প্রভাত পট্টনায়ক
এমন ছাড়কে দীপাবলীর ‘উপহার’ বলা নিশ্চিতভাবেই এক বিকৃত সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতার পরিচয়। কর মানুষ দিয়েই থাকে; কর রাজস্ব, মানুষের দেওয়া অর্থ থেকে আসে। মানুষের দেওয়া কর রাজস্ব হ্রাসকে সরকারের কাছ থেকে একটি ‘উপহার’ বলে অভিহিত করা, রাজস্ব যেন সরকারের ব্যক্তিগত আয়, যুক্তির একটি উল্টো রূপ।
স্বাধীনতা দিবসে নরেন্দ্র মোদীর ভাষণ প্রত্যাশিতভাবেই মিথ্যায় পরিপূর্ণ ছিল। উদাহরণস্বরূপ, তিনি বিজেপি শাসনের বছরগুলিতে উড়পাদন খাতে ভারতের অগ্রগতির কথা বলেছেন, অথচ বাস্তবতা হলো গত দশ বছরে জিডিপিতে উৎপাদন খাতের অংশ ১৭.৫ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ১২.৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা সর্বশেষ ১৯৬০ সালের পর সর্বনিম্ন। এই ধরনের পতনই অর্থনীতিবিদদের ভাষায় একে ডি-ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন বা বি-শিল্পায়ন বলা হয়। অবস্থা; এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বৈশিষ্ট্যই হলো যে তিনি একটি ‘বি-শিল্পায়নের’ প্রক্রিয়াকেই দেশের শিল্পক্ষেত্রে একটি ‘বিশাল অগ্রগতি’ হিসাবে চালিয়ে দিচ্ছেন!
একইভাবে, স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে বিশেষত আরএসএস’র প্রশংসা করাও সত্যের অপলাপ এবং বিকৃতি। এটি সর্বজনবিদিত যে আরএসএস শুধু স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেয়নি তাই নয়, বরং এদের তৎকালীন নেতা এমএস গোলওয়ালকার স্বাধীনতার পরেও ধারণা ব্যক্ত করেছিলেন যে, এই দেশ নিজে তার কাজকর্ম পরিচালনা করতে পারবে না এবং প্রশাসন চালানোর জন্য ব্রিটিশদেরই আবার আমন্ত্রণ জানাতে হবে (রাম পুনিয়ানি এই বিষয়ে লিখেছেন)।
যাইহোক, আমরা তার প্রধান অর্থনৈতিক ঘোষণাটির দিকে নজর দিই, যা গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স (GST) সংক্রান্ত ছাড়ের বিষয়ে ছিল। তিনি দুটি জিএসটি স্ল্যাব করের ধাপ ১২ শতাংশ এবং ২৮ শতাংশ বাতিল করার কথা ঘোষণা করেন। এখন ১২ শতাংশ জিএসটি’র পরিবর্তে সেই সকল পণ্য ও পরিষেবার উপর ৫ শতাংশ কর ধার্য করা হবে, এবং যেগুলো এখন ২৮ শতাংশ করের আওতায় পড়ে, সেগুলোর উপর ১৮ শতাংশ হারে কর ধার্য করা হবে।
এমন ছাড়কে দীপাবলীর ‘উপহার’ বলা নিশ্চিতভাবেই এক বিকৃত সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতার পরিচয়। কর মানুষ দিয়েই থাকে; কর রাজস্ব মানুষের টাকা থেকে আসে। মানুষের দেওয়া কর রাজস্ব হ্রাসকে সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া একটি ‘উপহার’ বলে অভিহিত করার অর্থ, যেন সরকারের রাজস্ব তার ব্যক্তিগত আয়। এটা যুক্তির একটি উল্টো রূপ, এটা ফরাসি বুরবোঁ রাজা চতুর্দশ লুই-এর মন্তব্য “L’ État, c’est Moi” বা ‘রাষ্ট্র, সেটাই আমি’ -এর মতোই। তবে এই ধরনের উল্টো যুক্তি আমরা এনডিএ সরকারের কাছ থেকে আশা করাটাই স্বাভাবিক। এদের কিছু বড় নেতা এর আগে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে ‘মোদীজির সেনা’ বলেও উল্লেখ করেছেন।
