সুমনা সিনহা
ফ্রান্সে, একটা বড় অংশের ফরাসিদের কাছে, একজন ‘ভালো’ মানে সমাজে গ্রহণযোগ্য মুসলিম হলেন তিনিই, যে ভুলে যান যে তিনি একজন মুসলিম, যিনি নিজেকে ধার্মিক মুসলিম হিসাবে দাবি করেন না। অন্যদিকে, একজন ‘ভালো’ ভারতীয় মানে যাকে সর্বদা হিন্দু বলে ধরে নেওয়া হয়– তার কর্তব্য হলো নিজের হিন্দু পরিচয় জাহির করা এবং ভারতের হিন্দু আধ্যাত্মিক ভাবমূর্তি তৈরিতে ভুমিকা গ্রহণ করা। কল্পনাপ্রসূত ভারতীয় হিন্দু এবং ফরাসি ভারততত্ত্ববিদ এবং প্রাচ্যবিদদের মধ্যে একটি নীরব বোঝাপড়া প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে, যারা কয়েক দশক ধরে একে অপরের সামনে আয়না তুলে ধরে আসছেন। এইসব ভারতবিদদের লেখা পড়লে কেউ জানতেই পারবে না যে ভারতে বিপুল সংখ্যক মুসলিম, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, খ্রিস্টান, ইহুদি ... অজ্ঞেয়বাদী, যুক্তিবাদী এবং নাস্তিক রয়েছেন। ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক মিশ্রণের দেশ থেকে, একটি একমাত্রিক, সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় ভাবমূর্তি তুলে ধরা সম্পূর্ণ অসৎ এবং বিপজ্জনক প্রচেষ্টা। একটি বহুসাংস্কৃতিক এবং বহুধর্মীয় দেশের একমাত্রিক ধর্মীয় ভাবমূর্তি– হিন্দুধর্মীয় পরিচয় এবং ভাবমূর্তি প্রচার করা এবং জনসাধারণের উপর তা চাপিয়ে দেওয়াই হলো আধিপত্যবাদী পরিকল্পনা।
আরও চিন্তার বিষয় এই যে, ভারতবর্ষের দর্শন, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, সবই তাঁরা শুধুমাত্র ধর্মবিদ্যা দিয়ে বিচার করেন, ধর্মীয় পুস্তক, বেদ, পুরাণ, প্রাচীন সংস্কৃত শ্লোক, পুঁথি দিয়ে বিচার করেন এবং সেটাই জনমানসে আরোপ করেন। এঁরা যুক্তিবাদী, বাস্তববাদী রাজনৈতিক দর্শনের অস্তিত্বকে নস্যাৎ করেন, মার্কসবাদী, বামপন্থী রাজনৈতিক চিন্তা, চেতনা, সংগ্রামকে পশ্চিমী সভ্যতার অনুকরণ এবং ভারতবর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে অনুপযুক্ত বলে মনে করেন, তাই এসবের কোনও উল্লেখই তারা করেন না।
বিখ্যাত লেখক, নাট্যকার, ভারতপ্রেমী ও ভারতবিদ জঁ-ক্লোদ কারিয়ের (১৯৩১-২০২১) প্রাচীন ভারত, রামায়ণ, বিশেষত মহাভারত নিয়েই আজীবন চর্চা করেছেন, যার সাংস্কৃতিক মূল্য অসামান্য হলেও, তাতে আধুনিক ভারতের মুখ আর মনন অনুপস্থিত। ভারততত্ত্ববিদ এবং INALCO-র হিন্দি ভাষা ও ভাষাতত্ত্বের প্রফেসর আনি মন্ত্য, তিনিও তাঁর কাজে ও বইতে হিন্দু ধর্ম নিয়েই গবেষণা এবং বক্তব্য রাখেন, অন্য কোনও ধর্ম, বিশেষত ইসলাম ধর্ম, মুসলমান সম্প্রদায়, সুফী সমাজ এরাও ভারতবর্ষের নাগরিক, অথচ তাঁদের সম্পর্কে কোনও উল্লেখই করেন না !
কিছু ভারততত্ত্ববিদ আরও কৌশলী পথ বেছে নিচ্ছেন। তাঁরা এককভাবে কাজ করেন না, পক্ষপাতদুষ্ট দল হিসাবে কাজ করেন। CNRS (জাতীয় গবেষণা কেন্দ্র) বা BNF (জাতীয় গ্রন্থাগার )-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে কাজগুলো চালান। CNRS জাতীয় গবেষণা কেন্দ্রের প্রাক্তন গবেষক এবং সরবোন নুভেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, ভারততত্ত্ববিদ নলিনী বলবীর; জাতীয় গ্রন্থাগারের কিউরেটর নলিনী বলবীরের শিষ্য ভারততত্ত্ববিদ জেরোম প্যতি; ভারততত্ত্ববিদ ইসাবেল রাতিয়ে প্রমুখরা মোট চল্লিশ জন ভারততত্ত্ববিদ তৈরি করেছেন ভারতীয় অধ্যয়ন গবেষণা দল। এরা ধর্মতত্ত্ব ছাড়া আর কোনও বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করেন না, ভারতচর্চাকে উপরিউল্লিখিত ধর্মীয় সাধনার রূপ দিয়েছেন। যোগা, তান্ত্রিক যোগা, তন্ত্রসাধনা, ধ্যান ও মোক্ষ এসব নিয়ে ‘গবেষণা’তেই ব্যস্ত এবং এই সব বিষয়ে কনফারেন্স, বক্তৃতামালা ও ক্লাস সংগঠিত করে চলেছেন। এঁরা এই সেপ্টেম্বর মাসেই শুরু করলেন ফরাসি যোগা স্কুল - ২০২৫-২০২৬ কর্মসূচি।
এখন প্রবল সমালোচনার মুখে পড়ে নিজেদের গ্রহণযোগ্য ভাবমূর্তি তৈরির জন্য, অন্তর্ভুক্তির প্রমাণ হিসাবে, তাঁরা ভারতবর্ষের অন্যান্য ধর্মের উপর সেমিনার শুরু করেছেন। কিন্তু এখনও সেই বৈদিক যুগকেই ভারতীয় ইতিহাসের সূত্র হিসাবে, সূচনা বিন্দু হিসাবে ঘোষণা করছেন, ‘আর্য হিন্দু’কে আদি এবং সর্বশ্রেষ্ঠ ভারতীয় হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করছেন। যদিও অনেক ভারতবিশেষজ্ঞ, ইতিহাসবিদ, নৃবিজ্ঞানী এবং রাজনীতিবিদরা এই অদ্ভুত মিথ্যাকে খণ্ডন করেছেন।
এভাবেই এই ভারতীয় এবং ফরাসি ভারততত্ত্ববিদরা নরেন্দ্র মোদীর হিন্দুত্ববাদ প্রচারের মিথ্যা ভাষ্য ব্যবহার করছেন। তাঁরা তাঁদের রাজনৈতিক শত্রুদের, মানে মোদী বিরোধী, হিন্দুত্ববাদ বিরোধী, নাস্তিক এবং বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের ‘বিশ্বায়নের পণ্য’ বলে অভিযোগ তুলে বদনাম করেন। যার অর্থ দাঁড়ায় যে, তাঁরা আন্তর্জাতিকতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বা সর্বজনীন মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে একটি ‘বৌদ্ধিক ত্রুটি’ হিসাবে ইঙ্গিত করেন। তাঁরা প্রচার করছেন যে তাঁদের রাজনৈতিক শত্রুদের ‘নিজেদের ভারতীয় পরিচয়’ সম্পর্কে কোনও জ্ঞান নেই এবং একই সাথে পরামর্শ দেন যে তাঁদের ‘নিজেদের ভারতীয় পরিচয় আবিষ্কার করা উচিত’।
