গঙ্গার নানা ঘাটে গঙ্গা আরতি হবে বলে ঘোষণা করেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। ভারতের সংবিধানের ২৫- ২৮ নম্বর ধারায় ধর্মাচরণের অধিকার স্বীকৃত। সেই অধিকার বলে গঙ্গা আরতিও স্বীকৃত কিন্তু প্রশ্নটা হলো, সরকার নিজেই এই আরতির বন্দোবস্ত করতে পারে কি না।
কর আদায় সংক্রান্ত বিধি নিষেধ
সংবিধানের ২৭ নম্বর ধারায় বলা আছে যে, ধর্ম বা ধর্ম সম্প্রদায়ের প্রসার বা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কোনও নাগরিক বা সম্প্রদায়কে কর দিতে বাধ্য করা যাবে না। জনগণের করের টাকায় চলা সরকার, কর প্রদানকারী মানুষের ইচ্ছা নিরপেক্ষ এমন একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারে? যদি এমনটাও হয় যে, রাজ্যের বেশিরভাগ মানুষ গঙ্গা আরতি হোক তা চায় তাহলেও কি সরকার পারে এই কর্মসূচি গ্রহণ করতে? না, পারে না। সরকার সরাসরি কোনও ধর্মের প্রসারে কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে না।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্ম শিক্ষার বিধি-নিষেধ
২৮ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুরোপুরি সরকারি সাহায্যে পরিচালিত হয় সেখানে ধর্ম শিক্ষা দেওয়া যাবে না। এছাড়া সরকার কর্তৃক স্বীকৃত বা আংশিকভাবে সরকারি অর্থে পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে বা অপ্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের বিনা অনুমতিতে ধর্ম শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা যাবে না। অর্থাৎ সরকার সরাসরি নিজে কোনও ধর্মীয় কার্যকলাপে যুক্ত থাকতে পারবে না— একাজ সংবিধান বিরুদ্ধ। একাজ সংবিধানের মহামূল্যবান সারবস্তুর দ্যোতক-ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধী। এখানেই আমাদের দেশের সংবিধানের মাহাত্ম্য। এইজন্য আমরা আমাদের দেশের সংবিধানের জন্য গর্ববোধ করি।
ধর্মাচরণের অধিকার একচ্ছত্র নয়, শর্তসাপেক্ষ
আমাদের দেশের সংবিধানের ২৫-২৮ নম্বর ধারাগুলিতে একচ্ছত্রভাবে ধর্মাচরণের অধিকার দেয়নি। রাষ্ট্রকে বা কোনও রাজ্য সরকারকে তো দেয়ইনি। আমাদের দেশের সংবিধানে ধর্মাচরণের অধিকার শর্তসাপেক্ষ।
সংবিধানের ২৫(১) নম্বর ধারায় বলা হয়েছে বিবেকের স্বাধীনতা এবং ধর্মস্বীকার, ধর্মপালন, ধর্মপ্রচারের স্বাধীনতা সব নাগরিকের রয়েছে, তবে জনস্বাস্থ্য— সামাজিক শৃঙ্খলা-নীতিবোধ এবং অন্যান্য মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের জন্য রাষ্ট্র এই অধিকারকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এছাড়া কোনও বিশেষ আচার অনুষ্ঠান, কোন ধর্মের অঙ্গ কিনা তা বিচার করার ক্ষমতা আদালতের রয়েছে বলে সুপ্রিমকোর্ট ১৯৮৮ সালে হানিফ কুরেশি বনাম বিহার রাজ্য মামলায় রায় দেন। ২৫( ২) এর (ক) ধারায় বলা হয়েছে ধর্মাচরণের সঙ্গে জড়িত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বা অন্যান্য ধর্মনিরপেক্ষ কার্যাবলী নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার রাষ্ট্রের রয়েছে, তাছাড়া সামাজিক কল্যাণ সাধন ও সমাজ সংস্কারের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্র প্রয়োজনমতো আইন প্রণয়ন করে ধর্মীয় অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে পারে।
তাহলে দাঁড়াচ্ছে এই যে, ধর্মাচরণের স্বাধীনতা হলো শর্ত সাপেক্ষ এবং এই শর্তগুলো রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের আর সেই শর্ত পূরণ না হলে রাষ্ট্রের অধিকার থাকবে তাতে হস্তক্ষেপ করার। এভাবে দেশের সংবিধান ধর্মাচরণের অধিকারকে বেঁধে রেখেছে। এই বাঁধন আমাদের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার রক্ষাকবচ। এখানে সরকার জিম্মাদার কিন্তু সরকার নিজেই যদি জিম্মাদারের দায়িত্ব থেকে সংবিধানের রক্ষাকবচ ভাঙতে তৎপর হয় তাহলে তো সর্বনাশ!
