প্রবন্ধ — মুক্তধারা, বর্ষ ৩
একের মধ্যে দশটা মানুষ
তপন কুমার বৈরাগ্য
একের মধ্যে দশটা মানুষ। যা পৃথিবীতে একজনের মধ্যেই দেখা যায়। সেই মানুষটা হলেন লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি। যিনি ১৪৫২ খ্রিস্টাব্দের ১৪এপ্রিল ইতালির
ভিঞ্চি গ্রামের অ্যানপিয়ানোতে জন্মগ্রহণ করেন।ভিঞ্চি গ্রামের নাম অনুসারে
তাদের নামের সাথে ভিঞ্চি যোগ হয়।পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইতালিতে যে নবজাগরণ ঘটে তার জনক ছিলেন লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি। অনন্য প্রতিভার অধিকারী ছিলেন এই মানুষটা। অসাধারণ সুন্দর ছিলেন তিনি।তাকে দেখলে মনে হতো তিনি যেন স্বর্গের কোনো দেবতা। তার মায়ের নাম ছিলো ক্যাটারিনা।
এক সরাইখানার অতি সাধারণ পরিচারিকা।দেখতে ছিলেন অসাধারণ
সুন্দরী। বাবা পিয়িরো দ্য ভিঞ্চি ছিলেন সম্ভ্রান্ত আইনজীবী।খুব ধনী পরিবারের
সন্তান।বংশগৌরবের জন্য তার পিতা তিনি জন্মগ্রহণের পর তার মাকে
পরিত্যাগ করেন। দুধের শিশুকে মায়ের বুক থেকে তিনি কেড়ে নিয়ে আসেন।
তারপর অভিজাত বংশের এক মেয়েকে বিয়ে করে তার হাতে এই শিশুপুত্রকে
তুলে দেন।এই সৎ মা তাকে মানুষ করে। পরে বড় হয়ে যখন জানতে পারেন
তার আসল মায়ের কথা, তখন তিনি তার মাকে অনেক খুঁজেছিলেন;কিন্তু
কোথাও তার সন্ধান পান নি।এই ঘটনার জন্য বাবার প্রতি যেন তার এক
বিতৃষ্ণা ছিল।তখন তার বয়েস মাত্র কুড়ি বছর।একদিন রাতে তার আসল
মাকে স্বপ্নে দেখলেন।কী অপরূপ সুন্দরী রমণী।যেন পরীর রানি।তার সাথে
তার মায়ের হুবহু মিল আছে।পরেরদিন আঁকতে বসলেন তার স্বপ্নে দেখা
রমণীকে। ছবি আঁকতে আঁকতে প্রায় তিনি তার মাকে স্বপ্নে দেখতেন।
ছবিটা কিভাবে সর্বাঙ্গীণ সুন্দর হয় সে দিকে তার লক্ষ্য ছিল।এই ছবিটা
আঁকতে তার ছবছর সময় লাগে।ছবিটার নাম দেন মোনালিসা।এই মোনালিসা
ছবিটায় লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চিকে পৃথিবীতে অমর করে রেখেছে।এই ছবি আঁকতে গিয়ে অনেকদিন তিনি তার মাকে স্বপ্নে দেখেন নি। তাই বহুদিন তাকে দিনে পর দিন অপেক্ষা করতে হয়। তারপর আবার যেদিন তিনি তার মাকে স্বপ্নে দেখলেন সেদিন থেকে আবার তার মায়ের ছবি আঁকতে বসলেন। দীর্ঘ ছ'বছর লেগেছিল এই ছবি আঁকতে।
ফাঁসির আসামির ছবি আঁকার জন্য তিনি ছুটে গেছেন জেলখানায়। ঘন্টার
পর ঘন্টা তিনি তাকে অনুশীলন করেছেন।তারপর এঁকেছেন তার ছবি।
যে ছবির মধ্যে ছিল বাস্তবতার প্রতিফলন।যখন তিনি ছবি আঁকতেন তখন
তিনি অলৌকিক শক্তির অধিকারী হতেন।কারো সাথে একটা কথাও বলতেন
না। জানা যায় মোনালিসা ছবিটা আঁকার সময় ছ'বছর তিনি মৌনব্রত পালন
করেছিলেন।পরিচারিকারা খাবার টেবিলে খাবার রেখে যেতেন।কতোদিন
তিনি না খেয়েই কাটিয়েদিতেন।এমন সাধক ছিলেন তিনি। তার আঁকা আর একটা বিখ্যাত ছবি 'শেষ নৈশভোজ'।তার মধ্যে দশজন মানুষের গুণ ছিল।
তাই তিনি একের মধ্যে দশটা মানুষ ছিলেন।এই দশটা গুণ ছিল চিত্রকর,
বীণাবাদক, বিজ্ঞানী,গায়ক, কারিগর আবিষ্কারক,সাহিত্যস্রষ্টা,গণিতবিদ,
প্রখ্যাত স্থপতিবিদ,প্রযুক্তিবিদ।
লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি বহু জিনিস আবিষ্কার করেন।যার অনেক কিছুই আমরা
জানি না। তিনি বাতাসের গতিবেগ পরিমাপক যন্ত্র অ্যানিমোমিটার
আবিষ্কার করেন।গাড়ির অডোমিটার তারই আবিষ্কার। যানবাহনের
বেগ পরিমাপক যন্ত্র স্পিডোমিটার তিনিই আবিষ্কার করেন।পৃথিবী যে
একটা বিরাট চুম্বক তিনিই প্রথম প্রমাণ করেন।তিনি প্রথম চুম্বক শলাকা
আবিষ্কার করেন।তিনিই ঘড়িতে প্রথম মিনিটের কাঁটা এবং ঘন্টার কাঁটা
ব্যবহার করেন।এককথায় সকল ক্ষেত্রেই ছিল তার স্বচ্ছন্দ বিচরণ।
তাইতো তিনি একের মধ্যে দশ।তার আঁকা এক একটা ছবির দাম উঠেছিল
কোটি কৌটি টাকা।কিন্তু ইতালী সরকার এই জাতীয় গৌরবের স্মৃতিচিহ্নগুলো
বিক্রি করেন নি।যেগুলো আজো ইতালীর জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
যা ইতালি দেশের পক্ষে সত্যিই গৌরবের।যেগুলো মহাকালের বুকে
চিরদিন বেঁচে থাকবে।তিনি ২রা মে ১৫১৯খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে ৬৭বছর বয়েসে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন।
Comments :0