INSAF FARMERS

ব্রিগেড সমাবেশ সফল করার দায় বাংলার কৃষকদেরও

রাজ্য উত্তর সম্পাদকীয়​

অমল হালদার


যুবদের ইনসাফ যাত্রাকে কেন্দ্র করে সমাজের অন্যান্য অংশের মতো কৃষক সমাজের মধ্যেও ব্যাপক সাড়া লক্ষ্য করা গেছে। যুবদের নিজস্ব দাবির সাথে যখন মিছিলে দাবি উঠেছে কৃষকের ফসলের ন্যায্য মূল্য বা খেতমজুরদের ১০০ দিনের কাজ সহ বকেয়া মজুরি, সাম্প্রতিককালে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলের ব্যাপক ক্ষতির জন্য সরকারি সাহায্যের দাবি ইত্যাদি কৃষক জীবনের সমস্যাগুলি যত সামনে এসেছে দলে দলে কৃষক, খেতমজুর গ্রামের অসংগঠিত শ্রমিকরা মিছিলে শামিল হয়েছেন। যুবদের ইনসাফ যাত্রায় রাজ্যের বিভিন্ন এলাকার স্থানীয় সমস্যাগুলিও প্রাধান্য পেয়েছে। নদী ভাঙন, সেচ, নিকাশি, জলাশয় ভরাট করে পরিবেশকে ধ্বংস করার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে এই মিছিল। এই মিছিলই আওয়াজ তুলেছে ৭ জানুয়ারি ব্রিগেড ভরাও বাংলার কৃষক সমাজও চুপ করে থাকতে পারে না, তাঁরাও ছুটবেন ব্রিগেড সমাবেশে ইতিমধ্যেই প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে।
সারা দেশের মতো এই রাজ্যের কৃষকের যন্ত্রণা প্রতিদিনই বহুগুণ বাড়ছে। দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন কৃষকদের দ্বিগুণ আয়ের গল্প ফেঁদেছেন তখন এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী অসত্য তথ্যে কম যাবেন কেন, তিনি বলছেন তিন গুণ আয় বেড়েছে। সাম্প্রতিক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পর যা মাত্র কয়েকদিনে এই রাজ্যে ৭ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। এই রাজ্যে তৃণমূল সরকার প্রতিষ্ঠিত হবার পর যত সময় গেছে কৃষক তাঁর নিজের জমিতে চাষের প্রতি আগ্রহ হারিয়েছেন। উৎপাদন খরচ যতটাই বাড়ছে তেমনি ফসলের মূল্য ততটাই কমছে। ঋণের জালে জর্জরিত কৃষক সামান্য কিছু ফসলের বিনিময়ে চুক্তির ভিত্তিতে জমিতে গতর খাটাতে সক্ষম কিছু গরিব মানুষকে জমি দিতে বাধ্য হচ্ছেন। বাংলার এই কঠিন বাস্তব চিত্রটা উল্লেখ করতে ওরা লজ্জা পান। একবার ভাবুন সত্যিই যদি তিনগুণ আয় বৃদ্ধি হতো কেউ জমি অন্যকে চাষ করতে দিতেন না। এরপরও দেখা যাচ্ছে আর এক চিত্র, চুক্তিচাষিদের কোনও কাগজ পত্র থাকে না। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ফসলহানি হলে যদিও কিছু বিমার টাকা জোটে সেটাও পায় জমির মালিক। গতর খাটিয়ে যে চাষ করে সে বঞ্চিত হয়। এটা ক্রমশ বাড়তে থাকায় এখন চুক্তি চাষিও খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। অবিলম্বে কৃষকের নিকট ফসলের বিনিময়ে যিনি চুক্তিতে জমি চাষ করবেন একটা প্রমাণপত্র না থাকলে সমস্যাটা ধীরে ধীরে জটিল হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে আরও হবে। প্রতিদিনই অধিকার হারানোর যন্ত্রণা বেড়েই চলেছে। এই রাজ্যে বর্গাদার, পাট্টাদার জমি হারাচ্ছেন। বিএলএলআরও অফিসগুলি হয়ে উঠেছে দুর্নীতির আখড়া। