INSAF RALLY FARMERS AGRI WORKERS

ইনসাফের দাবীতে খেতমজুর, গ্রামীণ সর্বহারার ঠিকানা হবে ব্রিগেড

রাজ্য উত্তর সম্পাদকীয়​

তুষার ঘোষ
 

ডিওয়াইএফআই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির উদ্যোগে গত ৩ নভেম্বর, ২০২৩ কোচবিহার থেকে ইনসাফ যাত্রা শুরু হয়। ২৯১০ কিমি. মূলতঃ পায়ে হেঁটে ২২ টি জেলা অতিক্রম করে ৫০তম দিনে ২২ ডিসেম্বর পদযাত্রী ভাই-বোনেরা হাজির হয় লকাতার যাদবপুর ৮বি, বাস স্ট্যান্ডে। ইনসাফ যাত্রা চলাকালীন বিভিন্ন পেশার, বর্ণের, ধর্মের হাজার হাজার মানুষ যোগ দিয়েছেন। এখনও রাজ্যের গ্রাম-গঞ্জে, হাট-বাজারে, শহর-বন্দরে, ছোট-বড় মিছিল, পদযাত্রা, পথসভা, সমাবেশ চলছে। সভাগুলি থেকে আওয়াজ উঠছে, ন্যায়ের দাবিতে ৭ জানুয়ারি ব্রিগেড চলো। ইনসাফ শব্দ আরবি ভাষা থেকে এসেছে। ইনসাফের অর্থ ন্যায় বিচার/সুবিচার। ইংরেজিতে জাস্টিস। কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারের জনবিরোধী নীতির ফলে খেটে খাওয়া মানুষ কেউই সুবিচার পাচ্ছে না। একদিকে কেন্দ্রের মোদী সরকার, আদানি-আম্বানি সহ দেশি-বিদেশি সর্বভুক রাঘববোয়ালদের তেলা মাথায় তেল দিচ্ছে। রাজ্যে মমতা সরকার চোর-জোচ্চোর, ধান্ধাবাজ, তোলাবাজ নেতা-মন্ত্রীদের তেলা মাথায় তেল ঢালছে। অন্য দিকে দেশে ও রাজ্যে কৃষক, খেতমজুর, অসংগঠিত শ্রমিক যারা সংখ্যায় শতকরা ৭০ ভাগ তাদের একাংশ ঋণের দায়ে আত্মহত্যা করছে। মোদীর শাসনকালে দেশের গ্রামাঞ্চলে ১ লাখের বেশি কৃষক, খেতমজুর এবং মমতার শাসনকালে গ্রামবাংলায় হাজারো কৃষক, খেতমজুর ঋণের দায়ে, মাইক্রোফিনান্সের দাপটে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে।
নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের সাড়ে নয় বছর শাসনে জনগণের উপর আক্রমণের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কর্পোরেট মুনাফা নিশ্চিত করার পাশাপাশি জনগণের অধিকার খর্ব করে সম্পদ লুণ্ঠন প্রচেষ্টা বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৯ সালে শীর্ষে থাকা ১ শতাংশ মানুষের আয় ছিল ৭.৯ লক্ষ কোটি টাকা। ২০২২ সালে সেই আয় ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ১০.২ লক্ষ কোটি টাকা। অপরদিকে তলার দিকে ২৫ শতাংশ মানুষের আয় ১১ শতাংশ কমেছে। ৩.৮ লক্ষ কোটি টাকা থেকে ৩.৪ লক্ষ কোটি টাকা হয়েছে। মোদীর রাজত্বে ২০১৪ থেকে ২০২৩ মে মাস পর্যন্ত গমের দাম ৫৩%, চালের দাম ৪৩%, ডালের দাম ৫৬%, সবজির দাম ৪৩%, দুধের দাম ৪২%, ডিমের দাম ৪৫% বৃদ্ধি পেয়েছে। খাদ্য এবং কৃষি সংস্থার হিসাব অনুযায়ী দেশের ৭৪% মানুষ সুসম খাদ্য পায় না। তারা মানে দেশে ১০০ কোটি মানুষ স্বাস্থ্যকর খাদ্য থেকে বঞ্চিত। একটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, মুম্বাই শহরে একথালি খাবারের দাম ২০১৮-২০২৩ সাল পর্যন্ত ৬৫% বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু শ্রমজীবী মানুষের মজুরি ৩৮% বৃদ্ধি পেয়েছে।