মানব সভ্যতার সাথে সম্পৃক্ত গঙ্গার পূজা
দ্বিতীয় বিষয়টা হলো গঙ্গাকে মানুষ পুজো করে তার স্বচ্ছতার জন্যে, তার নির্মলতার জন্য, সে কারণেই গঙ্গার জলকে পবিত্র জ্ঞানে পূজা করা হয়েছে যুগ যুগ ধরে। প্রথমে সিন্ধু নদী তারপর গঙ্গা নদী ভারতবর্ষের নদীমাতৃক সভ্যতার দ্যোতক।
গঙ্গার জল পান, কৃষিতে ব্যবহার, নিত্যদিনের নানা কাজে সেই জলের ব্যবহার, গঙ্গাই সভ্যতার চালিকা শক্তি তাই তাকে পূজা করা। কিন্তু আজ তো গঙ্গার জল পানের অযোগ্য শুধু নয় স্নানেরও অযোগ্য বলে কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ ঘোষণা করেছে।
২০১৯ সালে কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ দেশের নদীগুলির দূষণের মাত্রা নির্ধারণ করে এক প্রতিবেদন প্রস্তুত করে তাতে গঙ্গা দূষণ সম্পর্কে যা তথ্য রয়েছে তা ভয়াবহ। উৎসস্থল উত্তরাখণ্ড থেকে বঙ্গোপসাগরের দিকে গঙ্গা যত এগিয়েছে ততই মারাত্মকভাবে বেড়েছে দূষণ। পশ্চিমবঙ্গে গঙ্গা দূষণের মাত্রা ভয়াবহ।
দূষণমাত্রার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক হলো কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি। কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া পরিবেশের সর্বত্র বিদ্যমান। জলে উদ্ভিদে মাটিতে। কিছু কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়াকে বলা হয় ‘ফিকাল কলিফর্ম ’ যাদের উৎস— মানুষ ও প্রাণীদের মল এবং অন্ত্র। ‘ই-কলাই’ হলো কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়ার এক নির্দিষ্ট প্রজাতি, এদের কেউ কেউ রোগ ভোগের জন্য দায়ী।
জলে ‘টোটাল কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া’ মানুষের জন্য বিপদের কারণ নয় কিন্তু কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া অন্যান্য ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া এবং ই কলাইয়ের উপস্থিতি নির্দেশ করে।
পানীয় জলের ক্ষেত্রে একটিও কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি কাম্য নয়। স্নানের ক্ষেত্রে প্রতি ১০০ মিলি লিটার জলে ৫০০ সংখ্যার উপস্থিতি ( এমপিএন) বা তার কম কাম্য।
কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের ২০১৯-এর প্রতিবেদন
বহরমপুরে ‘ফিকাল কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া’- র উপস্থিতি প্রতি ১০০ মিলি লিটারে ৩ লক্ষ, ‘টোটাল কলিফর্ম’-এর উপস্থিতি প্রতি ১০০ মিলি লিটারে ৫ লক্ষ।
পলতায় ‘ফিকাল কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া’-র উপস্থিতি প্রতি ১০০ মিলি লিটারে ১৩ লক্ষ, ‘টোটাল কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া’-র উপস্থিতি ৩০ লক্ষ প্রতি ১০০ মিলিলিটারে।
দক্ষিণেশ্বরে ‘ফিকাল কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া’-র উপস্থিতি প্রতি ১০০ মিলিলিটারে ৯ লক্ষ, ‘টোটাল কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া’- র উপস্থিতি ১৬ লক্ষ প্রতি ১০০ মিলিলিটারে।
