চোর-দুর্নীতিগ্রস্তদের যদি আদালত সাজা দেয় তাহলে সেই চোরদের চোখে আদালত হয়ে ওঠে ঘোরতর শত্রু। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই কলকাতা হাইকোর্টের বিরুদ্ধে লাগাতার আক্রমণ করে চলেছে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল। মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর ভাইপো সাংসদ তো সরাসরি আদালত অবমাননা করে বিচার ব্যবস্থা এবং বিচারপতিদের বিরুদ্ধে হুঙ্কার দিচ্ছেন। তাদের ক্রোধের প্রধান কারণ বিচারপতিরা কেন তাদের চুরি দুর্নীতি আড়ালে ইতিবাচক ভূমিকা নিচ্ছেন না। বিচার ব্যবস্থা বা বিচারপতিদের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানিয়ে যখন কাজ হাসিল হচ্ছে না তখন প্রায় সব দুর্নীতির মামলায় অপরাধীদের বাঁচাতে কলকাতা হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাজ্য সরকার দৌড়াচ্ছে সুপ্রিম কোর্টে। দেশের আর কোনও রাজ্য থেকে কোনও সরকার চোর-অপরাধীদের বাঁচাতে এভাবে গুচ্ছ গুচ্ছ মামলায় হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে যাবার নজির নেই। তৃণমূল সরকারের অবস্থানই হয়ে দাঁড়িয়েছে অপরাধীদের সাজাদান নয়, বরং তাদের সুরক্ষা দেওয়া এবং দুর্নীতি অনিয়মকে বৈধতা দেওয়া। রাজ্য সরকারের দুর্নীতি-অনিয়ম ব্যর্থতা অপদার্থতা থেকে নেতা-মন্ত্রীদের বাঁচাতে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে নিয়ে কত শত কোটি জনগণের করের টাকা ধ্বংস করেছে তার হিসাব চাওয়ার সময় এসেছে। এভাবে তৃণমূলে চোর-তোলাবাজ নেতা-মন্ত্রীদের জেলযাত্রা ঠেকাতে কেন দু’হাতে সরকারি টাকা খরচ করা হচ্ছে তার জবাব দিতে হবে।
রাজ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগ দুর্নীতির যে বহর এখন পর্যন্ত উন্মোচিত হয়েছে তাতে স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এটাই এরাজ্যের বৃহত্তম ও ভয়ঙ্করতম দুর্নীতি। এছাড়া রেশন কেলেঙ্কারি সহ বাকি দুর্নীতিগুলি যোগ করলে গত ১৩ বছরে যে দুর্নীতি হয়েছে তা অতীতের মোট দুর্নীতির শতগুণ ছাড়িয়ে যাবে। অতীতে দুর্নীতির পক্ষে সরকারগুলি সাধারণত নির্লজ্জ বেহায়ার মতো সওয়াল করত না। কিন্তু সরকার তা করছে? আগে দুর্নীতি হয়েছে প্রধানত ভুলবশত বা নজরদারির অভাবে। এখন আগে থেকে পরিকল্পনা করে আটঘাট বেঁধে দুর্নীতি করা হয়। তাই দুর্নীতির পক্ষেই সরকার অবস্থান নেই। দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাজ্যের কার্যত কোনও পদক্ষেপ নেই। অভিযোগ এলে সেটাকে আড়াল করা বা চাপা দেওয়াই প্রধান কাজ হয় পুলিশের। সরকারি পদাধিকারীদের কাজ হয় প্রমাণ লোপাট করা। এপর্যন্ত তৃণমূল সরকারের আমলের যত দুর্নীতি প্রকাশ্যে এসেছে তার একটাও রাজ্য পুলিশের উদ্যোগে আসেনি। সবকটিই এসেছে আদালতের নির্দেশে কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থার তদন্তে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আদালতের নজরদারিতে হয়েছে এবং হচ্ছে সেসব তদন্ত।
শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগ দুর্নীতি সহ অন্যান্য দুর্নীতিতে আজ পর্যন্ত যতগুলি গুরুত্বপূর্ণ রায় দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট তার প্রায় সবকটির বিরুদ্ধেই সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছে রাজ্য সরকার। সর্বশেষ ২৬ হাজার শিক্ষকের নিয়োগ বাতিলের বিরুদ্ধে যেমন রাজ্য সুপ্রিম কোর্টে গেছে তেমনি সন্দেশখালি শাহজাহানকে রক্ষা করতেও হাইকোর্টের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে গেছে রাজ্য সরকার। কিন্তু সুবিধার বদলে অস্বস্তিই মিলেছে। অতীতেও ডজন ডজন মামলায় সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে লক্ষ কোটি টাকা উড়িয়ে অশ্বডিম্ব নিয়েই ফিরতে হয়েছে। নিয়োগ বাতিলের রায়ে সুপ্রিম কোর্টে স্থগিতাদেশ মেলেনি। তেমনি সন্দেশখালি মামলায়ও কলকাতার রায়ই বহাল রাখা হয়েছে। কেবল সাতদিনের স্বস্তি মিলেছে রাজ্যের মন্ত্রীদের ভোটের মধ্যে জেলে যাওয়া ঠেকানোর কাতর আবেদনে।
মুখ্যমন্ত্রী প্রতিদিন নিয়োগ বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে হুঙ্কার দিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর মতে চুরি-দুর্নীতি যেভাবেই হোক চাকরি যখন দেওয়া হয়েছে বাতিল করা যাবে না। দুর্নীতিকে বৈধতা দিতে হবে। তার সরকারের চৌর্যবৃত্তিকে স্বীকৃতি দিতে হবে। কেন ওএমআর শিট নষ্ট করা হয়েছে, কেন ইন্টারভিউর নম্বর সংরক্ষণ করা হয়নি, কেন সাদা খাতা জমা দিয়ে চাকরি মিলেছে, কেন র্যা ঙ্কিংয়ের উপরের দিকেদের বাদ দিয়ে নিচেরদের চাকরি দেওয়া হয়েছে, কেন মেয়াদ শেষেও চাকরি দেওয়া হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর মতে এসব প্রশ্ন তোলা যাবে না। ৭৫-২৫ ভাগের ফরমুলায় যে লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে অযোগ্যদের যে চাকরি দেওয়া হয়েছে মুখ্যমন্ত্রী চান তা বহাল থাকুক। তাই চূড়ান্ত বেআইনি পথে সুপারনিউমারি পদ তৈরি করেছে মন্ত্রীসভা। ফলে গোটা মন্ত্রীসভাটাই জেলে যাবার উপক্রম। এই অবস্থায় নেত্রীর মস্তিষ্ক সুস্থ থাকতে পারে কি?
Mamata Banerjee
সপারিষদ মুখ্যমন্ত্রী কি জেলের পথে
×
Comments :0