প্রস্তাবিত ‘উপহার’-টির সম্পূর্ণ পরিমাণ এবং বিষটি দেখে নেওয়া যাক। মনে করা হচ্ছে, বর্তমানে ২৮ শতাংশ জিএসটি থেকে যে পরিমাণ রাজস্ব পাওয়া যায় তা মোট জিএসটি রাজস্বের মাত্র ১১ শতাংশ (দ্য হিন্দু, ১৬ আগস্ট)। এই হার ১৮ শতাংশ হলে (যুক্তিসঙ্গতভাবে একই ভিত্তি ধরে, অর্থাৎ একই মূল্য সংযোজন যার উপর জিএসটি ধার্য করা হয়) এই রাজস্বের ১০ শতাংশ ক্ষতি হবে, অর্থাৎ মোট জিএসটি রাজস্বের ১.১ শতাংশ ক্ষতি হবে। একইভাবে, ১২ শতাংশ জিএসটি আদায় হয় যে পণ্যগুলো থেকে, তাতে মোট জিএসটি রাজস্বের ৫ শতাংশ আসে। এই হার ৫ শতাংশে নামলে এই রাজস্বের ৭ শতাংশ ক্ষতি হবে, অর্থাৎ মোট জিএসটি সংগ্রহে ০.৩৫ শতাংশ ক্ষতি হবে। সুতরাং, দুটি ছাড় মিলে মোট জিএসটি রাজস্বের ১.৪৫ শতাংশ ক্ষতি হবে, এবং এর ফলে জনসাধারণের কাছে মোট জিএসটি রাজস্বের ১.৪৫ শতাংশ হস্তান্তিত হবে। যেহেতু ২০২৪-২৫ সালে মোট জিএসটি রাজস্ব ছিল ২২.০৮ লক্ষ কোটি টাকা, তাই মোদীর ঘোষিত কর ছাড়ের মাধ্যমে জনসাধারণের কাছে মোট হস্তান্তরিত অর্থ হবে বর্তমানে ৩২,০১৬ কোটি টাকা, বা ২০২৪-২৫ সালের সরকারি আনুমানিক জিডিপি’র মাত্র ০.০৯৬৭ শতাংশ; আমরা গড়পড়তা অঙ্কের হিসাবে একে ০.১ শতাংশ ধরতে পারি।
স্বাভাবিকভাবেই সরকারি সূত্রগুলো জনগণের কাছে এই ‘উপহার’-এর মাধ্যমে সমগ্র অর্থনীতির উপর যে প্রসারণশীল প্রভাব পড়বে, তা তুলে ধরতেই ব্যস্ত। কিন্তু এর প্রকৃত প্রসারণশীল প্রভাব নির্ভর করবে এই ‘উপহার’ কীভাবে অর্থায়ন করা হচ্ছে তার উপর। যদি জনগণের দেওয়া কর ছাড়ের সাথে সঙ্গতি রেখে সরকারি ব্যয়ে সমপরিমাণ হ্রাস করা হয়, যাতে রাজস্ব ঘাটতি না বাড়ে, তাহলে এই ধরনের ছাড়ের প্রসারণশীল প্রভাব সরকারি ব্যয় হ্রাসের সঙ্কোচনশীল প্রভাব দ্বারা বাতিল হয়ে যাবে। ফলে সামগ্রিকভাবে মোট প্রসারণশীল প্রভাব হবে শূন্য। এর মানে, যদি সরকারি ব্যয় শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং এরকম অন্যান্য কার্যক্রমে কাটছাঁট করা হয়, তাহলে মানুষের জন্য কর ছাড়ের সম্ভাব্য কল্যাণ বৃদ্ধিকারী প্রভাব একেবারেই বাতিল হয়ে যাবে। তাহলে কর ছাড়টি বৃদ্ধিবর্ধকও নয়, এবং অ-কল্যাণবর্ধক প্রমাণিত হবে।
কিন্তু ধরা যাক, মোদীর ঘোষিত কর ছাড়ের সাথে সঙ্গতি রেখে সরকারি ব্যয়ে কোনও কাটছাঁট করা হলো না, এবং এই ছাড়গুলো শুধুমাত্র রাজস্ব ঘাটতি বৃদ্ধি করছে। এমনকি যদি আমরা একটি "গুণক (multiplier)" মান ২ ধরে নেই, যা মোটেও অযৌক্তিক নয় কারণ এই ছাড়গুলো নির্দিষ্টভাবে দরিদ্রতম বা গ্রামীণ জনগণকে (যাদের ক্ষেত্রে উচ্চতর গুণক মান আশা করা যেতে পারত) নয়, বরং সাধারণ জনগণের জন্য দেওয়া হচ্ছে, তাহলে এগুলো আমাদের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির* হারে মাত্র ০.২% যোগ করবে, যা একটি অত্যন্ত নগণ্য পরিমাণ। শুধুমাত্র সেই সরকারই নিজের এই কাজকে অতিরঞ্জিতভাবে বর্ণনা করতে পারে, যারা জিডিপি’র ০.১% এর মতো একটি নগণ্য কর ছাড়কে ‘দীপাবলির উপহার’ হিসাবে দাবি করে, যা নিয়ে কথা বলার কোনও অর্থই নেই।
যদি সরকার সত্যিই অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে চাইত, তবে তাকে শুরুতেই সরকারি ব্যয় অনেক বেশি পরিমাণে বাড়াতে হতো। যেমন, সরকারি শিক্ষা ও স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের শূন্যপদে যোগ্য ও প্রশিক্ষিত কর্মী নিয়োগ করা (শাসকগোষ্ঠীর অনুগত পোষা লোক নয়)। আর এই ব্যয় মেটাতে তাকে সম্পদ কর (wealth tax) ও উত্তরাধিকার কর (inheritance tax) আরোপ করতে হতো।
এখন বলা হচ্ছে, দেশে সম্পদ-বৈষম্য আগের অনুমানের চেয়ে অনেক বেশি। আগে অনুমান করা হয়েছিল, দেশের মোট সম্পদের প্রায় ৪০ শতাংশ রয়েছে জনসংখ্যার শীর্ষ ১ শতাংশের হাতে; কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ ব্যবস্থাপনা (Wealth Management) প্রতিষ্ঠান বার্নস্টেইন-এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতে এই শীর্ষ ১ শতাংশ জনগোষ্ঠীর হাতে রয়েছে দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ সম্পদ। সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন হতে পারে, কিন্তু সঠিক সংখ্যা যাই হোক না কেন, এটি শুধু বিশ্বের সর্বোচ্চ বৈষম্যযুক্ত দেশগুলির মধ্যে একটি নয়, বরং দেশে সম্পদের বৈষম্য আরও বাড়ছে।