এর অর্থ হলো, তাঁরা তাঁদের সংজ্ঞা অনুসারে, আধিপত্যবাদী হিন্দু পরিচয়কে ভারতীয়ত্বের একমাত্র ‘বৈধ পরিচয়’ হিসাবে প্রচার করছেন। একইসাথে এটাও প্রচার করছেন, এই কথিত পরিচয়ের সাথে নিজেকে সংশ্লিষ্ট না করাটা ‘বৌদ্ধিক বিশ্বাসঘাতকতা’র কাজ। এই সমস্ত প্রচার, প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাঁরা সাংস্কৃতিক পরিচয় দখল, দক্ষিণদেশের আখ্যান বাজেয়াপ্তকরণ এবং দক্ষিণদেশের আখ্যান পুনর্লিখনের কাজ করছেন। তাঁদের মতবাদকেই একমাত্র ‘বৈধ ভারততাত্ত্বিক অধ্যয়ন’ হিসাবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন এবং যে কোনও বিরোধী বিশেষত হিন্দুত্ববাদবিরোধী, নাস্তিক এবং বামপন্থী চিন্তাভাবনার বৈধতাকেই নির্মূল করার চেষ্টা করছেন ।
তবে এই সবের মাধ্যমে তাঁদের রাজনৈতিক পরাজয়, বৌদ্ধিক অসততা এবং নৈতিক দেউলিয়াপনাই প্রকট হয়ে উঠেছে।
আশার কথা এই যে, ভারতবর্ষের বিষয়ে ফরাসিরা আর অনবগত নন; তথ্য ভিত্তিক প্রতিবেদন প্রচুর লেখা এবং প্রকাশিত হয়ে চলছে। ফরাসিরা অবহিত হচ্ছেন এবং সচেতন হচ্ছেন।
ভারতবর্ষ নিয়ে রহস্যময়তা, মোহময়ী, আধ্যাত্মিক ভাষ্য লেখা মোটেই নির্দোষ কাজ নয়, এ হলো ইচ্ছাকৃত। ফ্রান্সে অনেকেই হিন্দুধর্মের মাধ্যমে তাঁদের মুসলমান বিরোধিতার, ইসলাম বিরোধিতার মানানসই অজুহাত খুঁজে পেয়েছেন। হিন্দু আধ্যাত্মিকতার প্রতি তাঁদের আকর্ষণ তাঁদের অমীমাংসিত উত্তর-ঔপনিবেশিক সমস্যার একটি পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া। তিনটি একেশ্বরবাদী সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সম্ভবত কেউ কেউ হিন্দুধর্মকে একটি ধর্ম হিসাবে বিবেচনা করেন না, বরং একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে বিবেচনা করেন। যদি ফরাসি নাগরিকদের উগ্র ইসলামে যুক্ত হওয়া আমাদের উদ্বিগ্ন করে, তাহলে আমরা কীভাবে ফরাসি ভূখণ্ডে হিন্দুত্ববাদী রীতিনীতির প্রতি অতি আনুগত্য মেনে নিতে পারি? যারা কখনও মক্কায় যাবে না, যারা হজ করার কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারে না, তারা আশ্রম ও মন্দিরে, গণেশ প্রদর্শনে এবং সম্মিলিত যোগা করতে যান। এক ধর্মতন্ত্রের কালো চাদর ভয়ঙ্কর লাগে, তবে অন্য ধর্মতন্ত্রের গেরুয়া ঘোমটা কামুক স্বপ্ন দেখিয়ে উত্তেজিত করে।
আর এটাও সত্য, এখনো পর্যন্ত, ভাগ্যক্রমে ফ্রান্স হিন্দুত্ববাদী আতঙ্কবাদী কর্মকাণ্ডর ভুক্তভোগী হয়নি। উত্তর-ঔপনিবেশিক সম্পর্কের অভাবের কারণে, সংখ্যালঘু ভারতীয় প্রবাসীর কারণে এবং ফরাসি জনসাধারণের বিতর্কে পৌত্তলিকতার বহিরাগত প্রকৃতির কারণে, ভারতীয় ধর্মীয় দ্বন্দ্বগুলি এখনও ফরাসি মাটিতে স্থানান্তরযোগ্য হয়নি ।
সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, ভারতবিশেষজ্ঞ, ইতিহাসবিদ, নৃতত্ত্ববিজ্ঞানী এবং রাজনীতিবিদরা হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির অপরাধমূলক, ফ্যাসিবাদী প্রকৃতি প্রকাশে নিরলস কাজ করা সত্ত্বেও, ভারতবর্ষ সম্পর্কে প্রচলিত ক্লীশেগুলি বাতিল করা হল সিসিফাস-এর পাথর তোলার মতো। ফরাসিদের হিন্দুমোহময়তার প্রকাশ্যে সমালোচনা করা পিঁপড়ের পাহাড়ে লাথি মারার শামিল। কে কোথায় খেপে বসে!
