শ্রমিক ও কৃষকদের জন্য জাগ্রত থাকবে, যুদ্ধের বদলে শান্তির কথা বলতে থাকবে। তখনও আমরা তেমন সংবাদ মাধ্যম চেয়েছিলাম, এখনও ভারতে সেই রকমের সংবাদ মাধ্যমই দরকার। বিশ্ব সংবাদ মাধ্যম স্বাধীনতা সূচকে ভারতের স্থান ১৮০ দেশের মধ্যে ১৬১তম। যত বেশি বেশি সাংবাদিক রাষ্ট্রের অতিথি হতে থাকবেন, ভারত তত নামতে নামতে একেবারে তলানিতে পৌঁছাবে।
Post Editorial
শ্রমিক-কৃষকের কথা বলাই মূল অপরাধ
×
Comments :0