২০২২-২৩ সাল মোদী শাসনের সাড়ে নয় বছরে সর্বোচ্চ বেকারির হার পরিলক্ষিত হচ্ছে। ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে বেকারত্বের হার ছিল ৮.১% এর মধ্যে তরুণদের বেকারত্বের হার ছিল ২৩.২২% আর স্নাতকদের হার ছিল ৪২%।
অস্বাভাবিক পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ফলে সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে চলেছে। ২০১৪- ২০১৫ সালে পেট্রোপণ্যতে কর বসিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার আয় করত ১.২৬ লক্ষ কোটি টাকা। যা ২০২১-২২ সালে বেড়ে হয়েছে ৪.৩২ লক্ষ কোটি টাকা। অর্থাৎ ২৪৩ % দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে ২০১৪ সালে এক ব্যারেল তেলের দাম ছিল ১০৭ ডলার, ২০২৩ সালে মে মাসে কমে হয় ৭৫ ডলার। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ৩০% কমলেও মোদীজী পেট্রোলের দাম বাড়িয়েছেন ৩৫% এবং ডিজেলের দাম ৬০%। ২০১৪ সালে রান্নার গ্যাস পাওয়া যেত ৪১৪ টাকা যা ২০২৩ সালে মে মাসে হয়েছে ১১১৯ টাকা। ৫ রাজ্যের ভোটের জন্য ২০০ টাকা কমানো হয়েছে। ২০১৪ সালের এক লিটার কেরোসিন পাওয়া যেত ১৫ টাকায় এখন তা খোলা বাজারে কিনতে হচ্ছে ১০৫-১৩০ টাকা দরে। রেশন থেকে কেরোসিন তুলে দেওয়া হয়েছে।
গ্রামের মানুষ কাজ চাইলে কাজ পাবে এটাই হচ্ছে মনরেগার আইন। ২ কোটি পরিবার কাজ চেয়ে কাজ পায়নি। শহরে কাজ কমছে, বাধ্য হয়ে শহরে কাজ করতে আসা বহু মানুষ গ্রামে ফিরতে বাধ্য হচ্ছে। এই সময় প্রয়োজন ছিল মনরেগা প্রকল্পে আরও অর্থ বরাদ্দ করা। কিন্তু মোদী সরকার বাজেটে বরাদ্দ করেছে ৬০ হাজার কোটি টাকা। যা আগের বছরে ছিল ৮৯ হাজার কোটি টাকা। কেন্দ্রের গ্রাম উন্নয়ন মন্ত্রক তথ্য থেকে জানা যায় দেশে ১ জানুয়ারি ২০২৪ পর্যন্ত রেগায় নথিভুক্ত শ্রমিক সংখ্যা ২৫ কোটি ৮৯ লক্ষ। আধার বেস পেমেন্ট সিস্টেমের নামে তালিকা থেকে ৬ কোটি ৫২ লক্ষ শ্রমিকের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ জব কার্ডের সাথে আধার লিঙ্ক না থাকার জন্য এই বাদ যাওয়া শ্রমিকরা মজুরি পাবে না। একদিকে ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধি, গ্রাম-শহরে বেকারি এবং অপরদিকে আয় ও সঞ্চয় কমে যাওয়া এই সবেরই অবশ্যম্ভাবী ফল বিশ্বক্ষুধাসূচকে ভারতের স্থান ১২৫টি দেশের ১১১ নম্বর স্থানে। আমাদের প্রতিবেশি বাংলাদেশ ৮১, নেপাল ৬৯, শ্রীলঙ্কা ৬১, পাকিস্থান ১০২ নম্বরে রয়েছে।