অথচ, ভারতে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্তদের উত্থানের প্রতি এদের প্রতিক্রিয়ার অভাব দেখে আমাদেরই আহত হওয়ার কথা। ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে তাদের লড়াই বিভিন্ন জ্যামিতি মেনে চলে। হিন্দুত্ববাদী সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের প্রতি তাদের শিথিলতা, হিন্দুত্ববাদী আধ্যাত্মিক পণ্যের ইউরোপে ব্যবসা, যুক্তিবাদী ভারতীয়দের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা ।
হিন্দুত্বের দুটি উপাদান রয়েছে: হার্ডওয়্যা র, বা রাজনৈতিক শক্তি, এবং সফ্টওয়্যা র, এই নীতির বাণিজ্যিকীকৃত সাংস্কৃতিক পণ্য, যা হার্ডওয়্যা র রাজনৈতিক শক্তি বজায় রাখতে এবং প্রসারিত করতে সহায়তা করে। যোগা ক্লাস, মেডিটেশন ক্লাস, মন্ত্র, আংটি, মাদুলির ব্যবসা – সফটওয়্যা রের অংশ। উগ্র-দক্ষিণপন্থী হিন্দুদের নেটওয়ার্ক ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে বিস্তৃত, ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত।
২০২০ সালের ডিসেম্বরে, লিবেরাসিঁয় সংবাদপত্র মোদী শাসনের সেবায় নিযুক্ত মিথ্যা কাল্পনিক মিডিয়ার একটি নেটওয়ার্কের অস্তিত্ব সম্পর্কে ব্রাসেলস-এর NGO EU Disinfo Lab-এর রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। জড়িতদের মধ্যে রয়েছেন ফরাসি উগ্র-দক্ষিণপন্থী নেতা তিয়েরি মারিয়ানি। এখনো পর্যন্ত তিনি প্রকাশ্যে মোদীকে বন্ধুত্বমূলক বার্তা এবং পরামর্শ পাঠান। সুতরাং একজন ভারতীয় সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশ– ভারতীয় রাষ্ট্রপ্রধান এবং তার উগ্র-দক্ষিণপন্থী শাসনব্যবস্থার দ্বারা নির্মিত এবং ব্যবহৃত মিথ্যা কাল্পনিক প্রচারযন্ত্রকে জনসমক্ষে প্রকাশ করার জন্য তাঁকে সেই শাসনব্যবস্থার সমর্থকরা হত্যা করল, আর একজন উগ্র-দক্ষিণপন্থী ফরাসি সংসদ সদস্য, তিয়েরি মারিয়ানি, জড়িত আছেন সেই ভারতীয় উগ্র- দক্ষিণপন্থী শাসনব্যবস্থার সেবাকারী কাল্পনিক মিডিয়া নেটওয়ার্কে। বুঝুন কোথাকার জল কোথায় গড়ায়!