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে পাট্টা পাওয়া জমির রেকর্ড পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে গোটা রাজ্যেই একই হাল। কৃষকসভার পক্ষ থেকে রাজ্যের প্রত্যেকটি ভূমি দপ্তরে স্মারকলিপি দেওয়া সত্ত্বেও সরকারের কোনও হেলদোল নেই। অবশেষে পথ দেখালো পশ্চিম মেদিনীপুরের ডেবরা ব্লক, দুদিন দপ্তর ঘেরাও করার পর পাট্টা জমির রেকর্ড পাট্টা প্রাপকের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয়েছেন। অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে শুধুমাত্র স্মারকলিপি যথেষ্ট নয়, জঙ্গি ধারায় আন্দোলন গড়ে তুলতে পারলে বহু কৃষককে ঐক্যবদ্ধ করা ও আন্দোলনের প্রতি উৎসাহিত করা সম্ভব।
কৃষক সহ জনজীবনের সঙ্কট যত বৃদ্ধি পাচ্ছে, সঙ্কটকে ভুলিয়ে দেবার জন্য দেশের প্রচার মাধ্যম এবং সরকার ধর্ম, জাতপাত সহ নানা ইস্যুতে মানুষকে আফিমের নেশার মতো বুঁদ করে রাখার চেষ্টা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই আমরা ভুলে গেছি গত কেন্দ্রীয় বাজেটে কৃষি খাতে ১,২৪০০ কোটি টাকা যা ব্যয় হতো তা এক ধাক্কায় ১,১৫,৫৩১.৭৯ কোটি টাকা করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী কিষান সম্মাননিধি যোজনায় ১ পয়সাও বৃদ্ধি করা হয়নি। গ্রামে বেকারদের কাজের ক্ষেত্রে বরাদ্দ ১,৫৩,৫২৫.৪১ কোটি থেকে ১,০১,৪৭৪.৫১ কোটিতে নামিয়ে আনা হয়েছে। ১০০ দিনের কাজের ক্ষেত্রে ৮৯০০০ কোটি বরাদ্দ ৬০,০০০ কোটিতে এসে ঠেকেছে। আত্মনির্ভর ভারত রোজগার যোজনায় বরাদ্দ ৫৭৫৮ কোটি টাকা থেকে ২২৭৩ কোটি টাকা করা হয়েছে। সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় খাদ্য সাবসিডির ক্ষেত্রে ২৮,৭১৯৪ কোটি টাকা থেকে ১,৯৭,৩৫০ কোটিতে নামিয়ে আনা হয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তার জন্য খাদ্যশস্য সংগ্রহের জন্য ৭২২৮২.৫০ কোটি থেকে এক ধাক্কায় ৫৯.৭৯৩ কোটিতে দাঁড় করানো হয়েছে। এর ফলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও রেশনে খাদ্য সামগ্রী জোগান মারাত্মকভাবে কমতে শুরু করবে। সারের দাম বিপুলভাবে চড়েছে আমাদের রাজ্যওে। আমরা কতজন খোঁজ রাখি কেন্দ্রীয় সরকার সারের উপর থেকে ভরতুকি ব্যাপকভাবে কমিয়ে দিয়েছে, এর সাথে ন্যানো ইউরিয়া অবৈজ্ঞানিকভাবে চাপিয়ে দেবার চেষ্টা চলেছে। এর ফলে কৃষি উৎপাদনে ভয়াবহ প্রভাব পড়বে এবং দেশে খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্ন দেখা দেবে। সারের দাম বৃদ্ধি, সারের কালোবাজারি, সারে ভেজাল ইত্যাদি সমস্যা নিয়ে এই রাজ্যে কৃষকরা কার্যত নাজেহাল অবস্থা। রাজ্যের মন্ত্রী থেকে সাধারণ আমলা, পুলিশ যদি চরম দুর্নীতিগ্রস্ত হয় তাহলে কৃষকদের এই সমস্যাগুলির সমাধান কে করবে? একবার আলু চাষ করার পর তা নষ্ট হয়ে গেল প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে। নতুন করে আলু চাষে বিজে মারাত্মক ভেজাল, আলু
তোলার সময় কি অবস্থা হবে এখনই অনুমান করা কঠিন। উৎপাদন অনেকটাই কম হতে পারে বলে চাষিদের ধারণা। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো হাজির হয়েছে স্মার্ট মিটার, গৃহস্থ যেমন বিপদে পড়বে স্যালো, সাব মার্সিবলে যারা জমি চাষ করেন তাদের বিপদের দিন দরজায় কড়া নাড়ছে। স্মার্ট মিটার চালু হলে সাব মার্সিবলে আর জমি চাষ করতে পারবেন না প্রতিদিনই সার, বীজ, কীটনাশকের দাম বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন খরচ বাড়ছে এরপর যদি বিদ্যুতের ক্ষেত্রে চড়া দাম দিতে হয় কিভাবে কৃষক বাঁচবে?