রাম মন্দির নির্মাণ, লাভজিহাদ, গোরক্ষা, কাশ্মীর রাজ্য ভেঙে টুকরো করা, সিলেবাসে বেদ, পুরাণ পড়ানো, মুসলিমদের টার্গেট করে বিদ্বেষ ছড়ানো ইত্যাদির মধ্যদিয়ে সব হিন্দুদের এক ছাতার তলায় আনবার চেষ্টা করছে আরএসএস এবং বিজেপি অন্যদিকে জনগণনা এবং জাতভিত্তিক জনসমীক্ষা করতে চাইছে না মোদী সরকার। আসলে জাতভিত্তিক জনসমীক্ষা করলে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলিত, পিছিয়ে পড়া হিন্দু আর্থিকভাবে উচ্চবর্ণদের থেকে শত যোজন পিছিয়ে আছে তা প্রকাশ পেয়ে যাবে। গরিব দলিতরা আর্থিক ও সামাজিকভাবে সামনের সারিতে আসুক, বিজেপি, আরএসএস-এর না পছন্দ। হিন্দুত্বের নাম করে রাজনীতি করছে বিজেপি আর মোদীর শাসনে লাভবান হচ্ছে আদানি সহ কয়েকজন লুঠেরা। ইতিমধ্যে দেশের ১২টি বন্দর, ৬টি বিমান বন্দর, কয়লাখনি সহ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, বিদ্যুতের বিপণন ব্যবস্থা আদানির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। সাধারণ মানুষের রক্ষিত ব্যাঙ্কের বিপুল পরিমাণ লুট করেছে এই রাঘববোয়ালরা মোদীর প্রত্যক্ষ সাহায্যে।
উগ্র হিন্দুত্ববাদী মোদী সরকার গণতন্ত্রকে খতম করবার জন্য হিংস্রতার দাঁত-নখ বের করেছে। সম্প্রতি পার্লামেন্ট ও রাজ্য সভার ১৪৬ জন সদস্যকে সাসপেন্ড করেছে। কৃষক আন্দোলন, এনআরসি বিরোধী আন্দোলন যারা সমর্থন করেছেন তাদের বিনা বিচারে মিথ্যা মামলায় জেলে পুরছে। মণিপুরে আগুন নেভাতে ব্যর্থ। ব্রিটিশ আমলের আইপিসি পরিবর্তনের নামে পুলিশের রাষ্ট্র করবার জন্য আইন সংশোধন করেছে।
রাজ্যজুড়ে তৃণমূলের লুট সন্ত্রাস অব্যাহত। রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী, খাদ্যমন্ত্রী জেলে গেছেন। ২ জন বিধায়ক জেলে। চাল, ধান, রেশন চোর মন্ত্রী এখনও মমতার মন্ত্রীসভায় বহাল রয়েছে। তৃণমূল জানে কোথায় চুরি করার খাপ আছে। বালি চুরি, পাথর চুরি, বর্গা-পাট্টা চুরি, জমির রেকর্ড পরিবর্তনে চুরি, পুকুর ভরাটে চুরি, সমবায়ে চুরি, ১০০ দিনে কাজ ও ঘর নির্মাণে চুরি, গাড়ি পার্কিং-এ চুরি, চাকরিতে চুরি সব ক্ষেত্রেই মমতার দল সোনার মেডেল পাবার ক্ষেত্রে উপযুক্ত।
রাজ্যে কাজ নেই। ১ কোটিরও বেশি মানুষ কাজের সন্ধানে ভিন রাজ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। গত তিন মাসে বাংলার শতাধিক পরিযায়ী শ্রমিক ভিন রাজ্যে কর্মক্ষেত্রে মৃত্যু হয়েছে। চুরির জন্য ১০০ দিনের কাজ ২ বছর বন্ধ। ১১ লক্ষ গরিব মানুষ ২ বছরের বেশি সময় ধরে গৃহনির্মাণের টাকা পাচ্ছে না। প্রায় ৩ বছরেরও বেশি সময় ধরে কলকাতার রাজপথে ধরনায় বসে আছে ন্যায্য চাকরি পাওয়া থেকে বঞ্চিত যুবক-যুবতীরা।
মমতার আমলে প্রতিবছর বিশ্ববঙ্গ শিল্প সম্মেলনের নামে মিথ্যাচার চলছে। মমতার ঘোষণা, ২০১৫-২২ পর্যন্ত সম্মেলনে বিনিয়োগের মোট ১৭,৮৪,৩২৯ কোটি ২৯ লক্ষ টাকার প্রস্তাব এসেছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রক-এর হিসাব অনুযায়ী বিনিয়োগের প্রস্তাব এসেছে মাত্র ৫৭,১২৩ কোটি টাকা।