বিশ্বব্যাপী উগ্র-দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিস্ত গোষ্ঠীগুলির আন্তর্জাতিক মাফিয়ারা জাতীয় রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে চলেছে, পরিকল্পিত রাজনৈতিক হত্যা পর্যন্ত তারা পৌঁছে গেছে।
দাবার আরেক ঘুঁটি: ফ্রঁসোয়া গোতিয়ে। ল্য ফিগারোর প্রাক্তন সাংবাদিক, উগ্র-দক্ষিণপন্থী বর্ণবিদ্বেষী পত্রিকা ভাল্যর আকচুয়েলে তার ন্যায্য স্থান খুঁজে পেয়েছে, ম্যাগাজিনের সংবাদদাতা হিসাবে ভারতে বসতি স্থাপন করেছে, ২০১২ সালে শিবাজির প্রতি উৎসর্গীকৃত জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেছেন। জাদুঘরের সহ-প্রতিষ্ঠাতা, শ্রী শ্রী রবি শঙ্কর, ফ্যাসিবাদী আরএসএস মিলিশিয়া এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদের প্রতিষ্ঠাতাদের সাথে তার সম্পর্ক রয়েছে বলে জানা যায়।
শেষ পর্যন্ত, থ্রিলারের মতো অনুসন্ধান করা দরকার! মন্দির, আশ্রম এবং অন্যান্য অনুরূপ ভবনে বিনিয়োগ করা স্বার্থহীন নয় মোটেই। ভারতে আধ্যাত্মিক ব্যবসায় ফরাসি শেয়ারহোল্ডার রয়েছে। অপরাধ এবং অপরাধীদের খুঁজে বের করতে, অর্থের প্রবাহ অনুসরণ করতে হবে। কালো ডলার আর ইউরো, লাল সিঁদুর-এ দেগে দেওয়া, সফেদ ধোলাইয়ের অপেক্ষায়।
২০২৪-এর ফেব্রুয়ারি মাসে, আমি এসেছিলাম জয়পুর আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসবে আমন্ত্রিত হয়ে। উৎসবের জন্য নির্ধারিত আলোচনার পাশাপাশি, জয়পুর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরাসি বিভাগে এবং একটি উচ্চ বিদ্যালয়ে, ফরাসি ইনস্টিটিউট এবং দিল্লি বুক ব্যুরোর সহযোগিতায় আমার জন্য দুটি কনফারেন্স আয়োজন করা হয়েছিল। উৎসবের স্বেচ্ছাসেবকরা আমার জন্য ভারতের বিদেশমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর চিঠি, রাজনৈতিক ছাড়পত্র, আদায় করলেন।
আসার দুই সপ্তাহ আগে, ফ্রান্স এবং ভারতে নরেন্দ্র মোদী সমর্থকরা আমার বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রচার চালায়, আমাকে ভারতের ‘বিশ্বাসঘাতক’ এবং ‘শত্রু’ বলে অভিহিত করে, এমনকি ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ কাজ করার অভিযোগ করে। ১৪ জুলাই, ২০২৩ তারিখে নরেন্দ্র মোদীর অতিথি হিসাবে আমন্ত্রণ সংক্রান্ত ফ্রান্স ২৪-এ বিতর্কে অংশগ্রহণের পর থেকে তাদের মধ্যে কেউ কেউ আমাকে অনুসরণ করছিল। তাদের চাপে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরাসি বিভাগের এবং উচ্চ বিদ্যালয়ে আমার কনফারেন্স দুটি বাতিল হয়ে গেলো।
সাহিত্য উৎসবে লেখকদের তাঁবুতে প্রবেশ করার সাথে সাথেই একজন কবি আমার ঘাড়ে চেপে বসলেন। ‘অভয়’, পদবি ছাড়া এই নামেই পরিচিত কবি আমাকে তার কবিতার সংকলনটি দেখালেন। এখানে, চন্দ্রদেবীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে একটি দীর্ঘ কবিতা, ২০২৩ সালের আগস্টে চাঁদে অবতরণ উপলক্ষে ভারত সরকারের কমিশনে লেখা স্তোত্র; ওখানে, সূর্যদেবের প্রশংসায় আরেকটি বইও ছিল, সম্ভবত সূর্য-অবতরণের অপেক্ষায়! এই কবির আবার কূটনীতিক হিসাবে পররাষ্ট্র বিষয়ে গৌরবময় ক্যারিয়ার রয়েছে।