অতএব অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার পরিকল্পনা এমন হওবা উচিত ছিল, যা একসাথে এই ভয়াবহ সম্পদ-বৈষম্যকেও আক্রমণ করতে পারতো, যেহেতু এটা গণতান্ত্রিক সমাজের চেতনার সম্পূর্ণ বিরোধী আবার পুনর্জাগরণ নীতির ঘোষণার উপলক্ষও হতে পারতো স্বাধীনতা দিবসের ভাষণটি। কিন্তু মোদী সরকার তা করার কোনও চেষ্টা করেনি; তারা অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে বা এমনকি জনগণকে স্বস্তি দিতে সামান্যই কিছু করেছে, কিন্তু বাগাড়ম্বরপূর্ণভাবে এটাকেই ‘দীপাবলির উপহার’ বলেছে! কিন্তু যে সরকার কোনও কার্যকর পদক্ষেপ নেওবার চেয়ে তার জনসংযোগকে বা আত্মপ্রচারকেই অগ্রাধিকার দেয়, তার কাছ থেকে আর কী-ই বা আশা করা যায়।
সম্প্রতি আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত স্বীকার করেছেন যে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য এতটাই বাণিজ্যিক হয়ে উঠেছে, এবং যার ফলে এতটাই ব্যয়বহুল হয়েছে, যে সেগুলো এখন সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে— আগের মতো আর সহজলভ্য নেই। এই গুরুত্বপূর্ণ স্বীকারোক্তি যা পরোক্ষভাবে এই দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করে যে এই গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলো সরকারের প্রাথমিক দায়িত্ব হওবা উচিত, নয়া উদারবাদী অর্থনৈতিক নীতিতে সেগুলোকে বেসরকারিকরণ করার পরিবর্তে।
কিন্তু ভাগবতের এই স্বীকারোক্তি কেবলমাত্র সত্যের একাংশ মাত্র। অন্য অংশটি হচ্ছে, তাঁর শিবিরের লোকজন সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করেছে। আরএসএস ঘনিষ্ঠ ছাত্র সংগঠনের দুষ্কৃতীরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে কোনও মুক্ত আলোচনার পথ বন্ধ করে দেয়; অযোগ্য লোকজনকে বা প্রয়োজনীয় সর্বনিম্ন যোগ্যতাও নেই এমন ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া হয় শিক্ষকের পদে; আর নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীর পরিবর্তে রাজ্যপালরা (যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যের ভূমিকা পালন করেন) আরএসএস অনুগত ব্যক্তিদের প্রশাসনিক প্রধান হিসাবে বসাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলির গুণগত মানকে এভাবে ইচ্ছাকৃত ধ্বংস করা হলে, কোনও সাধারণ নাগরিক কেন তার সন্তানদের এমন প্রতিষ্ঠানে পাঠাবে, যদি তাদের আর্থিক সামর্থ্য থাকে তবুও? অর্থাৎ, সরকারি শিক্ষা ও স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলো কেবল অর্থের ঘাটতিই নয় (যা নয়া উদারনীতিতে প্রত্যাশিত), বরং বরং মানের ইচ্ছাকৃত ধ্বংসেরও শিকার হচ্ছে (যা ভাগবতের নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিবাদী সাংগঠনিক শক্তিগুলির অবদান)।
ফলস্বরূপ, শিক্ষা ভেঙে পড়েছে; স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে; কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রকল্পগুলি (যেমন মনরেগা ইত্যাদি) ভেঙে পড়েছে।
৭৯তম স্বাধীনতা দিবসে দাঁড়িয়ে দেশ এখন ভীষণ বিপর্যস্ত অবস্থায়, যার জন্য দায়ী সর্বাগ্রে নয়া উদারনীতি এবং তার পরিণতিতে ফ্যাসিবাদী উপাদানগুলোর ক্ষমতা দখলের সম্মিলিত প্রভাবে দেশ এক করুণ অবস্থায় রয়েছে। কিন্তু মোদীর স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে এসবের সামান্য উল্লেখও নেই; প্রতিকারের কোনও ব্যবস্থা তো দূরের কথা।
মন্তব্যসমূহ :0