মমতার সময়কালে ধান চাষ কমছে। জমির চরিত্র দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। ভবিষ্যতে রাজ্য খাদ্য ঘাটতির দিকে যাচ্ছে। ফড়ে ও তোলাবাজদের দাপটে গরিব, মাঝারি কৃষক জলের দরে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। সমবায় থেকে কৃষক, খেতমজুরদের ঋণ পাবার পথ বন্ধ। বাংলাজুড়ে মাইক্রোফিনান্সের দাপাদাপি। খেতমজুররা বছরে গড়ে ৪৫ দিনের বেশি কাজ পাচ্ছে না। কেরালা কৃষি মজুরদের দৈনিক মজুরি ৭৫০ টাকা অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে ৩০২ টাকা তাও সর্বত্র ন্যূনতম মজুরি জোটে না। একদিকে উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ও জাতিবিদ্বেষ ছড়িয়ে দেবার কাজ করছে বিজেপি। ওরা রাম মন্দির গড়ছে আর অন্যদিকে মমতা জগন্নাথ মন্দির গড়ে তুলছেন সরকারি টাকায়। ধর্মকে রাজনীতির ময়দানে নামাবার প্রতিযোগিতা চালাচ্ছে বিজেপি এবং তৃণমূল। বিজেপি গীতাপাঠ করলে তৃণমূল করছে পাল্টা চণ্ডীপাঠ। উদ্দেশ্য ভোট।
সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়ন ১০০ দিনের কাজ চালু করা, বকেয়া মজুরি পরিশোধের দাবিতে ধারাবাহিক প্রচার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন জেলায় কাজ পাবার দাবিতে ৪ ক ফরম পূরণ করে কিছু ক্ষেত্রে দাবি আদায় করা সম্ভব হয়েছে। বেশ কিছু জেলায় লাগাতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মজুরি বৃদ্ধি সম্ভব হয়েছে। ১০০ দিনের কাজ চালু করার দাবিতে ১ জুন ২০২৩- ৫০০টির বেশি গ্রাম পঞ্চায়েতে রাত জেগে অবস্হান হয়েছে। ২৫ আগস্ট কলকাতায় বিরাট খেতমজুর সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। কৃষক আন্দোলনকে স্মরণ করে গত ২৮ নভেম্বর কোলকাতার বুকে হাজারো শ্রমিক, কৃষক খেতমজুর সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। আগামী ১৮-২৫ জানুয়ারি রাজ্য জুড়ে ১০০দিনের কাজ চালু করার দাবিতে ধরনা, অবস্থান, হাটে গঞ্জে মিছিলের ডাক দেওয়া হয়েছে।
যুবদের এই যাত্রা পথে প্রচারে তারা শুধু যুবদের জীবন যন্ত্রণার কথা তুলে ধরেনি, তারা শ্রমিক, কৃষক, খেতমজুর, ছাত্র, যুব, মহিলা, সরকারি কর্মচারী সহ সব অংশের মেহনতি মানুষের জীবন জীবিকার কথা তুলে ধরেছে। প্রচারে এসেছে ১০০ দিনের কাজ, মজুরি, চা শ্রমিকদের জীবনযন্ত্রণার কথা। এসেছে গঙ্গা ভাঙন রোধ, নারী নির্যাতন, স্কুল বন্ধ, সম কাজে সম মজুরির দাবি, স্লোগানে উঠেছে চোর মুক্ত বাংলা গড়ার ডাক। আওয়াজ উঠেছে রাম-রহিমের ঐক্যবদ্ধ থাকবার আহ্বান।
ন্যায় বিচারের দাবিকে প্রচারের তুঙ্গে তুলে আগামী ৭ জানুয়ারি কলকাতায় প্রতিবাদী মানুষের জনস্রোত দেখবে কলকাতা। সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়নের হাজার হাজার কর্মী যোগ দেবে ব্রিগেড ময়দানের সমাবেশে। ইনসাফ যাত্রা হচ্ছে সব অংশের মানুষের জীবনযন্ত্রণার উন্নত প্রচার। ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের মধ্যদিয়ে ইনসাফ যাত্রার দাবিগুলি আদায় করতে হবে। ভারতের কৃষক আন্দোলন দাবি আদায় করতে পেরেছে। ঐক্যবদ্ধ শ্রমজীবী জনতা তাদের দাবি আদায় করতে পারবে এই প্রত্যয় নিয়ে চলমান লড়াই বজায় রাখতে হবে।

Comments :0

Login to leave a comment