তথাকথিত উন্নয়নের নামে ধর্মের মোহ সৃষ্টিকারী অনুকূল পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে গোটা হিমালয়ের পাহাড়ী অঞ্চলে বিপর্যয় নামিয়ে আনার বিপজ্জনক খেলায় নেমেছে আরএসএস-বিজেপি চালিত কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলি। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বিপদের মুখে পড়ে অস্তিত্ব বিপন্নতায় ভুগছে উত্তরাখণ্ডের মানুষ। যোশীমঠের সাম্প্রতিক ঘটনা তারই জ্বলন্ত প্রমাণ। ছোট্ট এই প্রাচীন পাহাড়ী শহরটির অস্তিত্ব আজ সত্যিই বিপন্ন। একাধিক সরকার অনুমোদিত প্রকল্প নির্মাণের জেরে শহরের মানুষের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
উত্তরাখণ্ডের চামেলি জেলার বিখ্যাত পর্যটনকেন্দ্র যোশীমঠ ছ’হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। গাড়োয়াল হিমালয়ের এটিই পরিচিত প্রবেশ পথ। ধৌলি গঙ্গা ও অলকানন্দার সঙ্গমস্থল বিষ্ণুপ্রয়াগ থেকে যোশীমঠের দূরত্ব প্রায় ১৩ কিলোমিটার। এই শহরকে কেন্দ্র করে তৈরি হচ্ছে একাধিক প্রকল্প। তারমধ্যে অন্যতম এনটিপিসি’র তপোবন বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য তৈরি হচ্ছে একাধিক সুড়ঙ্গ। ক্রমাগত বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পাহাড় ফাটিয়ে সুড়ঙ্গ ও রাস্তা নির্মাণের ধাক্কায় শহরের সর্বত্র ছোট বড় সব বাড়িতে ফাটল দেখা দিয়েছে। অতি বিপজ্জনক অবস্থায় আছে বহুতলগুলি। যতদিন যাচ্ছে ফাটলের মাত্রা বাড়ছে। ফলে বহু মানুষকে নিজেদের বাড়ি ঘর থেকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এই অবস্থায় চরম আতঙ্কের মধ্যে স্থানীয় মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের প্রকাশ ঘটছে বিক্ষোভে, অবস্থানে, বন্ধ পালনের মধ্যে দিয়ে। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে জেলা প্রশাসন নির্মাণ কাজ সাময়িক বন্ধ রাখার কথা ঘোষণা করেছে।
প্রকৃতির স্বাভাবিক ভারসাম্যকে অস্বীকার করে এই পাহাড়ী রাজ্যে যেভাবে একের পর এক তথাকথিত উন্নয়ন প্রকল্প রূপায়ণ করা হচ্ছে তাতে সেখানকার মানুষই বেঁকে বসতে শুরু করেছেন। অবৈজ্ঞানিক নির্মাণ প্রকল্পের বিরুদ্ধে তারা সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে পথে নামতে শুরু করেছেন। গাড়োয়াল হিমালয়ে অবস্থিত যোশীমঠ পর্যটনের পক্ষে অত্যন্ত আকর্ষণীয় জায়গা। গোটা দেশ তো বটেই, বিদেশিরাও প্রতিবছর ভিড় জমান এখানে। যোশীমঠ অন্যতম ধর্মস্থানও। তেমনি যোশীমঠ হয়ে যেতে হয় অন্যান্য বিখ্যাত ধর্মস্থানে। উত্তরাখণ্ডের প্রায় সব বিখ্যাত ধর্মস্থানই পর্যটন কেন্দ্র অথবা সব পর্যটনকেই ধর্মের মাহাত্ম্য দিয়ে পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে বা হচ্ছে। তথাকথিত উন্নয়ন তারই প্রধান উপলক্ষ। হিন্দুত্ববাদী সরকার এইসব জায়গাগুলিকে পর্যটকদের কাছে প্রকৃতিগতভাবে অতি আর্কষণীয় করে তোলা ও ধর্মীয়ভাবে আকর্ষণীয় করে তুলতে মরিয়া। কারণ তাতে তাদের রাজনৈতিক লাভ। ধর্মের মাহাত্ম্যকে এমন জায়গায় উন্নীত করতে চায় যাতে মানুষের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের টানে নয় ধর্মের টানে এইসব অঞ্চলে বেশি বেশি করে বেড়াতে আসেন। প্রকৃতিকে ভ্রমণের প্রধান উপাদান না করে ধর্মান্ধতাকে মুখ্য উপাদান করতে চায় বলে বেপরোয়াভাবে প্রকৃতির ভারসাম্য ধ্বংস করে উন্নয়নের যজ্ঞ চলছে রাজ্যের উদ্যোগে ও কেন্দ্রের মদতে ও অর্থে। প্রধানমন্ত্রীর চারধাম উন্নয়ন প্রকল্প এমনই একটি। তার উপর চলছে পাহাড় কেটে সমস্ত রাস্তা প্রশস্ত করার কাজ।
বিজ্ঞানের প্রমাণিত সত্য গাড়োয়াল হিমালয় প্রাকৃতিকভাবে দুর্বল ও ভঙ্গুর। বেশি ভার বইতে পারে না। তা সত্ত্বেও লাগাতার তৈরি হচ্ছে বড় বড় প্রকল্প। গত পঞ্চাশ বছর ধরে কোনও বিশেষজ্ঞ কমিটি বৃহৎ নির্মাণের পক্ষে সায় দেয়নি। তথাপি প্রকল্প অনুমোদন পাচ্ছে। সরকার অন্ধ। হিন্দুত্ববাদীরা বেপরোয়া। মানুষের পিঠ ঠেকে গেছে দেওয়ালে। এবার যদি বিজ্ঞান মর্যাদা পায় তো ভালো। নয় ধ্বংসই অনিবার্য পরিণতি।
Editorial on Joshimath
কবে চোখ ফুটবে
×
Comments :0