আরেক তরুণী তার প্রথম বই, ভারতীয় সুগন্ধির বিবরণ, প্রকাশ করতে চলেছে। তার বইতে, ‘আতর’ যা মুঘল যুগে তৈরি বিখ্যাত সুগন্ধি, বৈদিক যুগের সুগন্ধি হিসাবে উপস্থাপন করেছে।
এটি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। হিন্দুত্বের আকাঙ্ক্ষা হলো, মহাভারত এবং রামায়ণের সময় হিন্দুদের দ্বারা সবকিছু আবিষ্কার করা হয়েছিল, এই গল্পকেই প্রতিষ্ঠা করা। ইতিহাস পুনর্লিখনের লক্ষ্যে, ঐতিহাসিক তথ্য বিকৃত এবং বাদ দেওয়ার লক্ষ্যে আখ্যান বা কল্পকাহিনির আকারে আরও অনেক ‘সাহিত্যিক’ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। যুবক-যুবতীদের এমন গ্রন্থ তৈরি করার জন্য নিয়োগ করা হয়- উপন্যাস, ছোট গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা- যা আয়ুর্বেদ, যোগা, ধ্যান, নাচ-গানের মতো পৌরাণিক এবং সাংস্কৃতিক উপাদানকেই ভিত্তি করে নির্মিত— ঐতিহাসিক, সামাজিক-রাজনৈতিক এবং বৈজ্ঞানিক তথ্যগুলিকে মিথ্যা প্রমাণ করে, হিন্দুত্ব প্রকল্পের প্রচারকে আরও জোরদার করে। ভারত থেকে ফ্রান্স, প্রকল্পগুলি সাহিত্য-সাংস্কৃতিক প্রকাশনার মাধ্যমে হিন্দুত্বের প্রচার করে এবং সেগুলি ফরাসি সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলি দ্বারা সমর্থিত এবং অর্থায়িত হয়, যাদের স্পষ্টতই নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে কোনও বক্তব্য নেই। তারা সরাসরি মোদীর সহযোগী কিনা তা ভাবাটাও অস্বাভাবিক নয়।
প্যারিস বইমেলায় সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, বিশেষ করে যখন ভারত অতিথি দেশ ছিল, ভারতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীরা সরকার-অনুমোদিত লেখকদের চাপিয়ে দিয়েছিলেন এবং সন্ত্রাসবিরোধী নিরাপত্তা ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। ফরাসি পক্ষ থেকে, অনেকেই আমাকে নিমন্ত্রণ না করা নিয়ে গর্ব করেছিলেন। ‘আমরা রাজনীতি নয়, সাহিত্য চাই।‘– বলেছিলেন সাংবাদিক ও ‘ভারতজ্ঞানী’ জঁ-ক্লোদ পেরিয়ে। প্রাক্তন ফরাসি প্রেসিডেন্ট, দক্ষিণপন্থী, নিকোলা সারকোজিকে একই মহল তাদের সাংস্কৃতিক ভিলায় বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ করে, গাদ্দাফির সাথে তার জড়িত থাকার খবর প্রকাশের পরেও। দক্ষিণপন্থী সরকার এবং দক্ষিণপন্থী বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক অনুমান করার প্রয়োজন পড়ে না। তাদের উগ্র বাম-বিরোধিতা প্রকট এবং হাস্যকর হয়ে উঠেছে। অসংস্কৃত, অপরিশীলিত সারকোজির আমলে যা গোপন ছিল– মাঁক্রো’র আমলে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যে তার সমালোচনা করার সাহস দেখান, তাকেই তিনি ধ্বংস করতে চান। বিদ্রোহীদের ভয় দেখানো, মুখ বন্ধ করা এবং নির্মূল করার জন্য একটি অনানুষ্ঠানিক বাহিনী নেতার স্বার্থে কাজ করে।
ভারতীয় বংশদ্ভূত ফ্রান্সে বসবাসকারী যুক্তিবাদী, মোদী-বিরোধী, হিন্দুত্ববাদ-বিরোধী, বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব অনেক, আর এই পথও দীর্ঘ !
(ফরাসি অ্যাকাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখিকার জন্ম কলকাতায়, বর্তমানে ফ্রান্সের নাগরিক।)
Comments :0