Manipur Violence

আরও ৬ দেহ উদ্ধারকে ঘিরে উত্তাল মণিপুর

জাতীয়

রাজধানী ইম্ফল শহরে হিংসার আগুনে জ্বলছে এক মন্ত্রীর গাড়ি।

 

বিশ্বজিৎ দাস: গুয়াহাটি 

যেদিকে চোখ যায়, শুধু আগুন আর আগুন। দাউ দাউ করে জ্বলছে বাড়ি, গাড়ি, দোকানপাট। মন্ত্রী-বিধায়কদের বাড়ি জ্বলছে। শনিবার দুপুর থেকে মণিপুরের রাজধানী শহর ইম্ফল যেন অগ্নিকুণ্ড। শনিবার জিরিবামে নিখোঁজ ছয়জনের দেহ (তিনজন শিশু ও তিনজন মহিলা) উদ্ধারের পর রাজ্যের পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। জেলায় জেলায় হিংসা ছড়িয়ে পড়েছে। হিংসা থেকে বাঁচতে পারছেন না কঠোর নিরাপত্তা বলয়ে থাকা মন্ত্রী-বিধায়করাও। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং নিজের সরকারি বাসভবন ছেড়ে গোপন স্থানে চলে গিয়েছেন বলে খবর। মন্ত্রী-বিধায়করাও ইম্ফল ছেড়ে পালিয়েছেন। জনরোষে পড়ে বিজেপি’র ১৯ বিধায়ক রবিবার সকালে ইস্তফা দেবেন বলে ঘোষণা করেছেন। তাঁরা ইস্তফা দিলে বীরেন সিং সরকার ভেঙে পড়া নিশ্চিত। বিজেপি সূত্রে খবর, সরকার ভেঙে পড়লে যাতে বিরোধীরা এই সুযোগে ক্ষমতায় আসতে না পারে, সেজন্য রবিবার সকালেই মণিপুরে ছয় মাসের জন্য রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করতে পারে কেন্দ্র।

এদিকে, মণিপুরের পরিস্থিতি বেগতিক বুঝেই এদিন দুপুরে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে জরুরি বার্তা পাঠিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। সেই বার্তায় রাজ্যে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সমস্ত নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যারা হিংসায় মদত জোগাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে কড়া, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণেরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বার্তায়। এরি সঙ্গে মণিপুরবাসীর প্রতি শান্তি বজায় রাখার আহ্বান জানিয়ে কোনওরকম গুজবে কান না দেওয়ার কতাও বলা হয়েছে। এরই সঙ্গে গত বৃহস্পতিবার মণিপুরের পাঁচ জেলার ছয় থানায় ফের আফস্পা লাঘু করা হয়েছে কেন্দ্রের তরফে। তবে আফস্পা লাঘুতে হিতে বিপরীত হয়েছে। উলটে আগুনে ঘৃতাহুতি হয়েছে। এর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার হয়েছেন রাজ্যের সংখ্যাগুরু মেইতেইরা। উপজাতি কুকিদের সমর্থন আগেই খুইয়েছে বিজেপি। এবার মেইতেইদের সমর্থনও হাতছাড়া হতে চলেছে।




 

গত সোমবার সিআরপিএফ’র ভুয়ো সংঘর্ষে ১১ কুকি যুবক নিহত হওয়ার দিন জিরিবামের বেরাবকারায় একটি আশ্রয় শিবির থেকে আটজন নিখোঁজ হয়ে যান। পরদিন সকালে দুই বৃদ্ধের ক্ষতবিক্ষত দেহ উদ্ধার হয়। কিন্তু নিখোঁজ ছিলেন তাঁদের সঙ্গে থাকা ইউরেমবাম রানি দেবী (৬০), তাঁর পুত্রবধূ টেলাম থৌবি দেবী (৩১), নাতনি টেলাম থাজামাম্বি দেবী (৮), ইউরেমবামের মেয়ে লাইসরাম হেইতম্বি দেবী (২৫), হেইতম্বির ছেলে চিঙখেইগান্বা সিং (আড়াই বছর) ও লাঙাম্বা সিং (আট মাস)। এঁরা সকলেই মেইতেই জনগোষ্ঠীর। নিখোঁজদের অক্ষত অবস্থায় উদ্ধারের দাবিতে মেইতেই নিবিড় জেলাগুলিতে লাগাতার বন্‌ধ, বিক্ষোভ চলতে থাকে গত কয়েকদিন। শুক্রবার রাতে বরাক নদীতে যেখানে জিরি নদী এসে মিশেছে, সেখানে তিনটি দেহ ভেসে উঠে। এরমধ্যে একজন বৃদ্ধা ও দু’টি শিশুর দেহ ছিল। তখনই সন্দেহ হয় দেহগুলি নিখোঁজদের। দেহগুলি রাতেই কড়া পাহারায় আসামের কাছাড় জেলার শিলচর মেডিক্যালের মর্গে পাঠানো হয়। এদিন আরও তিনটি দেহ একই স্থানে ভেসে উঠে। প্রতিটি দেহে রডের আঘাত রয়েছে। দুই মহিলার দেহ পুরোপুরি নগ্ন ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, মহিলাদের ধর্ষণের পর খুন করা হয়েছে। 