গার্ডেনরিচে ‘ফিকাল কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া’- র উপস্থিতি প্রতি ১০০ মিলিলিটারে ৯ লক্ষ, ‘টোটাল কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া’- র উপস্থিতি ১৬ লক্ষ প্রতি ১০০ মিলিলিটারে।
এই প্রতিবেদনে দেশের দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের তথ্য বলেছে যে, আজ গঙ্গা দূষিত। যখন গঙ্গা পূজা শুরু হয়েছিল তখন মানুষের জীবন নদী- নালা, খাল - বিলের সাথে ছিল সম্পৃক্ত। শিল্প বিপ্লব - নগরায়নের পরে এসব থেকে এসেছে বিচ্ছিন্নতা, তখন নির্মল— পবিত্র গঙ্গার উদ্দেশ্যেই পূজার্চনা করা হতো; শিল্প বিপ্লব- নগরায়নের পরে ধীরে ধীরে গঙ্গা অপরিষ্কার - অপবিত্র হতে শুরু করে। আজ তার চরম সীমায় এসে পৌঁছেছে। আজ প্রতিটি ধার্মিক মানুষের এই আর্তি, ‘ গঙ্গার নির্মলতা – পবিত্রতা ফিরিয়ে দাও’, তাহলেই তার উদ্দেশ্যে পূজার্চনা সার্থক হবে।
তিরিশ হাজার কোটির ‘নমোমি গঙ্গে’! হাজার প্রশ্ন
কেন্দ্রীয় সরকার ২০১৪ সালে গঙ্গাকে দূষণমুক্ত করার উদ্দেশ্যে ২০,০০০ কোটি টাকার ‘নমোমি গঙ্গে’ প্রকল্প গ্রহণ করে যা ৩০,০০০ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। বলা হচ্ছে এই প্রকল্প ১৫ বছরের জন্য। পয়ঃপ্রণালীর জল শোধন, গঙ্গাপাড়ের উন্নয়ন, গঙ্গার জল পরিষ্কার করা, জীববৈচিত্র রক্ষা করা, বনসৃজন করা, জনসচেতনতার কর্মসূচি এই প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আট বছর সময়কাল অতিক্রান্ত, এখনও অর্ধেকের অনেক কম কাজ হয়েছে।
আশ্চর্যের কথা! জলশক্তি মন্ত্রক ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত একটা হিসাব দিচ্ছে যাতে বলা হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের জন্য ৪১৮০ কোটি টাকার অনুমোদন হয়েছে। ৬২টি প্রকল্পের ৩৫টি প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে।
প্রশ্ন হলো— এই প্রকল্পগুলি কী কী? এত টাকা কোথায় খরচ হলো ? এত অর্থ বরাদ্দের পরেও কেন গঙ্গায় সরাসরি পয়ঃপ্রণালীর জল এসে পড়ছে? কেন গঙ্গার জলে এই ভয়াবহ মাত্রায় দূষণ? কেন গঙ্গার জল এত নোংরা? জীববৈচিত্র রক্ষার কথা বলা আছে প্রকল্পে অথচ আদিগঙ্গাকে কেন কংক্রিটের বাক্সের মধ্যে বন্দি করা হলো? এতে জীববৈচিত্র বাক্সবন্দি হয়ে গেল নাকি?
গড়ে উঠুক জনমত– স্থির হোক অগ্রাধিকার
এসব প্রশ্নের উত্তর নেই অথচ এসব প্রশ্ন আজকের বিশ্বব্যাপী পরিবেশ সঙ্কটের আবর্তে সবচাইতে প্রাসঙ্গিক। ঢাকঢোল পিটিয়ে, চকমকে গঙ্গা আরতির সিদ্ধান্ত এসব প্রশ্নগুলিকেই আড়াল করে। এই প্রশ্নগুলো নিয়ে চর্চা শুরু হোক জনমানসে। রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ গঙ্গা সহ যে ১৭ নদীকে দূষিত বলে চিহ্নিত করেছে সেই নদীগুলি দূষণমুক্ত করা হোক। গড়ে উঠুক জনমত। মানুষই ঠিক করুক অগ্রাধিকার। গঙ্গা সহ রাজ্যের নদীগুলিকে অবিলম্বে দূষণমুক্ত করা? নাকি দূষণকে মান্যতা দিয়ে 'গঙ্গা আরতি '!
Comments :0