গ্রামাঞ্চলে বর্তমান শাসকদলের মদতে নব্যধনীরা আজ গ্রাম শাসন করছে। এই নব্যধনীরা নানা ছলচাতুরি, দুর্নীতি করে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করেন। এরাই এখন নতুন মহাজন। চাষের সময় এই মহাজনরা কৃষককে চড়া সুদে ঋণ দেয়। কৃষক পরিবারের সন্তানের বই, খাতা জামা কাপড়ের জন্য এদের কাছেই টাকা নিতে হয়। ফসল ওঠার পর নামমাত্র দামে তাঁকে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হয়। এটা পশ্চিমবঙ্গে ছিল না। এই সরকারের আমলে ক্রমশঃ বাড়ছে। মহাজনী এই প্রথাগুলি আসছে এই কারণে যে সমবায় ব্যবস্থা এরা ধ্বংস করে দিয়েছে। অতীতে গ্রামীণ সমবায়গুলি থেকে যে ঋণ পাওয়া যেত এখন তা কার্যত তলানিতে। পঞ্চায়েতের মতো সমবায়ে চলছে ব্যাপক দুর্নীতি। একদিকে মহাজনের কাছে ঋণ আর অন্যদিকে মাইক্রোফিনান্সের হাতছানি। চড়া সুদে মাইক্রোফিনান্সের নিকট ঋণ নিয়ে পরিশোধ করতে না পেরে রাতের অন্ধকারে বাউন্সারের অত্যাচারের ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালাতে বাধ্য হচ্ছে। কেউ চলে যাচ্ছে পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে ভিন্ন রাজ্যে আবার কেউ কেউ অন্যত্র আত্মগোপন করতে বাধ্য হচ্ছেন।
রাজ্য সরকারের নীরবতা দেখে কৃষকদেরও লজ্জা হয়। বর্ধমান জেলায় বেশ কিছু এলাকায় খাস ধান উৎপাদন হয় যাকে আমরা অনেকেই গোবিন্দভোগ বলে জানি। এই চাল মূলত আরব সহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়। বিগত ২ বছর খাস ধানের বাজার নেই। কারণ অন্য রাজ্যের বাসমতী চাল বাইরের দেশে রপ্তানি হচ্ছে, খাস ধানের উপর যে ট্যাক্স বসানো হয়েছে তাতে ব্যবসায়ীদের লোকসান হচ্ছে। আগে খাস ধান বাজারে এলেই ৩২০০ টাকা বস্তা ছিল (৬০ কেজিতে ১ বস্তা), এখন ১৭০০-১৮০০ টাকাতেও বিকোচ্ছে না। অসময়ে বৃষ্টির পর গুণমান খারাপ হয়ে গেছে। রাজ্য সরকারের এ ব্যাপারে কোনও হেলদোল নেই, ফসলের দাম না পাবার ফলে গ্রামের বাজার শুকিয়ে যাচ্ছে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা দ্রুত হারে কমছে। যাদের চাষ একমাত্র সম্বল তাঁদের সংসার আর চলছে না। এই হাহাকারকে চাপা দেবার চেষ্টা চলছে প্রবল। রাস্তায় নেমে বাংলার যুব সমাজ স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, চুপ করে বসে থাকলে আপনি বাঁচতে পারবেন না। গ্রামে গ্রামে সরকারের জনবিরোধী নীতিগুলির বিরুদ্ধে শ্রমিক, কৃষক, খেতমজুর, মহিলা সহ সমগ্র অংশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হচ্ছেন। ২৬ জানুয়ারি সারা দেশে হবে ট্রাক্টর র্যা লি। ফেব্রুয়ারি মাসে শ্রমিক, কৃষক সংগঠনগুলির যৌথ উদ্যোগে দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের প্রস্তুতি চলছে। দেশে রামমন্দির হলো, কিন্তু আমাদের পেটের জ্বালা, সন্তানদের চাকরির কি হলো? – এই প্রশ্ন নিয়েই তো ব্রিগেড জমায়েত। আসুন এই উত্তর খুঁজতে বাংলার কৃষক, অতীত আন্দোলনের ঐতিহ্য নিয়ে ব্রিগেড সমাবেশকে অনেক বড় করে তুলি যা আগামী দিনে আমাদের আত্মবিশ্বাসকে বৃদ্ধি করতে সাহায্য করবে।
 

Comments :0

Login to leave a comment