এই দেহগুলি উদ্ধারের পর মানুষের ক্ষোভ আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে। জিরিবাম শহরে কারফিউ ভেঙে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে পড়েন। তাঁদের আটকাতে গেলে পুলিশের উপর আক্রমণ শুরু হয়। ইম্ফল শহরে ধুন্ধুমার কাণ্ড শুরু হয়। কয়েক হাজার মানুষ ইম্ফল শহর ঘিরে ফেলেন। তাঁরা ইম্ফলে থাকা মন্ত্রী বিধায়কদের বাড়ি ঘেরাও করেন। এরমধ্যে সাত বিধায়ক ও দুই মন্ত্রীর বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেন উন্মত্ত জনতা। প্রথমে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংয়ের মেয়ের জামাই বিধায়ক আর কে ইমো সিংয়ের বাড়িতে। তাঁর বাড়ির সামনে থাকা গাড়িগুলিও পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এরপর একে একে বিধায়ক সাপাম কুঞ্জকেশ্বর, সাপাম নিশিকান্ত, শেখ নুরুল হাসান, থাঙজাম অরুণ কুমার, করণ শ্যাম, রঘুমনি সিং মন্ত্রী সুশিন্দ্র সিং ও সাপাম রঞ্জন সিংয়ের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এই আগুন ছড়িয়ে পরে সাধারণ মানুষের বাড়ি, দোকানপাটে। বিদ্রোহী জনতার মিছিল দেখে পরিবারের লোকদের নিয়ে আগেভাগেই বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান মন্ত্রী, বিধায়করা। তাঁদের নিরাপত্তা রক্ষীরাও যে যেদিকে পারেন পালিয়ে যান। মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি আবাস আক্রান্ত হতে পারে টের পেয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে গোপন স্থানে নিয়ে যান নিরাপত্তা রক্ষীরা। তবে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে ও মহাকরণের সামনের ব্যারিকেড ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় জনতা। সন্ধ্যার মধ্যে অন্তত ত্রিশ থেকে চল্লিশটি বাড়ি ও দোকান পু্ড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে। একশোটির বেশি গাড়ি পুরে ছারখার হয়েছে। উন্মত্ত জনতাকে রুখতে কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়ে পুলিশ, লাঠিচার্জও করে। কিন্তু বিক্ষুব্ধ জনতাকে আটকাতে ব্যর্থ হয় পুলিশ। পরিস্থিতি বিপজ্জনক মোড় নিচ্ছে বুঝতে পেরে বিকাল পাঁচটায় নতুন করে রাজধানী ইম্ফল সহ সাতটি জেলায় অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করে প্রশাসন। এছাড়া, সাতটি জেলায় দু’দিনের জন্য ইন্টারনেট ও মোবাইল পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়। 

বিভিন্ন জেলায় বিজেপি’র মন্ত্রী বিধায়কদের ঘেরাও করে বিক্ষুব্ধ জনতা। জনতার রোষের মুখে পড়ে একের পর এক বিধায়ক ও মন্ত্রী ইস্তফা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। প্রথমে ইস্তফা দেবেন বলে সংবাদমাধ্যমকে জানান বীরেন সিং ঘনিষ্ঠ বিধায়ক রবীন্দ্র সিং, রাধেশ্যাম সিং, পাওনাম ব্রজেন, করণ শ্যাম। পরে আরও কয়েকজন ইস্তফার কথা ঘোষণা করেছেন। এরমধ্যে পাঁচ জন মন্ত্রী ও বিধানসভার অধ্যক্ষও রয়েছেন। রবিবার সকালে তাঁরা ইস্তফাপত্র রাজ্যপাল ও বিধানসভার অধ্যক্ষের কাছে পাঠাবেন বলে জানিয়েছেন। এঁরা সকলেই মেইতেই জনগোষ্ঠীর বিজেপি’র বিধায়ক। বিজেপি’র শরিক এনপিপি সরকারের থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা করেছে। তাদের পাঁচজন বিধায়ক রয়েছেন। শরিকদের সমর্থন প্রত্যাহারের ঘোষণা ও বিজেপি’র অর্ধেক বিধায়কের ইস্তফা দেওয়ার ঘোষণায় বীরেন সিং সরকার পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ফলে মণিপুরের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও দ্রুত পালটাতে শুরু করেছে। রবিবার সকালের মধ্যেই অনেক পটপরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে বলে ওয়াকিবহাল মহল মনে করছে। 

এদিকে, সিআরপিএফ’র গুলিতে নিহত কুকি যুবকদের দেহ শিলচর মেডিক্যালে ময়নাতদন্তের পরও নিকটাত্মীয়র হাতে তুলে দেয়নি মণিপুর ও আসাম পুলিশ। বরং এদিন দুপুরে সেনা বাহিনীর হেলিকপ্টারে করে দেহগুলি মণিপুরে চুরাচাঁদপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে দেহ বুঝে নেন নিকটাত্মীয়রা। দেহ হস্তান্তর করা নিয়ে শনিবার ফের উত্তপ্ত হয়ে উঠে শিলচর মেডিক্যাল চত্বর। একসময় নিহতদের নিকটাত্মীয়রা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন। একাংশ পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোঁড়েন। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন পুলিশের বড়কর্তারা। তাঁরা বিক্ষুব্ধদের সামাল দেন। চুরাচাঁদপুরে দেহগুলি পৌঁছানোর পর হৃদয়বিদারক পরিবেশ সৃষ্টি হয়। সেখানে কয়েক হাজার মানুষ জমায়েত হয়েছেন। রবিবার দেহ নিয়ে মিছিল হতে পারে। 

অন্যদিকে, শিশু সহ ছয় নিখোঁজের ক্ষতবিক্ষত দেহ শিলচর মেডিক্যালে পাঠানো হয়েছে। এখানেও প্রায় হাজার খানেক মেইতেই জনতা জমায়েত হয়েছেন। তবে শনিবার দেহগুলির ময়নাতদন্ত হয়নি। রবিবার হতে পারে। এই দেহগুলিও মণিপুর নিয়ে যেতে দিতে চাইছে না পুলিশ। কারণ দেহ পৌঁছলেই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়বে। যা সামাল দেওয়া পুলিশের পক্ষে কঠিন হবে। 

 

Comments :0

Login to leave a comment