Anuparna Roy

ভেনিস-জয়ী অনুপর্ণার অপেক্ষায় অধীর নপাড়া

জেলা

ভাস্কর দাশগুপ্ত : পুরুলিয়া 
 পুরুলিয়ার পুঞ্চা ব্লকের মানুষ এখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন অনুপর্ণা রায়ের জন্য। অনুপর্ণার প্রথম তথ্যচিত্র ‘রান টু রিভার’র শুটিং হয়েছিল পুঞ্চা ব্লকের নপাড়ায় তাঁর মামার বাড়ির গ্রামে। গ্রামবাসীরাও সেই তথ্যচিত্রে অভিনয় করিয়েছিলেন। একমাসের বেশি সময় তাঁদের সঙ্গে থেকে, তাঁদের ওয়ার্কশপ করিয়েছিলেন অনুপর্ণা। ছোটবেলা থেকেই লেখালেখি ছিল তাঁর অন্যতম প্রিয় বিষয়। তাঁর কাজের ক্ষেত্রে উঠে এসেছে নারী মুক্তির কথা, নারী মননের কথা।
অনুপর্ণা রায়ের পরিবার পুরুলিয়া জেলার নিতুড়িয়া ব্লকের নারায়ণপুর গ্রামের আদি বাসিন্দা। নিতুড়িয়ায় রানিপুর কোলিয়ারি হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন তিনি। বাবা ব্রহ্মানন্দ রায় ইসিএল’র কয়লাখনিতে চাকরি করতেন। মাধ্যমিক পাশ করার পর উচ্চমাধ্যমিকের পড়াশোনার জন্য অনুপর্ণা চলে যান নপাড়ায় মামাবাড়িতে। তাঁর মামী পুরুলিয়া শহরের বাসিন্দা তানিয়া সিংহ বললেন, ‘‘২০২২সালে শেষবার ও পুরুলিয়ায় নিজের বাড়িতে এসেছিল। নপাড়াতেই মাম্পি (অনুপর্ণার ডাকনাম)’র প্রথম তথ্যচিত্রের শুটিং হয়েছিল। খুবই প্রাণবন্ত মেয়ে ও।’’ 
অনুপর্ণার এই লড়াইয়ে জড়িয়ে আছে পশ্চিম বর্ধমানের কুলটিও। চাকরিতে বদলির জন্য তাঁর বাবাকে চলে যেতে হয় কুলটিতে। সেখানেই স্থানীয় কলেজে ইংরেজি অনার্সের পড়াশোনা শেষ করেন অনুপর্ণা। নয়াদিল্লিতে মাস কমিউনিকেশনের পড়াশোনার জন্য রওনা কুলটি থেকেই। পরে যান মুম্বাইতে। সেখানে তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় চাকরি নিয়েছিলেন। মঙ্গলবার অনুপর্ণার কুলটির বাড়িতে যান সিপিআই(এম) নেত্রী মীনাক্ষী মুখার্জি, প্রদীপ রায়, সুনীতি গাঁতাইত, মদন মণ্ডল প্রমুখ। অনুপর্ণার মা-বাবার সঙ্গে তাঁরা কথা বলেন। অনুপর্ণার প্রতি শুভেচ্ছা, অভিনন্দন তাঁদের কাছে জানান পার্টিনেতারা। 
যাত্রাপথে ছিল নানা প্রতিবন্ধকতা। পারিবারিক দুশ্চিন্তা ছিল। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার অদম্য ইচ্ছা ছিল। আর ছিল  আত্মবিশ্বাস। সেই আত্মবিশ্বাসে ভর করেই নিতুরিয়া ব্লকের নারায়ণপুর গ্রামের মেয়ে অনুপর্ণা রায় পৌঁছে গিয়েছেন ৮২তম ভেনিস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের ঝাঁ চকচকে মঞ্চে। তাঁর পরিচালিত সিনেমা ‘সঙ্‌স অব ফরগটেন ট্রিজ’র জন্য সেরা পরিচালকের পুরস্কার পেয়েছেন বছর ২৭’র অনুপর্ণা। মঞ্চে দাঁড়িয়ে পুরস্কার নিতে নিতে আনন্দে যত না তাঁর চোখের জল বেরিয়েছে, তার থেকে অনেক বেশি আবেগাশ্রু বেরিয়েছে প্যালেস্তাইনের অসহায় শিশুদের জন্য। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘‘হাততালি চাই না। ওই অসহায় শিশুদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য।’’ সমকালীন বিষয় নিয়ে ভাবতে ভালবাসেন অনুপর্ণা। 
অনুপর্ণার মা মনিকা রায় এদিন বললেন, ‘‘মেয়ের আত্মবিশ্বাস দেখে মনে হতো যে, সে কোনোদিন সফল হবেই। তবে চিন্তাও হতো। মেয়েকে শেষবার বলেও দিয়েছিলাম এবারই শেষ সুযোগ। না হলে আমাকে অন্যরকম ভাবতে হবে। বারেবারে চাকরি ছেড়েও দিয়েছে। আর মেয়ের উত্তর ছিল, সত্যজিৎ রায় হতে পারব না, কিন্তু আমি চেষ্টাটা তো করতে পারি এবং সেই চেষ্টা শেষে সফল হলো ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবের সেরা পরিচালকের শিরোপা পাওয়ায়।’’ বাবা ব্রহ্মানন্দ রায় বললেন, ‘‘ঠিকঠাক পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াবার জন্য মেয়েটাকে কত ধমকেছি। অনেক চাকরি ছেড়েছে, মেয়েটা বড় প্রাণবন্ত আমার।’’ অনুপর্ণার জেঠিমা বেবি রায় জানালেন, পরিবারের মেয়ের সাফল্যে খুশি যেমন পরিবার, খুশি গোটা নারায়ণপুর গ্রাম, খুশি গোটা নপাড়া গ্রাম। অনুপর্ণার পুরনো স্কুল রানিপুর কোলিয়ারি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুজিত পাল আনন্দ প্রকাশ করে বললেন, ‘‘আমাদের সকলের মাথা উঁচু করে দিয়েছে মেয়েটি। আমরা এখন ওর ঘরে ফেরার অপেক্ষায় রইলাম।’’
নাট্য পরিচালক, চলচ্চিত্রশিল্পী অনুপ মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘আসল কথা হলো স্বপ্ন দেখা এবং পাশাপাশি সেই স্বপ্নের সার্থক রূপায়ণ। মেয়েটি তা করে দেখিয়েছেন। যে বাড়িতে তিনি মুম্বাইতে বসবাস করতেন সেই বাড়ির ছবি তাঁর ছবিতে উঠে এসেছে। তার মানে শিল্পটাকে ভালোবেসে সেই শিল্পের রস কোথা থেকে সংগ্রহ করতে হয়, কিভাবে সংগ্রহ করতে হয় সেটা তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন। অবশ্যই কুর্নিশ তাঁকে।’’
 

মন্তব্যসমূহ :0

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন